মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন, পেকুয়ায়-কুতুবদিয়া প্রতিনিধি :: কক্সবাজারের কুতুবদিয়া ও পেকুয়া উপজেলার মধ্যবর্তী বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়া চ্যানেলের মগনামা ইউনিয়নের কাকপাড়া বেড়িবাঁঁধ পয়েন্টে শক্তিশালী ৯টি ড্রেজার মেশিন বসিয়ে অবৈধ উপায়ে বালি উত্তোলন করছে এস আলম গ্রুপ। গত তিন মাস ধরে নির্বিচারে বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়া চ্যানেল থেকে অবৈধ উপায়ে বিপুল পরিমাণ সাগরের বালি উত্তোলন করে এস আলমের জমি ভরাট করার কাজ চালিয়ে গেলেও স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘রহস্যজনক’ নিরব রয়েছে। ইতিমধ্যেই এস আলম গ্রুপ সাগরের ওই পয়েন্ট থেকে বালি উত্তোলন করে তাদের প্রায় ৫’শ কানি জমি বালিদ্বারা ভরাট করে ফেলেছে। অপরদিকে সরকার বঞ্চিত হয়েছে মোটা অংকের রাজস্ব থেকে।
গতকাল ২৪ অক্টোবর বিকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বঙ্গোপগারের নিকটবতী কক্সবাজারের দুই পেকুয়া ও কুতুবদিয়া উপজেলার মধ্যবর্তী কুতুবদিয়া চ্যানেলের মগনামা কাকপাড়া পাড়া পয়েন্টের এক কিলোমিটারের মধ্যেই পণ্টুনে ৯টি শক্তিশালী ড্রেজার মেশিন বসিয়ে প্রশাসনের কাছ থেকে কোন ধরনের অনুমতি গ্রহণ না করেই অবৈধ উপায়ে বালি উত্তোলন করা হচ্ছে।
বালি উত্তোলনে নিয়োজিত কয়েকজন শ্রমিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রতি ড্রেজার মেশিন থেকে দিনরাত প্রায় ১লাখ ফুট সাগরের বালি উত্তোলন করা হচ্ছে। গত তিন মাস ধরে দিনরাত সমানতালে বিপুল পরিমাণ খনিজ বালি উত্তোলন করা হয়েছে। এ জন্য নারায়ণগঞ্জের জনৈক মাসুদের পল্টুনসহ ৪টি ড্রেজার মেশিন ও চট্টগ্রামের জনৈক ইলিয়াছের ৫টি ড্রেজার মেশিন ভাড়া করে এনে এস আলম গ্রুপ মগনামা ইউপি চেয়ারম্যান শরাফত উল্লাহ চৌধুরীর ওয়াসিমের সহায়তায় এসব বালি উত্তোলন করা হচ্ছে। এছাড়াও বালি উত্তোলনে নিয়োজিত শ্রমিক ও এস আলম গ্রুপের নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মগনামা কাকপাড়া পয়েন্টে একটি সাইক্লোন শ্লেল্টার অবৈধভাবে দখল করে বসবাস করছে।
এ প্রসঙ্গে মগনামা ইউপি চেয়ারম্যান শরাফত উল্লাহ চৌধুরীর ওয়াসিমের মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিগত কয়েক বছর পূর্বে কক্সবাজার জেলার পেকুয়া উপজেলার মগনামা ইউনিয়নের কাকপাড়া পয়েন্টে ষাটদুনিয়ার ঘোনা নাম এলাকায় এস আলম গ্রুপ প্রায় ৭’শ কানির অধিক জমি ক্রয় করেছে। অবৈধ উপায়েই প্রশাসনের অনুমতি ব্যতিরেকে কুতুবদিয়া চ্যানেল থেকে নির্বিচারে খনিজ বালি উত্তোলন করে এস আলম গ্রুপ তাদের জায়গা ভরাট করা করছে।
বালি উত্তোলনে তদরাকরী দায়িত্বে থাকা এস আলম গ্রুপের প্রতিনিধি মো: ইলিয়াছ জানান, এস আলম গ্রুপ দেশের বড় শিল্প প্রতিষ্টান। উন্নয়নের সাগরের বালি দিয়ে জমি ভরাট করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসক কার্যালয় ও পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে বালি উত্তোলনের অনুমতি নেওয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি কোন কাগজপত্র দেখাতে পারেনি।
এস আলম গ্রুপের অবৈধ বালি উত্তোলনের কারণে নষ্ট হচ্ছে সমুদ্রের জীববৈচিত্র ও প্রাকৃতিক পরিবেশ। উপকূল থেকে অন্তত ২০০ মিটার দূরে সমুদ্রে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে অবৈধ উপায়ে বালি উত্তোলন করা হচ্ছে। উত্তোলিত বালি পাইপলাইনের মাধ্যমে নিয়ে আসা হচ্ছে এস আলমের ক্রয়কৃত বির্স্তীণ জায়গায়। এভাবে বালি উত্তোলনে নষ্ট হচ্ছে সামুদ্রিক প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্র। ধ্বংস হচ্ছে সামুদ্রিক খনিজ সম্পদ, সামুদ্রিক প্রাকৃতিক জীবসম্পদ, মৎস্য, চিংড়ি, শামুক, ঝিনুক, ডলফিন, কাঁকড়া, সি-উইড, সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী, বিভিন্ন জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রজনন-আবাসস্থল। এভাবে জলবায়ু ও জীববৈচিত্র্যের ইকো-সিস্টেমকে ক্ষতিসাধন করে রাষ্ট্রের শত শত কোটি টাকার ক্ষতিসাধন করা হচ্ছে। এ ছাড়া সমুদ্রতল, জলরাশি, জলস্রোত, বায়ু, সামুদ্রিক প্রবালপ্রাচীরও দূষিত হচ্ছে।
অথচ জাতিসংঘের জেনেভা কনভেশন ১৯৫৮, ১৯৬০, ১৯৭০ সালের ১৭ ডিসেম্বরের ২৭৪৯(২৫) নম্বর সিদ্ধান্ত এবং জাতিসংঘের ১৯৮৪ সালের ৯ ডিসেম্বরের জ্যামাইকা কনভেশনে সাধারণ পরিষদের ১৫১৪(১৫) নম্বর সিদ্ধান্ত, জাতিসংঘের জীববৈচিত্র কনভেনশন ১৯৯২, ২০০০ সালের ২৯ জানুয়ারি কানাডার মন্ট্রিলে অনুষ্ঠিত জৈব নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রটোকল ২০০০, ১৯৭৩ সালের সাইটাস, ১৯৮০ সালের আইইউসিএন বিশ্ব সংরক্ষণ কৌশল, ১৯৮২ সালের প্রকৃতির বিশ্ব সনদ, ১৯৭২ সালের স্টকহোম ঘোষণা, দীর্ঘস্থায়ী জৈব রাসায়নিক পদার্থ সংক্রান্ত স্টকহোম কনভেনশন ২০০১, জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক জাতিসংঘ ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন ১৯৯২, রামসার কনভেনশন ১৯৭১-এ সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে, সমুদ্রের ইকো-সিস্টেমের ক্ষতিসাধন করে কোনো ধরনের ড্রেজার বসিয়ে মাটি বা বালি উত্তোলন করা যাবে না। জাতিসংঘের জেনেভা কনভেশন ও জ্যামাইকা কনভেনশনে বাংলাদেশ অন্যতম স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। জাতীয় পরিবেশ নীতিমালা ১৯৯২-এর ৩(১০) ধারা অনুযায়ী দেশের উপকূলীয় ও সামুদ্রিক ইকো-সিস্টেম এবং সম্পদের পরিবেশসম্মত সংরক্ষণ, উন্নয়ন, দূষণরোধ করার এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ সংশোধনী ২০১০-এর ৬(ঙ) ও ১৬ ধারা মোতাবেক সমুদ্রে ড্রেজার বসিয়ে বালি উত্তোলন করা সরাসরি নিষিদ্ধ থাকলেও আইনের তোয়াক্কা না করেই দেশের অন্যতম সুনামধন্য শিল্পগোষ্টী এস আলম গ্রুপ নির্বিচারে সমুদ্রে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালি উত্তোলন করছে।
এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্ততর কক্সবাজারের সহকারী পরিচালক নুরুল আমিন জানান, মগনামা কাকপাড়া পয়েন্টে সাগরের কুতুবদিয়া চ্যানেল থেকে অবৈধ উপায়ে বালি উত্তোলনের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত কী ব্যবস্থা নেওয়া যায় তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
জানা গেছে, মৎস্য রক্ষণ ও সংরক্ষণ আইন ১৯৫০-এর ২ ও ৩ ধারা, মৎস্য রক্ষণ ও সংরক্ষণ বিধি ১৯৮৫-এর ৩(১) (২) বিধির উপবিধি(১) এবং সামুদ্রিক মৎস্যক্ষেত্র অধ্যাদেশ ১৯৮৩-এর ১(খ) (ঘ), ২৪(২) ক, খ, ২৬ (ক) (খ) (গ) (ঘ) ধারা অনুযায়ী, নদীর মোহনা, সমুদ্রের মৎস্য প্রজনন ও আবাসস্থল এলাকায় বালি উত্তোলন করে মৎস্যসহ জীবন্ত সামুদ্রিক সম্পদের ক্ষতিসাধন করা যাবে না। এর পরও এস আলম গ্রুপ সমুদ্রে শক্তিশালী ৯টি ড্রেজার মেশিন বসিয়ে সামুদ্রিক খনিজ বালি উত্তোলন করে যাচ্ছে।
পেকুয়া উপজেলার সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বেনিজর আহমদ জানান, সুস্পষ্ট অভিযোগ পেলে অবৈধ উপায়ে বালি উত্তোলনে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
কক্সবাজার আণবিক শক্তি কমিশনের পরিচালক জানান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নীতিমলা অনুযায়ী খনিজ সম্পদ ও সামুদ্রিক খনিজ বালি পারমাণবিক শক্তি কমিশন ছাড়া আর কেউ উত্তোলন ও ব্যবহার করতে পারবে না। জনস্বার্থ ও দেশের কোটি কোটি টাকা ক্ষতি করে সামুদ্রিক প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এছাড়াও বিগত ২০১০ সালের বালুমহাল আইনে বলা আছে, বিপণনের উদ্দেশ্যে কোনো উন্মুক্ত স্থান, চা-বাগানের ছড়া বা নদীর তলদেশ থেকে বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না। এ ছাড়া সেতু, কালভার্ট, ড্যাম, ব্যারেজ, বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, বন, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা অথবা আবাসিক এলাকা থেকে বালু ও মাটি উত্তোলন নিষিদ্ধ।
এ প্রসঙ্গে জানতে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কার্যায়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো: আশরাফুল আফসারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, কুতুবদিয়া চ্যানেলের মগনামা কাকপাড়া পয়েন্টে থেকে বালি উত্তোলনের বিষয়ে অনুমতি রয়েছে কিনা তার জানা নাই। তবে তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
পাঠকের মতামত: