ঢাকা,শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪

চকরিয়ায় কাবিটা ও কাবিখা প্রকল্পের নামে ‘পুকুরচুরির’ অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া :: কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায় গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর), গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার কর্মসূচির কাবিটা (কাজের বিনিময়ে টাকা) ও কাবিখা (কাজের বিনিময়ে খাদ্য) কর্মসূচির অংশ হিসেবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২০৯টি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও বেশির ভাগ প্রকল্প অসম্পূর্ণ। কাগজ-কলমে এমন প্রকল্পও বাস্তবায়ন দেখানো হয়েছে, যার কোনো অস্তিত্বই নেই। নাম বদল করে কাবিটা ও কাবিখা প্রকল্প থেকে দুবার বরাদ্দ নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। আবার কোনো ধরনের কাজ না করে প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে।

১৬ থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই প্রতিবেদক উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের ৪৬টি প্রকল্প এলাকা সরেজমিনে ঘুরেছেন ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। এর মধ্যে ১৭টি প্রকল্পের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। নাম বদল করে কাবিটা ও কাবিখা প্রকল্প থেকে দুবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, এমন প্রকল্প রয়েছে ৪টি। ১৩টি প্রকল্প মোটামুটি দৃশ্যমান। ১২টি প্রকল্পে নামমাত্র কাজ হয়েছে।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ের (পিআইও) তথ্য অনুযায়ী, ২০৯টি প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ দেওয়া হয় ২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এ ছাড়া ১০১ টনের বেশি চাল ও ১০১ টনের বেশি গম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল এসব প্রকল্পে। গত জুনে চাল ও গমের সরকারি দর হিসাবে কাবিখার এসব প্রকল্পের বরাদ্দের পরিমাণ আনুমানিক ৮৫ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। এই অর্থ হিসাবে নিলে ২০৯টি প্রকল্পে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। জুনে এসব প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে। প্রতিটি প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন দেখিয়ে চেকও তুলে নেওয়া হয়েছে। সূত্র বলছে, বরাদ্দের টাকার সিকিভাগ কাজও হয়নি।

এক মুঠো মাটিও ফেলা হয়নি
কাজ না হওয়া একটি প্রকল্প ছিল উপজেলা চেয়ারম্যানের বাসভবনের চারপাশে মাটি ভরাটের কাজ। কাবিটার দ্বিতীয় পর্যায়ে এই প্রকল্পে প্রায় দেড় লাখ টাকা অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। কাগজ-কলমে কাজ শতভাগ সম্পন্ন দেখালেও এক মুঠো মাটিও ফেলা হয়নি। প্রকল্পের পুরো টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটির সভাপতি চকরিয়া উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান জেসমিন হক জেসি। এই কাজ হয়েছে কি না তা নিয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই তাঁর। তিনি বলেন, ‘আমাকে শুধু প্রকল্প সভাপতি করা হয়েছিল। কাজ হয়েছে কি না মনে নেই।’

উপজেলার চিরিংগা ইউনিয়নের বুড়িপুকুর ইমাম হানিফা মসজিদ থেকে নুরুল ইসলামের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তায় মাটি ভরাট ও ব্রিক ফ্ল্যাট সলিংয়ে জন্য কাবিটার দ্বিতীয় পর্যায়ের কর্মসূচিতে ২ লাখ ১৬ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ইমাম হানিফা মসজিদ থেকে শুধু ১০০ মিটার রাস্তায় ইট বিছানো হয়েছে। নুরুল ইসলামের বাড়ি পর্যন্ত মাটি ভরাট ও ইট বিছানো হয়নি। একই এলাকায় বুড়িপুকুর ফারুকের বাড়ি থেকে হাবিব নূরের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তার উন্নয়নে ১ লাখ ১৬ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
তবে প্রকল্প সভাপতি স্থানীয় ইউপি সদস্য শাহ আলম বলেন, ‘ইমাম হানিফা মসজিদ থেকে নুরুল ইসলামের বাড়ি পর্যন্ত বরাদ্দের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। তবে ফারুকের বাড়ি থেকে হাবিব নূরের বাড়ি পর্যন্ত প্রকল্পটির বিষয়ে জানতাম। আমাকে শুধু প্রকল্প সভাপতি করা হয়েছে, স্বাক্ষর দিয়েছি। আর কিছুই জানি না।’

১৭ প্রকল্পের অস্তিত্ব নেই
টিআর ও কাবিটা প্রকল্প থেকে চিরিংগা ইউনিয়নের নামে চকরিয়া ফুটবল একাডেমির ক্রীড়া সামগ্রী ক্রয়, এসএআরপিভি অফিসের কম্পিউটার কক্ষ উন্নয়ন, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সংস্কার ও আসবাব ক্রয় করার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। একইভাবে লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের নামে চকরিয়া আবাসিক মহিলা কলেজে আসবাব সরবরাহ, চকরিয়া কোরক বিদ্যাপীঠের মাঠ ভরাট ও চকরিয়া সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের খেলার মাঠের পাশে ক্রিকেট পিচ নির্মাণ ও নেট স্থাপন করার জন্য ১৭টি প্রকল্পে প্রায় ১৪ লাখ ২১ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এসব প্রকল্পের কোনো কাজ হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চকরিয়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো. আবু হাসনাত সরকার বলেন, ‘২০২২-২৩ অর্থবছরে টিআর, কাবিটা ও কাবিখার প্রথম পর্যায়ের অনুমোদন আমার আগের পিআইও সাইদুল ইসলাম করেছেন। আপনার মাধ্যমে জানার পর প্রকল্পগুলোর খোঁজখবর নিচ্ছি।’

এ বিষয়ে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি সদ্য যোগদান করেছি। খোঁজ নিয়ে সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন জেপি দেওয়ান। বর্তমানে তিনি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় কর্মরত। তাঁর মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও মোবাইলটি বন্ধ পাওয়া যায়।

পাঠকের মতামত: