ঢাকা,রোববার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪

চকরিয়ায় ভারীবর্ষণে ডুবে গেছে নিন্মাঞ্চল বিপদসীমার উপরে মাতামুহুরী নদীর পানি

এম.জিয়াবুল হক, চকরিয়া :: করোনা ভাইরাসের ধকল সামাল দিতে হিমশিম সেই মুহুর্তে বর্ষামৌসুমের প্রথম লাগাতার ভারীবর্ষণে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ১৮টি ও একটি পৌরসভা এলাকার নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে পানিতে। মঙ্গলবার রাত থেকে শুরু হওয়া ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকার কারণে উজানের পাহাড় থেকে পানি নিচের দিকে নেমে আসায় বুধবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে মাতামুহুরী নদীর পানি বিপদ সামীর উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের চকরিয়া উপজেলার চিরিঙ্গা শাখা কর্মকর্তা (এসও) মো.শাহ আরমান সালমান।

তিনি বলেন, মঙ্গলবার রাত থেকে শুরু হওয়া ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকার কারণে উজানে লামা-আলীকদমের পাহাড় থেকে পানি নিচের দিকে নেমে আসায় বুধবার (১৭জুন) সন্ধ্যা ৬টার দিকে মাতামুহুরী নদীর পানি বিপদসামী ৬ দশমিক ২৫ সেন্টিমিটার অতিক্রম ৭ দশমিক ১২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

পাউবোর এই কর্মকর্তা বলেন, ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে বৃস্পতিবার থেকে চকরিয়া উপজেলার বিশেষ করে উপকুলীয় অঞ্চলের অবস্থা নাজুক হতে পারে। মাতামুহুরী নদীতে পানি প্রবাহ বাড়লেও বুধবার বিকাল পর্যন্ত পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীন চকরিয়া উপজেলার ৬৫ পোল্ডার এবং শাখা পোল্ডার গুলোর বেড়িবাঁেধ কোন ধরণের ভাঙ্গন কিংবা ক্ষতিসাধনের খবর পাওয়া যায়নি। তবে বৃষ্টিপাত থাকলে পানি আরও বাড়বে, তাতে বেড়িবাঁধের চরম ক্ষতিসাধন হবার সম্ভাবনা রয়েছে।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা দাবি করেছেন, প্রতিবছর বর্ষাকালে ভারী বর্ষণে মাতামুহুরী নদীতে পাহাড়ি ঢল নামে। ওইসময় উপজেলার বেশিরভাগ নিম্মাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেলেও একদিনের মধ্যে নীচের দিকে নেমে সাগরে মিলিত হয়ে যায় পানি প্রবাহ। তাতে জনগনের দুর্ভোগের মাত্রা অনেকাংশে কমে যায়। তবে এবছর জনগনের জন্য বিষপোঁড়া হিসেবে দেখা দিয়েছে বাস্তবায়িত দোহাজারি-কক্সবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত চকরিয়া অংশের রেল লাইনের উঁচু রাস্তাটি। কারণ বর্ষণের শুরুতে এই রাস্তার পূর্বাংশজুড়ে আটকা পড়েছে কয়েকফুট উচ্চতায় বৃষ্টির পানি। পানি নেমে যাওয়ার জন্য এলাকাভিত্তিক ছোট ছোট কালভার্ট না থাকায় এই পানি ভাটির দিকে নামতে পারছে না। পানিতে তলিয়ে গেছে হাজার হাজার একর জমির রোপিত ফসল। এক্ষেত্রে রেল লাইনের উুঁচ রাস্তাকেই প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখছেন ভুক্তভোগী মানুষগুলো। অপরদিকে আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখিত হতে চলেছেন এখানকার কৃষকেরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্ষণের শুরুতে মাতামুহুরী নদীর তীরের জনপদ সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, লক্ষ্যারচর, বরইতলী, সাহারবিল, চিরিংগা, কৈয়ারবিল ইউনিয়ন এবং চকরিয়া পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ডের নিন্মাঞ্চল হাটু সমান পানিতে তলিয়ে গেছে।

অপরদিকে উপজেলার পশ্চিমাংশের রেল লাইনের উঁচু রাস্তাটির কারণে ব্যাপক জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে হারবাং, বরইতলী, কোনাখালী, ঢেমুশিয়া, পূর্ববড় ভেওলা, পশ্চিম বড় ভেওলা, বিএমচর, সাহারবিল, চিরিঙ্গা, ফাঁসিয়াখালী, ডুলাহাজারা, খুটাখালী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে। তার ওপর ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকায় তলিয়ে যাচ্ছে ক্ষেতের ফসলও।

স্থানীয় জনপ্রতনিধিরা জানিয়েছেন লাগাতার বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে উপজেলার চিংড়ি জোনের মৎস্য প্রকল্পসমূহ পানিতে তলিয়ে গিয়ে বিপুল পরিমাণ মাছ পানিতে ভেসে যাওয়ার আশংকা দেখা দেবে।

বরইতলী ইউপি চেয়ারম্যান জালাল আহমদ সিকদার ও কোনাখালী ইউপি চেয়ারম্যান দিদারুল হক সিকদার বলেন, ভারী বর্ষণে আমাদের এলাকার বেশিভাগ নিম্মাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোও পানিতে ডুবে গেছে। বুধবার বিকালে বাঘগুজারা রাবার ড্যাম এলাকার কয়েকটি গ্রামে নদীর পানি ঢুকেছে। এ অবস্থায় বেড়িঁবাধ ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

চকরিয়া পৌরসভার মেয়র মো.আলমগীর চৌধুরী বলেন, টানা বৃষ্টিতে পৌরসভার নীচু এলাকার শতাধিক পরিবার জলাবদ্ধতার কাছে জিন্মি হয়ে পড়েছে। আটকে থাকা পানি যাতে দ্রুত নেমে যায় সেজন্য আগে থেকে ড্রেনগুলো পরিষ্কার করা হয়েছে। মাতামুহুরী নদীর পানি ইতিমধ্যে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এভাবে বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে যেকোন সময় বেড়ীবাঁধ ভেঙ্গে যেতে পারে। এতে পৌরশহর হুমকীর মুখে পড়তে পারে ।

চিরিংগা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জসীম উদ্দিন চকরিয়া নিউজকে জানান, বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে এবং মাতামুহুরী নদীর পানি বিপদ সীমার উপরে প্রবাহিত হলে উপকূলীয় অঞ্চলের চিংড়িজোন পানিতে তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে শত কোটি টাকার মাছ পানিতে ভেসে যাওয়ার আশংকা রয়েছে ।

সুরাজপুর-মানিকপুরের ইউপি চেয়ারম্যান আজিমুল হক ও কাকারা ইউপি চেয়ারম্যান শওকত ওসমান চকরিয়া নিউজকে বলেন, আমাদের ইউনিয়ন দুটি একেবারে মাতামুহুরী নদী লাগোয়া। নদীতে পানি বাড়তে থাকায় এলাকার রাস্তা-ঘাট, ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে লোকজন। বুধবার দুপুর থেকে অনেক পরিবারের ঘরে পানি ঢুকে পড়ার কারণে রান্নার কাজ বন্ধ রয়েছে ।

কৈয়ারবিল ইউপি চেয়ারম্যান মক্কি ইকবাল হোসেন,টানা বৃষ্টিতে কৈয়ারবিলের বেশিরভাগ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। ইউনিয়েনের খিলছাদক, ভরন্যারচর, বানিয়ারকুম গ্রামের মানুষ পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে।

লক্ষ্যারচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তাফা কাইছার চকরিয়া নিউজকে বলেন, ভারী বৃষ্টিপাত আর মাতামুহুরী নদীতে ঢলের পানি নামায় আমার ইউনিয়নের নিচু এলাকা বুধবার দুপুরে পাব্লিত হয়ে গেছে। চকরিয়া সরকারি বিশ^বিদ্যালয় কলেজ, আমজাদিয়া রফিকুল উলুম মাদরাসাসহ একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঢুকে পড়েছে হাটু সমান পানি। দুর্ভোগে পড়েছে সাধারণ মানুষ।

চকরিয়া পরিবেশ সাংবাধিক ফোরামের সভাপতি এম আর মাহমুদ চকরিয়া নিউজকে জানান, উপজেলার চারিদিকে বিভিন্ন ধরণের উঁচু রাস্তা ও বাঁধ থাকায় ভারী বর্ষণ ও নদীর পানি ভাটির দিকে নামতে পারছে না। এতে ডুবে যাচ্ছে লোকালয়। এই অবস্থায় বিপদসীমা অতিক্রম করে উজান থেকে পাহাড়ি ঢলের পানিও নামতে শুরু করেছে মাতামুহুরী নদীতে। এতে ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখিন হবেন চকরিয়ার মানুষ।

মাতামুহুরী সাংগঠনিক উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পশ্চিম বড় ভেওলা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাবলা চকরিয়া নিউজকে বলেন, ভারী বর্ষণে কারণে ইউনিয়নের বেশিরভাগ এলাকা পানিতে ডুবে গেছে। কারণ দোহাজারি টু কক্সবাজার এবং ফাঁসিয়াখালী টু মাতারবাড়ি কয়লাবিদ্যুত পর্যন্ত রেললাইন সড়কের বিশাল অংশ আমার ইউনিয়নে পড়েছে। এতে বৃষ্টির পানি নামার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধতা সৃষ্টি করছে রেল লাইনের উঁচু রাস্তা। তাই রেল লাইনটি পুরোপুরি বাস্তবায়নের আগে এলাকাভিত্তিক সমস্যা চিহ্নিত করে পানি যাতে ভাটির দিকে নামতে পারে সেজন্য ছোট ছোট কালভার্ট নির্মাণ করা খুবই জরুরী। এসব বিষয় জেলা এবং উপজেলা প্রশাসনকে লিখিতভাবে অবহিত করা হবে।’

চকরিয়া-পেকুয়া (কক্সবাজার-১) আসনের আসনের সংসদ সদস্য ও চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাফর আলম চকরিয়া নিউজকে বলেন, বর্ষা মওসুমের শুরুতে টানা বর্ষণে চারিদিকে পানি জমে যাওয়ার ক্ষেত্রে রেললাইনের নির্মিতব্য মাটির রাস্তাটিকে দায়ি করছেন মানুষ। এখনো রেল লাইনের কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি, সেহেতু কোথায় কী সমস্যা তা চিহ্নিত করার সুযোগ হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে এই সমস্যা সমাধানকল্পে এলাকাভিত্তিক পানি নিষ্কাষনের সুবিধার্থে কালভার্ট নির্মাণসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। অপরদিকে উপকূলীয় এলাকার স্লুইস গেটগুলো খুলে দিতে ইতোমধ্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ শামসুল তাবরীজ চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘ভারি বর্ষণ এবং মাতামুহুরী নদীতে নেমে আসা উজানের পানি যাতে দ্রুত ভাটির দিকে নেমে যেতে পারে সেজন্য উপকূলীয় এলাকার সকল স্লুইস গেট গুলো জরুরী ভিত্তিতে খুলে দিতে সংশ্লিষ্টদের কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, বুধবার বিকালে আমি সরেজমিন উপস্থিত হয়ে সাহারবিলের চোয়াঁরফাড়ি স্লুইট গেটটি খুলে দিয়েছি। পানি নামতে যেসব পয়েন্টে প্রতিবন্ধকতা আছে তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও রেল লাইনের উঁচু রাস্তার কারণে যেসব এলাকায় পানি নামতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে তা চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের সঙ্গে বসে করণীয় নির্ধারণ করা হবে।

পাঠকের মতামত: