শাহজাহান চৌধুরী শাহীন, কক্সবাজার ॥
প্রবল বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজার জেলার আট উপজেলায় দেড় সহ¯্রাধিক ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, চিংড়ি ঘের ও মৎস্য খামার, মুরগী ফার্মসহ ৯’শ গ্রাম প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে গ্রামীণ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার। ব্রিজ-কালভার্ট, সড়ক বিধ্বস্ত হয়ে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ায় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে দুর্গতদের।
এবারের বন্যায় জেলায় শিশুসহ ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। ইতোমধ্যে দুর্গতদের জন্য ৭ লাখ নগদ টাকা ও ১’শ মেট্্িরকটন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বার্সন কর্মকর্তা এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, দুর্গতদের জন্য বরাদ্দ ত্রাণ পর্যাপ্ত নয়।
অব্যাহত বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে বন্যার সৃষ্টি হলে ঘরবাড়ি, গবাদি পশু এবং কৃষি ফসল হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা ইউনিয়ন পাগলিরবিল এলাকার দিন মজুর জসিম উদ্দিন। ভাগ্য। পরের জমি বর্গা করে স্ত্রী, সন্তান সহ সাত সদস্যের সঞ্চয় করা ধান ভেসে গেছে। এছাড়া তার বাড়ির সকল আসবাবপত্র তলিয়ে যাওয়া সহ বসত বাড়িটি ভেঙ্গে গিয়ে মাটির সাথে একাকার হয়ে গেছে। আকুতির স্বরে তিনি বলেন, ‘বন্যার পানিতে ঘরবাড়ি, কৃষি ফসল সব ভেসে গেছে। এখন কোথায় গিয়ে দাঁড়াব। খাবারও কিছু নেই। আল্লাহ তুমি বাঁচাও।’
শুধু জসিম উদ্দিন নয়, এখন চকরিয়া, কক্সবাজার সদর, উখিয়া, টেকনাফ, পেকুয়া, কুতুবদিয়া ও রামুর প্রতিটি পরিবারের একই অবস্থা। প্রবল বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজার সদর, রামু, চকরিয়া, পেকুয়া, টেকনাফ, উখিয়া, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া উপজেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। শুক্রবার থেকে বৃষ্টি না হাওয়ায় আস্তে আস্তে নেমে যাচ্ছে পানি। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠছে ঘরবাড়ি, মাছ, কৃষি ও যোগাযোগ অবকাঠামোসহ ক্ষয়ক্ষতির ক্ষতচিহ্ন। আর উচু এলাকাসহ নিরাপদ স্থানে সরে আসা দুর্গত মানুষগুলো বাড়ি ফিরে পড়েছে চরম দুর্ভোগে।
চকরিয়া উপজেলার নিন্মাঞ্চলে এখনো নেমে যায়নি। শতাধিক গ্রামের প্রায় তিন’শ বাড়িঘর প্লাবিত হয়। এসময় পানি বন্দি থাকা হাজার হাজার মানুষকে মানবিক সহায়তা প্রদান করে উপজেলা চেয়ারম্যান, অন্যান্য জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সরকারি-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান।
মহেশখালীতে বাড়িঘর লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। টানা বর্ষনে মহেশখালীর পৌরসভা, কুতুবজোম, বড় মহেশখালী, ছোট মহেশখালী, শাপলাপুর, কালারমারছড়া, ধলঘাটা ও মাতারবাড়ি ইউনিয়নের নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় বাড়িঘর ভেঙ্গে লন্ডভন্ড, চিংড়ীঘের, পানের বরজ, গাছপালা ও বিভিন্ন প্রতিষ্টান ভেঙ্গে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান কয়েক কোটি টাকা।
রামুর হাইটুপির হারুন অর রশিদ (৬০) রাস্তায় খাটের ওপর বসে চাল শুকানোর চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, ‘বন্যায় সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। গত পাঁচ দিন ধরে কোনো রকম শুকনো খাবার খেয়ে বেঁচে আছি। এখন চালগুলো শুকিয়ে কোনো রকম রান্না করে চেষ্টা করব।’
চারমারকুল এলাকার রহিমা বেগম (৫৫) বলেন, ‘পাঁচ দিন পর ঘরে আসলাম। দেখি কিছুই নেই ঘরে। শুধু পড়ে আছে আসবাবপত্রগুলো। এখন কোনো রকম জোড়াতালি দিয়ে ঘরটা ঠিক করছি।’
কক্সবাজার সদরের জালালাবাদের রফিক সিরাজী বলেন, ‘ঘরে দুই ফুট পর্যন্ত পানি রয়েছে। কিছুই করতে পারছি না। এখন পানি সরানোর চেষ্টা করছি।’
ইসলামপুর জুম নগর এলাকার ফার্ম মালিক আবু তাহের সওদাগর জানান, প্রবল বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে অন্তত ১০ লাখ টাকার মুরগি পানিতে ডুবে মারা গেছে। তিনি এখন পুঁজি হারিয়ে নিঃশ্ব।
বাংলাবাজার এলাকার প্রবাসীর স্ত্রী খতিজা খাতুন বলেন, ‘গত তিন দিন ধরে শ্বশুর-শাশুড়ি ও সন্তানদের নিয়ে উপোস ছিলাম। বাড়িতে ফিরে এখন কোনো রকম রান্না করার চেষ্টা করছি। বেঁচে থাকতে তো হবে।’
নাইক্ষংছড়ি-কচ্ছপিয়া-দুছড়ি সংযোগ সড়কটি নদী গর্ভে প্রায় বিলীন হয়েছে। এতেকরে এখানকার বাসিন্দারা শংকিত রয়েছে। তারা দ্রুত সংযোগ সড়কের সংস্কার দাবী করেছেন।
এদিকে, টানা পাঁচ দিনের বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানালেন রামু উপজেলা চেয়ারম্যান রিয়াজ উল আলম।
তিনি জানান, রামুর ১১টি ইউনিয়নের মধ্যে ১০টি ইউনিয়নের ৬০ শতাংশ রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে। বাকি ৪০ শতাংশও মেরামত করতে হবে। এ ছাড়া কৃষি জমি, মাছের ঘের ও গবাদি পশুর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দুর্গত মানুষগুলো বাড়ি ফিরেছে। এখন তাদের সহায়তার জন্য সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তিবানদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন বলে তিনি জানান।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোঃ আলী হোসেন জানান, পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। পানি নামতে শুরু করেছে। দুর্গতদের জন্য ৭ লাখ নগদ টাকা ও ১’শ মেট্রিকটন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ৯’শটি গ্রাম প্লাবিত হয়ে বসতবাড়ি সম্পূর্ণ ও আংশিকভাবে, রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তিনি জানান, প্রাথমিকভাবে ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণ চাল ও নগদ টাকা চাওয়া হয়েছে।
কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী সবিবুর রহমান বলেন, এবার বন্যায়ও বিভিন্ন স্থানে নদীর তীর রক্ষা বাঁধ, বেঁিড়বাধ বিলীন হয়েছে। গত অর্থ বছরে মাতামুহুরী নদীর তীর রক্ষার জন্য সরকারি বরাদ্দকৃত ১ কোটি ৫০লক্ষ টাকা কাজ এবারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চলতি বছর মাতামুহুরি নদী ড্রেজিং করতে ১০৮ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের ত্রাণ শাখার তথ্য মতে, কক্সবাজারের পাঁচ দিনে পাহাড় ধস, প্লাবনে ভেসে, বিদ্যুৎ¯পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু হয়েছে শিশুসহ ১১ জনের। বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কাঁচাপাকা সড়ক, ঘরবাড়ি। এ ছাড়া তলিয়ে গেছে ফসলি জমি, চিংড়ি ঘের, মুরগী ফার্ম ও পুকুর-দীঘি।
পাঠকের মতামত: