নিজস্ব প্রতিবেদক :: কক্সবাজার জেলায় ১৯৪টি অনুমোদনহীন করাত কল উচ্ছেদে সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়ন করছে না বনবিভাগ। একই সাথে অবৈধ করাতকলের বৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ নির্দেশনা আলোর মুখ দেখছে না। সরকারের এ নির্দেশনা কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। ফলে প্রতিদিন এসব করাত কলে কয়েক লাখ ঘনফুট কাঠ ধ্বংস হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন বন উজাড় হচ্ছে তেমনি অন্যদিকে পরিবেশ ও প্রতিবেশের উপর পড়ছে প্রভাব। আর সরকার বঞ্চিত হচ্ছে রাজস্ব থেকে। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ববোধ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
তবে বনবিভাগ বলছে রাজনৈতিক নেতাদের চাপ আর জেলা প্রশাসন থেকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট না পাওয়ায় অভিযান পরিচালনা করা যাচ্ছে না। জেলা প্রশাসন বলছে চিঠি দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে বনবিভাগ। আর বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে বনবিভাগ সঠিক তথ্য না দেয়ায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পারছেন না তারা।
জানা যায়, বনজ সম্পদ ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে সরকার বনায়নের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। ইতিমধ্যে বন রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সমগ্র দেশের মতো কক্সবাজারের ৯টি উপজেলার অবৈধ করাতকল উচ্ছেদ ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা গ্রহনের জন্য বন অধিদপ্তর থেকে বন ও বিদ্যুৎ বিভাগকে বারবার চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারের এ নির্দেশনা চিঠি আদান প্রদানের মাঝে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। মাঠ পর্যায়ে এর কোন প্রভাব লক্ষ করা যায় না। উল্টো অভিযোগ উঠেছে বন ও বিদ্যুৎ বিভাগের অসাদু কর্মকর্তারা করাত কলের মালিকদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করছেন না।
বনবিভাগের দেয়া তথ্য মতে, জেলার ৯ উপজেলায় ২২০টি করাতকলের মধ্যে ১৯৪টিই অনুমোদনহী। অনুমোদন রয়েছে মাত্র ২৬টি করাতকলের। চকরিয়া উপজেলার ৫৯টি করাতকলে অনুমোদনহীন ৫০টি, ঈদগাঁহ উপজেলার ১০টি করাতকলই অবৈধ। সদর উপজেলায় ২১টির মধ্যে ১৪টি, রামু উপজেলায় ২১টি, টেকনাফ উপজেলায় ২৯টির মধ্যে ১৯টি, উখিয়া উপজেলায় ২৭টি, মহেশখালী উপজেলায় ৩১টি, পেকুয়া উজেলায় ২২টি করাতকলই অনুমোদন ছাড়া চলছে। তবে কুতুবদিয়া উপজেলায় কোন করাতকল নেই বলে জানিয়েছেন বনবিভাগ।
বনবিভাগের কাছে অবৈধ করাতকলের তালিকা থাকার পরও কেন উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা হচ্ছে না তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে করাতকলের ব্যবসায়ীরা চ জানান, বনবিভাগকে মাসিক মাসোহারা দিয়ে এসব করাত পরিচালনা করা হয়। টাকা না দিলে উচ্ছেদ ও মামলার ভয় দেখানো হয়। প্রতিমাসে প্রকারভেদে ২ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত মাসোহারা নেন বিট কর্মকর্তা। এসব টাকার একটি অংশ যায় রেঞ্জ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিভাগীয় বন কর্মকর্তাদের কাছে। এইভাবে প্রতিটি অবৈধ করাতকল থেকে বছরে অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বনবিভাগের অসাধু কর্মকর্তারা।
অবৈধ করাতকল মালিকরা জানিয়েছেন, করাতকল লাইসেন্স বিধিমালা ২০১২ এর বিধি (ক) অনুযায়ী করাত কল স্থাপন ও পরিচালনার জন্য সংরক্ষিত, রক্ষিত, অর্পিত বা অন্য যে কোন ধরনের সরকারী বনভূমির সীমানা হইতে নূন্যতম ১০ কিলোমিটারের দুরুত্ব থাকতে হবে। লাইসেন্সের আবেদন করতে স্থানীয় চেয়ারম্যানের ছাড়পত্র, পরিবেশ ছাড়পত্র, সহকারীর কমিশনার (ভূমি) প্রত্যায়নপত্র, আয়কর সার্টিফিকেট সংগ্রহে থাকতে হবে। এসব কাগজপত্র সংগ্রহ করা হলে বনবিভাগের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা বরাবরে করাতকলের জন্য আবেদন করতে হবে। উক্ত আবেদনের প্রেক্ষিতে বনবিভাগ তদন্ত করবেন। এসব প্রক্রিয়া করতে একদিকে ভোগান্তি অন্যদিকে মোটাঅংকের ঘুষও দিতে হয়। তাই অনুমোদন ছাড়াই করাতকল বসিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করেন তারা। এক্ষেত্রে আরো সুবিধা হলো কোন কারণে বনবিভাগ অভিযানে নামলে আগেই আমাদের জানিয়ে দেয়া হয়।
এদিকে করাতকল উচ্ছেদ করা না গেলে বন রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করেন পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতারা। তারা বলেন, বর্তমান সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে বনায়ন সৃজনের উপর গুরুত্ব দিচ্ছে। সেখানে করাতকলের মাধ্যমে প্রতিদিন ধ্বংস হচ্ছে কাঠ। তাই বনজ সম্পদ রক্ষা করতে দ্রুত অবৈধ করাতকল উচ্ছেদে সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন তারা।
অবৈধ করাতকলের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে মন্ত্রণালয় ও বন বিভাগের চিঠি পাওয়ার কথা স্বীকার করে কক্সবাজার বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল কাদের গণি বলেন, আমরা বন বিভাগের পক্ষ থেকে সঠিক তথ্য ও নির্দেশনা না পাওয়ায় অভিযান পরিচালনা করতে পারছিনা।
কক্সবাজার পল্লী বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের জেনারেল ম্যানেজার মোঃ আক্তারুজ্জামান লস্কর জানান, বন সংরক্ষণ অধিদপ্তর থেকে অবৈধ করাতকলের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার চিঠি দেয়া হলেও মাত্র ২৫ টির তালিকা দেওয়া হয়েছে। সেই তালিকা অনুযায়ী কয়েকটি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছি। তবে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গেলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের বাধার সম্মুখীন হতে হয় আমাদের। তাই অনেক সময় সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করে ফিরে আসতে হয়।
উপকূলীয় বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক মোঃ সাইফুল ইসলাম জানান, মহেশখালীতে ৩১টি করাতকলের মধ্যে সবগুলোই অবৈধ। আমরা বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির বাধার সমুখীন হয়েছি। তবে উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতা পেলে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে। মাশোহারার বিষয়টি জানেন না বলে জানান তিনি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মোঃ সরওয়ার আলম জানান, আমাদের জনবল কম। পর্যায়ক্রমে ধাপে ধাপে আমরা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করছি। ইতিমধ্যে অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু করাতকল উচ্ছেদ করে মামলা দিয়েছি। সবগুলো উচ্ছেদের জন্য জেলা প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েছি। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যেকোন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সময় দিলে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে।
উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মোঃ আনোয়ার হোসেন সরকারও বেশ কিছু অবৈধ করাতকল উচ্ছেদ করা হয়েছে বলে দাবি করে মামলা দেয়ার কথা জানান। একই সাথে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের বাধার কথাও জানান।
তবে বনবিভাগের এ দুই কর্মকর্তা মাসিক মাশোহারা নেয়ার বিষয়ে অবগত নন বলে দাবি করেছেন।
জানতে চাইলে কক্সবাজার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ আবু সুফিয়ান জানান, বনবিভাগ থেকে ম্যাজিস্ট্রেটের চাহিদা চেয়ে মাঝে মাঝে চিঠি দেওয়া হয়। তারা চিঠি দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন। পরবর্তীতে জেলা প্রশাসনের সাথে আর কোন যোগাযোগ রক্ষা করেন না।
পাঠকের মতামত: