ঢাকা,শনিবার, ৯ নভেম্বর ২০২৪

কক্সবাজার কারাগারে হাজতিদের ভরসা কারা হাসপাতাল : ধারণ ক্ষমতার ৮ গুণবন্দি

শাহজাহান চৌধুরী শাহীন, কক্সবাজার ::

কক্সবাজার জেলা কারাগারে গিজ গিজ করছে ধারণ ক্ষমতার ৮ গুণ বেশী বন্দি। ৫৩০ জন ধারণ ক্ষমতার কারাগারে রয়েছে এখন ৪ হাজার ১’শ জন বন্দি। এতে কারা কর্তৃপক্ষ যেমন দর্শনার্থী আত্মীয় স্বজনদের ভীষণ চাপে রয়েছেন, তেমনি ভোগান্তিরও শেষ নেই দর্শনার্থীদের।

কারাগারে বন্দিদের সাথে দেখা করতে আসা স্বজনদের টাকার বিনিময়ে ভিআইপি পাস দেওয়া, জামিননামা আটকে টাকা আদায়,শীর্ষ অপরাধীদের জামিন লুকিয়ে রাখা ও ইয়াবা ব্যবসায়ীদেরকে কারা হাসপাতাল সিট ভাড়া দেয়ার অভিযোগ উঠেছে কক্সবাজার জেলা কারা হাসপাতালের ফার্মাসিষ্ট ফখরুল ও কারা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।আর অবৈধ আয়ে পাহাড় গড়ছে কারা হাসপাতাল ফার্মাসিষ্ট ফখরুল সহ কারাগার কর্তৃপক্ষ। পুলিশ, আইনজীবী ও কারামুক্তদের দাবি, এই কারাগারে বিভিন্নভাবে চলছে রমরমা বাণিজ্য! এ কারণে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন বন্দিদের দেখতে আসা সাধারণ মানুষ।

কক্সবাজার জেলা কারাগারে বন্দি ধারণ ক্ষমতা রয়েছে ৫৩০ জন। জেলায় ইয়াবা কারবারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসন হার্ড লাইনে চলে যাওয়ায় চিহ্নিত, প্রতিষ্ঠিত ও স্বরাষ্টমন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারীরা জেলখানাকে নিরাপদ মনে করে বিভিন্ন মামলায় আদালতে আত্মসর্ম্পন করেন। আদালত ইয়াবা কারবারীদের জামিন না মঞ্জুর করে কারাগারে পাঠান। এধরনের ইয়াবা কারবারী অন্তত আড়াই শতাধিক ব্যক্তি কক্সবাজার জেলাকারাগারে রয়েছেন। আবার অনেক কারবারী বিদেশেও পাড়ি জমিয়েছে। গত কয়েক মাস আগে কারাগারে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অন্তত ৫গুন বন্দি থাকলেও বর্তমানে তা ৮ গুনে দাড়িয়েছে।

গত জাতীয় নির্বাচনের আগে নাশকতা মামলা সহ বিভিন্ন মামলার আসামী গ্রেফতার অভিযান চালানোর কারণে বর্তমানে বন্দিও সংখ্যা দাড়িয়েছে ৪ হাজার ১’শ জনে। তৎমধ্যে নারী রয়েছে ২২৫ জন ও শিশু রয়েছে ৪৫ জন। বন্দি সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষকে। কিছু কিছু বন্দিকে রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছে। এই স্থানান্তর নিয়েছে রয়েছে বাণিজ্যের অভিযোগ। দুই ধরনের বন্দিকে ভিন্ন জেলায় স্থানান্তর করা হচ্ছে। এদের মধ্যে রয়েছে যারা টাকা দেয় অথবা দিতে পারে না এমন বন্দি। কারাগারে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশী বন্দি থাকার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বাণিজ্যে মেতেছেন কারা হাসপাতাল ফার্মাসিষ্ট ফখরুল ও কারা কর্তৃপক্ষ।

কারাগার থেকে সদ্য জামিনে আসা অনেকের অভিযোগ, জামিনপ্রাপ্ত আসামির স্বজনদের কাছ থেকে টাকা আদায় না হওয়া পর্যন্ত জামিননামা আটকে রাখা হচ্ছে। সবশেষ গত ৪ জানুয়ারি বিকালে স্বজনদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের পর জামিননামা আটকে রাখা এক আসামিকে কারাগার থেকে ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কক্সবাজার জেলা জজ আদালতের আইনজীবী আবুল কাশেম জানান, পারিবারিক মামলায় একজন আসামী গ্রেপ্তার হয়ে প্রায় ছয় মাস কক্সবাজার কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন।

কক্সবাজার জেলা জজ আদালতে থেকে ওই আসামী জামিন পান। ওইদিন দাফতরিক কাজের সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় জামিননামা পাঠানো সম্ভব হয়নি কারাগারে। এর পরদিন আদালতের জামিন আদেশটি দাফতরিক সংশি¬ষ্ট নিয়মমাফিক অনুসরণ করে কারাগারে পাঠানো হয়।

আইনজীবী আবুল কাশেম আরও নিশ্চিত করেন, আসামির স্বজনরা অভিযোগ করেছেন, কারা কর্তৃপক্ষকে টাকা না দেওয়ায় মোহাম্মদ আলমকে একদিন পর্যন্ত মুক্তি দেয়নি। পরে কারা কর্তৃপক্ষের সংশি¬ষ্ট ব্যক্তির কাছে টাকা দেওয়ার পর ওইদিন বিকাল ৪টার দিকে আসামিকে জামিনে ছাড়া হয়।

আসামি মোহাম্মদ আলমের আইনজীবী আবুল কাশেম বলেন, ‘আদালতের আদেশনামা দাফতরিক সময়সূচির মধ্যে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছানো মাত্রই সংশি¬ষ্ট আসামিকে ছেড়ে দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ টাকা না দেওয়ায় দীর্ঘ ছয় ঘণ্টার বেশি আসামিকে আটকে রাখে।’

এমন ঘটনাকে আদালতের আদেশনামার প্রতি কারা কর্তৃপক্ষের অবজ্ঞা প্রদর্শন বলে মন্তব্য করেন এই আইনজীবী। তবে আদালতের আদেশনামার সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার জন্য অনেক ক্ষেত্রে আসামিকে ছাড়তে সময়ক্ষেপণ হতে পারে বলেও জানান তিনি। এধরনের ঘটনা প্রতিদিনই অহরহ ঘটছে জেলা কারাগারে।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন কক্সবাজার জেলা কারাগারের জেল সুপার মো. বজলুর রশিদ আখন্দ বলেন,আদালতের আদেশে জামিন পাওয়া আসামিকে টাকা না দেওয়ায় আটকে রাখার বিষয়ে আমি অবহিত নই। তবে খোঁজ-খবর নিয়ে সংশিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

তিনি আরো বলেন, কারাগার থেকে জামিনপ্রাপ্ত দাগী ও চিহ্নিত আসামিদের ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু সংশিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা মানছে না বলে অভিযোগ রয়েছে খোদ পুলিশের। এ কারণে জামিনপ্রাপ্ত চিহ্নিত অপরাধীরা পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতে না থাকায় কারাগার থেকে বেরিয়ে আবারও ইয়াবা কারবারসহ ছিনতাই ও বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে।

অভিযোগ রয়েছে, টাকার বিনিময়ে এসব দাগী ও চিহ্নিত অপরাধীদের ছেড়ে দেয়ার ঘটনা ঘটছে কক্সবাজার কারাগারে। গত এক মাসে জামিন পাওয়া অন্তত ডজনখানেক দাগী ও চিহ্নিত অপরাধীকে কক্সবাজার কারা কর্তৃপক্ষ পুলিশকে না জানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে।

শুধু এসব অনিয়মই নয়, সদ্য কারামুক্ত অনেকেই জানিয়েছেন, কারাগারে হাজার হাজার টাকার সিট বাণিজ্য চলছে। এছাড়াও কারা হাসপাতালের রোগীর সিটগুলো হোটেল কক্ষের সিটের মতো প্রতিমাসে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা ভাড়া দেয়া হচ্ছে। তাদের দাবি টাকা দিলে কারা হাসপাতালের সিটে মাসের পর মাস থাকা যায়। আর টাকা না দিলে ফ্লোরেও রোগীদের সিট পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

অভিযোগ রয়েছে, কারা হাসপাতালে একজন চিকিৎসক ও একজন ফার্মাসিষ্ট রয়েছে। প্রায় সময় নিয়োজিত চিকিৎসক কারা হাসপাতালে না থাকায় বন্দিদেও চিকিৎসার দেখভাল করেন ফার্মাসিষ্ট ফখরুল আজম। গত ৭ বছর ধরে একই স্থানে কর্মরত থাকায় এই ফার্মাসিষ্ট ফখরুল কারা হাসপাতালকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্টানে পরিণত করেছে। প্রতি মাসে দাগী অপরাধী, ইয়াবা কারবারী, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাদেরকে হাসপাতালের সি ভাড়া দিয়ে প্রতি মাসে অন্তত ৩০ লাখ টাকা আয় করছেন। তবে তিনি এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, কারা হাসপাতালে ৩০ শয্যায় ৩০ জনের স্থলে বর্তমানে ২’শ জন রোগী ভর্তি আছে। একই কথা জানালেন জেল সুপার বজলুল রশিদ আখন্দ।

এছাড়া স্বজনরা বন্দিদের দেখতে এলে টাকা গুনতে হয় বলে অভিযোগ আছে। জেলা কারাগারের অফিসের জানালা দিয়ে স্বজনরা কথা বলার সুযোগ পান ভিআইপি পাস নিয়ে। এক্ষেত্রে প্রত্যেকের কাছ থেকে ১ হাজার টাকা থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করছে জেল কর্তৃপক্ষ।

 

পাঠকের মতামত: