নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া ::
চকরিয়ায় প্রকট আকার ধারণ করেছে মরণব্যাধি ডেঙ্গু রোগ। বিশেষ করে পৌরসভা এলাকায় যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনায় ভরপুর হয়ে থাকায় ব্যাপকভাবে বিস্তার ঘটছে এডিসসহ বিভিন্ন প্রজাতির মশার। আর এসব মশা ভাইরাস বহন করায় এই রোগের প্রকোপ বেড়েছে চকরিয়ায়। প্রতিদিন সরকারি ও প্রাইভেট হাসপাতালে ভিড় করছেন এই রোগে আক্রান্ত মানুষগুলো।শিশু থেকে শুরু বৃদ্ধা পর্যন্ত কেউ বাদ পড়ছে এ মরণ ব্যাধি ডেংগু থেকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত প্রায় দুইমাস ধরে এই রোগের প্রকোপ বেড়েছে চকরিয়া উপজেলা সদর সহ ১৮টি ইউনিয়নের আনাচে-কানাচে । এই সময়ের মধ্যে অন্তত তিন শতাধিক নারী-পুরুষকে ডেঙ্গু রোগী বলে শনাক্ত করা হয়েছে চিকিৎসালয়গুলোতে। অনেক রোগী সময়মতো চিকিৎসা পেয়ে ভাল হলেও অনেকে চকরিয়া, কক্সবাজার ছাড়াও চট্টগ্রাম মহানগরের হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছেন।
এদিকে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে গতকাল রবিবার সকালে মারা গেছেন আবু ইউসুফ জয় (২৮) নামের এক ছাত্রলীগ নেতা। তিনি এবং তার বাবা নুরুল ইসলাম একসঙ্গে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রথমে প্রাইভেট হাসপাতাল জমজম এ ভর্তি হন। কিন্তু অবস্থার অনবতি হওয়ায় নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে কয়েকদিন চিকিৎসা নেওয়ার পরও উন্নতি না হওয়ায় ভর্তি করা হয় চট্টগ্রাম নগরীর পার্ক ভিউ হাসপাতালে। সেখানে কয়েকদিন ধরে লাইফ সাপোর্টে থাকাবস্থায় গতকাল মারা যান জয়।
চকরিয়া পৌরসভার এক কাউন্সিলর জানান, প্রায় ১০দিন আগে তার ওয়ার্ডের হালকাকারা মৌলভীর চর গ্রামের নুরুল ইসলাম এবং তার পুত্র চকরিয়া পৌরসভা ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক আবু ইউসুফ জয় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন। তন্মধ্যে বাবা নুরুল ইসলাম চিকিৎসা পেয়ে সুস্থ হন। কিন্তু বেশ কয়েকদিন চিকিৎসা নেওয়ার পরও অকালে মৃত্যুবরণ করেন জয়।
ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ বাড়ার বিষয়ে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. কবির আহমদ চকরিয়া নিউজকে বলেন, সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি প্রাইভেট হাসপাতালেও প্রতিদিন ভিড় করছে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত অসংখ্য নারী-পুরুষ। তন্মধ্যে চকরিয়া পৌরসভার বেশিসংখ্যক রোগী চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ছুটছেন।
চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সাবেক ডাক্তার কবির আহমদ চকরিয়া নিউজকে আরো বলেন, ব্রেকবোন ফিভার বা ডেঙ্গু রোগের প্রধান লক্ষণগুলোর মধ্যে অন্যতম হাড়ের অসহ্য ব্যথা এবং প্রচণ্ড জ্বর। এ কারণে পানির পিপাসা দেখা দেবে। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিলে সুস্থ হয়ে উঠতে পারে এই রোগে আক্রান্তরা। তাই এই রোগের প্রকোপ থেকে বাঁচতে সচেতনতার বিকল্প নেই।
সম্প্রতি এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন পৌরসভার মাস্টা
র পাড়ার বাসিন্দা আবু সালাম। এছাড়া ফুলতলার ওসমান গণি মিন্টু এবং তার দুই মেয়ে ও এক ছেলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন। পৌরশহরের সৌদিয়া বইঘরের মালিক জাহাঙ্গীর আলমও ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিয়ে এখন ভাল হওয়ার পথে।চকরিয়ার প্রাইভেট হাসপাতাল জমজম এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. গোলাম কবির চকরিয়া নিউজকে জানান, ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে গত দুইমাসে শুধুমাত্র এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় তিন শতাধিক রোগী। তন্মধ্যে যেসব রোগীর শরীরে রক্তের প্লাটিলেট এর পরিমাণ ৩০ হাজারের নীচে নেমেছে তাদেরকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। তবে এখনো পর্যন্ত জমজম হাসপাতালে কোন রোগী মৃত্যুবরণ করেনি।
চকরিয়া পৌর শহরের পরিবেশ সচেতন নাগরিকদের অভিযোগ, পুরো পৌরশহর চিরিঙ্গায় যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া ড্রেনেজ ব্যবস্থা সচল করতে গিয়ে একসঙ্গে প্রায় ড্রেন নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। এসব ড্রেন নির্মাণ করতে গিয়ে একেবারে বন্ধ হয়ে রয়েছে ময়লা পানি চলাচল। আর এতেই এডিস মশার বিস্তার ঘটছে ভয়াবহভাবে। এ কারণে চকরিয়ায় ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ বাড়ছে বলে দাবি এসব নাগরিকের।চকরিয়া পেৌরসভা কতৃপক্ষের থেকে এখনো পর্যন্ত এসব ড্রেনেজ ব্যবস্থার কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। চকরিয়ায় ডেংগু রোগের বিস্তারের জন্যে পেৌরসভাকে দায়ী করেছেন সচেতন পেৌরবাসী।
তবে চকরিয়া পৌরসভার সচিব মো. মাসউদ মোর্শেদ চকরিয়া নিউজকে বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ রোধে গত কয়েকদিন ধরে পৌরশহরের বিভিন্নস্থান এবং পৌরসভার ৯ ওয়ার্ডে মশা নিধন কার্যক্রম চলছে। তবে ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নের কাজ চলমানের সময় ময়লা পানি জমে থাকার কথাটি সত্য নয়। ড্রেন নির্মাণ করতে গিয়ে যাতে কোথাও দুইদিনের বেশি ময়লা পানি ধরে রাখা হয়নি।
এ ব্যাপারে চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও প. প. কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ শাহবাজ চকরিয়া নিউজকে বলেন, প্রতি সপ্তাহে ৫-৬জন রোগী ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আসলেও তা নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা একটু বেড়েছে। এই রোগের প্রতিকারে নির্দিষ্ট কোন ভ্যাকসিন নেই। তবে এই রোগ প্রথমপর্যায়ে শনাক্ত হলে এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পেলে কয়েকদিনের মধ্যেই সেরে উঠতে পারে আক্রান্ত ব্যক্তি। কিন্তু ডেঙ্গুর ভাইরাস যখন পুরো শরীরে ছড়ায় তখন প্রচণ্ড জ্বর এবং জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যথার পাশাপাশি রক্ত বেরুতে থাকে।
তিনি বলেন, এডিসসহ বিভিন্ন প্রজাতির মশা ডেঙ্গু রোগের ভাইরাস বহন করে। তাই সচেতন থাকার পাশাপাশি বাড়ির আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার-পরিছন্ন রাখার মাধ্যমে এই রোগ থেকে প্রতিকার পাওয়া সম্ভব।
পাঠকের মতামত: