ঢাকা,রোববার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪

ক্লাব কেন্দ্রিক বিয়ের কারণে সামাজিক বন্ধন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বঞ্চিত হচ্ছে হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী -হারানো ঐতিহ্য!

::: এম.আর মাহমুদ :::

সেদিন আমার এক ভাগিনা অদ্ভূত একটি প্রশ্ন করেছে! তার জবাব দিতে কষ্ট হলেও প্রশ্নটি অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত। তার মতে চিরচেনা সমাজের পুরানো ঐতিহ্য দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। এক সময় সমাজে সব স্তরের সদস্যরা একে অপরের সুখ-দুঃখের অংশীদার ছিল। কিন্তু এখন তা আগের মত দেখা যায় না। বিশেষ করে ক্লাব বা কমিউনিটি সেন্টার কেন্দ্রিক বিয়ের অনুষ্ঠানের কারণে সমাজের বন্ধন দিন দিন চিড্ ধরছে। আধুনিক যুগে বিয়ের অনুষ্ঠানে ভুরি ভোজ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দরিদ্র সদস্যরা। কিন্তু বিয়ের অনুষ্ঠানে এসব দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে উপেক্ষা করলেও কবর খননে তাদেরকে ব্যবহার করতে ভুল করে না। সমাজ প্রথা চালু হওয়ার পর থেকে গ্রামের লোকজন সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করে আসছে। সুখ দুঃখে সমাজের সকল সদস্য অনেকটা সমান অংশীদারী ছিল। মৃত ব্যক্তির দাফন কাফন থেকে শুরু বিয়ে শাদীতে সমাজের সকল সদস্য অংশগ্রহণ করত। সমাজের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে কবর খনন ও জানাযায় অংশগ্রহণ করতে দেখা গেলেও ক্লাব কেন্দ্রিক বিয়ে শাদীতে তাদের উপস্থিতি তেমন একটা চোখে পড়ে না। ক্লাব কেন্দ্রিক বিয়ের কারণে সমাজে প্রতিনিয়ত নানা জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। সমাজের দরিদ্র সদস্যদের বক্তব্য সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করে আসলেও আলিশান বিয়ের অনুষ্ঠানে এক বেলা ভুরি ভোজের হকদার হয়েও শুধু গরিব বলে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। অথচ ক্লাবের উচ্ছিষ্ট খাবারগুলো হলেও সমাজের বঞ্চিতদের এক বেলা খাবার হয়। এসব বিয়েতে উচ্ছিষ্ট খাবারগুলো সমাজের দরিদ্র সদস্যরা যেমন পায় না, তেমনি পাড়ার পোষা কুকুর, বিড়াল, হাঁস, মুরগি ও কবুতরের ভাগ্যেও জুটে না। ছোট বেলায় একটি কবিতার ২টি লাইন বার বার মনে পড়ে। কিন্তু ওই কবির নামও আমার স্মরণ নাই। “মাথায় কত প্রশ্ন আসে দিচ্ছে না কেউ জবাব তার, সবাই বলে মিথ্যা বাজে বকিস্ না আর খবরদার!” মাথায় নানা প্রশ্ন আসলেও যুগের পরিবর্তনের সাথে তাল মিলাতে গিয়ে এসব জবাব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার কোন সমাধান নেই। শহর কেন্দ্রিক সমাজের রীতি নীতি অনুসরণ করতে গিয়ে আমাদের বাপ-দাদার চিরচেনা ঐতিহ্য গ্রাম থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এক সময় সমাজের ছেলেমেয়েদের বিয়ের আয়োজন চূড়ান্ত হলে বর ও কনে পক্ষ সমাজের সব সদস্যকে ডেকে পানছল্লার আয়োজন করত। সেখানে সমাজে সদস্যদের চা-নাস্তা খাওয়ানোর পরে পান খাওয়াতে ভুল করত না। আর নির্ধারণ করা হত সমাজের কতজন সদস্য কিভাবে খাবে? এবং সমাজের সদস্যরা কে কোন কাজে সহযোগিতা করবে? এখন শুধুমাত্র মৃত ব্যক্তির জন্য কবর খননের কাজটা ছাড়া সমাজের দরিদ্র সদস্যদের কি কাজই আছে? ইদানীং শুধু বিয়ে নয় খৎনা, কর্ণ ছেদন অনেক ছোট-খাটো অনুষ্ঠান ক্লাবমুখী হয়ে যাচ্ছে। তবে অবশিষ্ট আছে ঐতিহ্যবাহী মেজবান। কি জানি কখন মেজবানের আয়োজনও ক্লাবমুখী হয়। শহরের সমাজে ক্লাব বা কমিউনিটি সেন্টার কেন্দ্রিক বিয়ের অনুষ্ঠান হত। তবে এ প্রথা গ্রামে চালু ছিল না। বর্তমানে উপজেলা শহরে হু হু করে ক্লাব ও কমিউনিটি সেন্টার বেড়ে যাচ্ছে। এ কারণে সঙ্গতি না থাকা স্বত্বেও কন্যা দায়গ্রস্থ পক্ষ ক্লাব কেন্দ্রিক বিয়ের আয়োজন করতে বাধ্য হচ্ছে। তার উপরে রয়েছে যৌতুক। বর পক্ষের যৌতুকের দাবী মেটাতে গিয়ে কনে পক্ষ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাপ-দাদার রেখে যাওয়া সহায় সম্পদও হস্তান্তর করতে বাধ্য হচ্ছে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের সম্রাট ও চকরিয়া উপজেলা পরিষদের ভাইস-চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম আজাদের একটি গানের দুটো কলি বার বার নাড়া দেয় ‘অবু পোয়াল্লাইতো বউ আইন্নদে যৌতুক লইয় কিঅল্লাই, আল্লাহ জানে এ বউ তোয়ারে হন জ্বালা জ্বালায়!’ ক্লাব ও কমিউনিটি সেন্টার কেন্দ্রিক বিয়ের কারণে সমাজের বেশিরভাগ দরিদ্র জনগোষ্ঠী চরমভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে সামাজিক বন্ধন ভেঙ্গে পড়বে।

পাঠকের মতামত: