শাহজাহান চৌধুরী শাহীন,কক্সবাজার ॥
কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের ফুলছড়ির রেঞ্জাধীন ফুলছড়ি বনবিটে ২০০৪-২০০৫ সালে সরকারী ও বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে সৃজিত বনায়নের গাছ ও বনভুমি বিক্রির কাজ অব্যাহত রেখেছে বনকর্মীরা। ইতোমধ্যে অন্তত এক’শ কোটি টাকা মুল্যের বনায়নসহ ৪৩ হেক্টর বন ভুমি প্রায় ৩০ কোটি টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। বিক্রিত টাকার সিংহভাগ পেয়েছেন বনকর্মীরা। প্লট আকারে বিক্রিত বনভুমিতে অন্তত দুই হাজারের অধিক রোহিঙ্গা ঘরবানিয়ে বসতি করছে। ইতোমধ্যে আরো কয়েক কোটি টাকার বনভুমি বিক্রির পায়তারা চলছে। বিভাগীয় বন কর্মকর্তা অবসরে যাওয়ার আগ মুহুর্তে এধরনের রাষ্ট্র ও পরিবেশ বিধ্বংসী কাজে জড়িয়ে পড়ায় জনমনে ক্ষোভ বিরাজ করছে। তবে দায় এড়ানোর জন্য প্লট প্রাপ্ত উপকারভোগীদের চুক্তিনামা কেন বাতিল করা হবে না এবং ক্ষতিপূরণ কেন আদায় করা হবেনা মর্মে কারণ দর্শানোর নোটিশ ইস্যু করা হয়। বনবিভাগের এধরনের নোটিশকে লোকদেখানো বলে অবিহিত করেছেন সচেতন মহল।
সুত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের ফুলছড়ির রেঞ্জাধীন ফুলছড়ি বনবিটে ( ফুলছড়ি মৌজার আরএস ২৪৯৫/২৫৯৪, বিএস দাগ নং-৫১৪৪) ২০০৪-২০০৫ সালে উডলটের আওতায় ৫০ হেক্টর বনায়ন সৃজন করা হয়। ওই বনায়নগুলো ৫০ জন উপকারভোগীর মাঝে অংশীদারিত্ব চুক্তিনামা মুলে বরাদ্দও দেয়া হয়। উক্ত বনায়ন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য উপকারভোগীদের প্লট আকারে বুঝিয়েও দেন বনবিভাগ। বনায়নের গাছগুলো গত ২০১৬ সালে পূর্ণতা লাভ করে। তবে গত এক বছর আগেই প্রায় ৪০ হেক্টর বনায়নসহ বনভুমি বিক্রি হয়ে যায়। অবশিষ্ট ১০ হেক্টর বনায়নের মধ্যে গত কয়েক মাসে আরো ৩ হেক্টর বনভুমি সহ বনায়ন বিক্রি হয়ে গেছে। সেখানে শতশত বাড়িঘর গড়ে উঠেছে। অবাধে রোহিঙ্গাদের বসতি ঘেড়েছে বনভুমিতে।
স্থানীয় সুত্রে জানা গেছে, বনবিভাগের লোকজন ও অংশীদারগণ আতাঁত করেই প্রথমে বনায়নের গাছ সাবাড় করে গোপনে বিক্রি করে দেন। এরপর ধুধু মরুভুমিতে পরিণত করা বনভুমিগুলো প্লট আকারে প্রতি একর ১৫ লাখ টাকা দামে বিক্রি করা হয়েছে। গত বছর জানুয়ারীর আগেই প্রায় ৪০ হেক্টর বনায়ন ও বনভুমি বিক্রি হয়ে গেছে।
অবশিষ্ট ১০ হেক্টর বনায়নের পূর্ণতা লাভ করা গাছগুলো নিলামে বিক্রির জন্য গত বছর বনবিভাগের পক্ষ থেকে গনণা করে নাম্বারিং করা হয়েছে। কিন্তু রহস্যজনক ভাবে বনবিভাগের উদ্যোগে টেন্ডার না দেয়ার কারণে কতিপয় বনকর্মী, কাঠ চোরাকারবারি ও কিছু অংশীদার মিলে নিজেদের তত্ত্বাবধানে রাতে আধাঁরে ইতোমধ্যে অন্তত সাত শতাধিক গাছ কেটে পাচার করেছে। সাবাড় করা বনভুমি প্লট আকারে শতক হিসেবে বিক্রি করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রায় সাত’শটি গাছ নিধন হয়েছে এবং ৩ হেক্টর ৩০টি প্লট আকারে বিক্রি করায় সেখানে নতুন নতুন ঘর তৈরি হয়েছে। স্থানীয় বাজার দর অনুযায়ী প্রায় ৪৩ হেক্টর বনভুমি ও বনায়নের দাম অন্তত ৩০ কোটি টাকা। এসব বনভুমি উদ্ধারের কোন সম্ভাবনাও নেই।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ফুলছড়ি বনবিট অফিসের প্রায় এক থেকে দেড় কিলোমিটার দুরত্বে অবস্থিত ২০০৪-২০০৫ সালের ৭ হেক্টর বনায়ন এখন কালের স্বাক্ষী হিসেবে রয়েছে। সেগুলোও অরক্ষিত। অংশীদারদের অভিযোগ বনকর্মীদের অবহেলার কারণে এই ৭ হেক্টর বনায়ন ও বনভুমি অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। অবশ্য বনকর্মীদের ভাষ্য মতে নতুন ঘরবাড়ি নির্মিত ব্যক্তিদেরকে অবৈধ দখলদার বললেও তাদের বিরুদ্ধে বনবিভাগ এ পর্যন্ত আইনগত কোন ব্যবস্থা নেয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন বনকর্মী ও বনায়নের উপকারভোগী লোকজন জানান, কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগীয় বনকর্মকর্তা (ডিএফও) কেরামত আলী মল্লিক যোগদানের পর এ অঞ্চলে বনায়ন ও বনভুমি অরিক্ষিত হয়ে পড়ে। দিনদিন বনায়ন ধ্বংস ও বনভুমি দখর বেদখল, বেচা বিক্রির মতো ঘটনা ঘটে। কিন্তু জড়িত বনকর্মীদের বিরুদ্ধে কার্যকরী কোন পদক্ষেপ নেননি।
তারা আরো বলেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে চাকুরী থেকে অবসরে যাচ্ছেন এই ডিএফও। অবসর গ্রহণের আগে বনবিভাগের বারোটা বাজিয়ে যাওয়া কোন মতেই মেনে নিতে পারছেন না তারা।
ফুলছড়ি বনবিট কর্মকর্তা মোঃ হাবিবুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বনভুমি ও বনাঞ্চল রক্ষা করতে গিয়ে অবৈধ দখলদারদের সাথে অনেকবার সংঘর্ষ হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে কয়েকটি। এছাড়াও অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে বন আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে দাবী করেন তিনি। এছাড়াও ৫০ হেক্টর প্লট প্রাপ্ত উপকারভোগীদের চুক্তিনামা কেন বাতিল করা হবে না এবং ক্ষতিপূরণ কেন আদায় করা হবেনা মর্মে গত ১২ ফেব্রুয়ারি ( পত্র নং-১৭ফুলবি/১৫) কারণ দর্শানোর নোটিশ ইস্যু করা হয়েছে।
এব্যাপারে কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা কেরামত আলী মল্লিকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বনভুমি ধ্বংস ও বনভুমি বিক্রির ব্যাপারে দায় এড়িয়ে সব দোষ রেঞ্জ ও বিট কর্মকর্তার উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন।
তিনি আরো দাবী করেন, ফুলছড়ি বনবিটের অধীনে বনাঞ্চল থেকে গাছ পাচার, বনভুমি বিক্রি সহ নানান অভিযোগ লিখিত ভাবে পাওয়া গেছে। আনিত অভিযোগ তদন্তের জন্য সহকারী বন সংরক্ষককে (ফুলছড়ি) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি সরেজমিন তদন্ত করছেন বলে জানিয়েছেন এই বন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা।
পাঠকের মতামত: