ইমাম খাইর, কক্সবাজার :: গত শুক্রবার (২১ আগস্ট) চকরিয়া উপজেলার হারবাংয়ে গরুচোর সিন্ডিকেট ধরে শাস্তি দেয়ার ঘটনায় ফেঁসে যাচ্ছেন চেয়ারম্যান মিরানুল ইসলাম মিরান। মা ও মেয়েকে এক রশিতে বেঁধে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি সবার মুখেমুখে। ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
মহিলাদের কোমরে প্রকাশ্য দিবালোকে রশি বেঁধে সড়কে হাঁটিয়ে কিভাবে পরিষদে নিলেন? তাও পুরুষ দিয়ে।
এ জন্য চেয়ারম্যান ও চৌকিদারকে দুষছেন অনেকেই। এটি একদিকে যেমন শ্লীলতাহানি, অপরদিকে মানবাধিকারের লঙ্ঘনও।
তবে, ঘটনার বিষয়ে জানতে চেয়ারম্যান মিরানুল ইসলাম মিরানের মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও বন্ধ পাওয়া যায়।
কি ঘটেছিল সে দিন?
শুক্রবার সকালে চকরিয়া উপজেলার হারবাংয়ের ৮ নং ওয়ার্ডের মধ্যম বৃন্দা বনখিল এলাকার মো. মাহবুবুল হক মাস্টারের একটি গরুর বাচুর চুরি হয়।
ওই দিন ঠিক জুমার নামাজের আগ মুহূর্তে খবর পান, পহরচাঁদা ডেবলতলী এলাকায় একটি সিএনজি ও গরুসহ কয়েকজন চোরকে আটক করেছে স্থানীয় বাসিন্দারা।
এসময় স্থানীয়দের ওপর উল্টো আক্রমণ করে চোর সিন্ডিকেটের সদস্যরা। তাতে ক্ষিপ্ত হয় এলাকাবাসী। ইতোমধ্যে জুমার নামাজ পড়ে বের হওয়া লোকজনের কানে পৌঁছে যায় এই খবর।
মুহুর্তের মধ্যে ঘটনাস্থলে জড়ো হয়ে যায় শত শত লোক। তখন ক্ষুব্ধ জনতা ধৃত চোরদের কয়েক দফা মারধরও করে।
এ সময় চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার কলাউজান এলাকায় একটি আমন্ত্রণে ছিলেন চেয়ারম্যান মিরানুল ইসলাম মিরান।
ঘটনাটি তিনি স্থানীয়দের মাধ্যমে মুঠোফোনে জানেন।
পরে আটক গরু চোরদের ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে পরিষদে নিয়ে যাওয়ার জন্য চৌকিদারদের নির্দেশ দেন চেয়ারম্যান।
হারবাং ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ঘটনাস্থল ডেবলতলির দূরত্ব অনুমান দেড় কিলোমিটার।
এই পথে নেয়ার সময় উৎসুক-ক্ষুব্ধ জনতার মোবাইলে ধারণকৃত ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুহুর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়ে যায়।
যেখানে এক রশিতে মা ও মেয়েকে বেঁধে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটি বেশ গুরুত্ব পায়।
যেটি শ্লীলতাহানীর পাশাপাশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের পর্যায়ে পড়ে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে জানা গেল, ধৃতরা পেশাদার গরুচোর। তারা সংখ্যায় ৭-৮ জন ছিল। মা-মেয়েসহ চার জনের বাড়ি পটিয়ার শান্তির হাটে। আরেকজনের বাড়ি পেকুয়া লালব্রিজ এলাকায়। পালিয়ে যাওয়া কয়েকজন চোর পহরচাঁদা এলাকার।
ঘটনাস্থল থেকে তিনজন মহিলার কোমরে রশি বেঁধে প্রকাশ্য সড়কে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে।
পরে তাদের নিকট থেকে ছুরা, কস্টেপ, এয়ার ফ্রেশ জাতীয় অজ্ঞান করার সরঞ্জামও উদ্ধার করা হয়েছে বলে থানায় দায়েরকৃত এজাহারে উল্লেখ আছে।
২১ আগস্ট গরু চুরির ঘটনায় চকরিয়া থানায় মামলা করেছেন মো. মাহবুবুল হক। যার নং মামলা নং-২১/৩৫৬। এ মামলায় ধৃত গরু চোরদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
ঘটনা সম্পর্কে স্থানীয় ইউপি সদস্যের বর্ণনা:
ঘটনার প্রসঙ্গে হারবাং ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নং ওয়ার্ড সদস্য ছৈয়দ নুরের কাছে জানতে চাইলে বলেন, উত্তর হারবাং লালব্রিজ এলাকা থেকে মাহবুবুল হক মাস্টারের একটি গরুর বাচুর চুরি হয়।
গরু টানাটানি করতে দেখেছে এমন কয়েকজনের দেয়া খবরের ভিত্তিতে মাস্টারের ছেলে নুরুল ইসলাম দৌঁড়ে গিয়ে দেখেন গরুর বাচুরটি নেই। তখন তিনি একটি মোটর সাইকল নিয়ে বাচুর খোঁেজ বের হন।
ততক্ষণে প্রায় ৬ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ডেবলতলি হয়ে প্রধান সড়কে ওঠতে গিয়ে চোরের দলের সিএনজি আটকে যায়।
এই সুযোগে সিএনজিটি আটক করে এলাকাবাসী। এমন সময় স্থানীয়দের উল্টো ‘গরু চোর’ সম্বোধন করে মারতে তেড়ে যায় চোরেরা।
ঘটনাটি চেয়ারম্যানকে ফোনে জানানোর পরে আহমদ হোসেন চৌকিদারকে তিনি ঘটনাস্থলে যেতে নির্দেশ দেন।
বিকাল চারটার দিকে চেয়ারম্যান পরিষদে পৌঁছেন। তিনি ওসি, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানান।
মেম্বারের ছৈয়দ নুরের মন্তব্য, গরু চোরদের আটকের পর স্থানীয়রাই মারধর করেছে। তাতে কোন জনপ্রতিনিধির হাত নেই। পরিষদে নেওয়ার পর চেয়ারম্যান বা অন্য কেউ মারধর করে নি।
তবে স্থানীয় অনেকের ভাষ্য হলো, ঘটনাস্থলে প্রথমদফায় জনতা মেরেছে। পরিষদে নেয়ার পরে চেয়ারম্যান মিরানুল ইসলাম মিরান আবার প্রচণ্ড প্রহার করেন। একপর্যায়ে তাদের শারীরিক অবস্থার গুরুতর অবনতি ঘটলে পুলিশ গিয়ে মা ও মেয়েকে উদ্ধার করে চকরিয়া হাসপাতালে ভর্তি করে।
এ বিষয়ে চকরিয়া থানার হারবাং তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক আমিনুল ইসলাম বলেন, শুক্রবার স্থানীয়রা ফাঁড়িতে খবর দিলে আমরা ফোর্স পাঠাই। আমাদের ফোর্স গিয়ে গুরুতর অবস্থায় মা মেয়েকে উদ্ধার করে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে আসি। আমরা তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি।
হারবাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিরানুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে তাদের উপর নির্যাতন হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এমন অভিযোগ ওদের কেউ করেনি। আমাদের ফোর্স যখন ঘটনাস্থলে যায় তখন সেখানে দুই শতাধিক মানুষ উপস্থিত ছিলেন। সেখান থেকে তাদেরকে আমাদের হেফাজতে নিয়ে আসাটাই প্রাধান্য দিয়েছি। আর ভুক্তভোগী কিংবা অন্য কেউ যদি অভিযোগ করে আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’
তবে ঘটনার একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, একদফা মা-মেয়ের ওপর নির্যাতন চলার পর হারবাং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান মিরানুল ইসলাম মিরান চৌকিদার (গ্রাম পুলিশ) পাঠিয়ে তাদেরকে রশিতে বেঁধে তার কার্যালয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করেন। উপর্যুপরি নির্যাতন শেষে চেয়ারম্যানের লোকেরাই মা-মেয়েকে মুমূর্ষু অবস্থায় পুলিশের হাতে তুলে দেন।
পাঠকের মতামত: