ঢাকা,সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

আলোচিত সিনহা হত্যা মামলার আনুষ্ঠানিক সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু

ওসি প্রদীপ-লিয়াকতসহ সকল আসামীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি

এম.এ আজিজ রাসেল ::
আলোচিত মেজর (অব:) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার ১ম দিনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। সোমবার (২৩ আগস্ট) সকাল ১০টা থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়ে শেষ হয় বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে। আদালতে ৩জন সাক্ষী উপস্থিত থাকলেও প্রথমদিন এক নম্বর সাক্ষী মামলার বাদী ও নিহত সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইলের আদালতে জবানবন্দি দেন। মামলার রাষ্ট্র পক্ষের আইনজীবী ও কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি (পাবলিক প্রসিকিউটর) এডভোকেট ফরিদুল আলম, অতিরিক্ত পিপি এডভোকেট মোজাফফর আহমদ, এপিপি ও জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট জিয়া উদ্দিন আহমদ শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস এর সাক্ষ্য গ্রহণ করেন।
এসময় আসামীপক্ষের আইনজীবীরা তাকে জেরা করেন। সাক্ষ্য গ্রহণকালে মামলার ওসি প্রদীপসহ ১৫ জন আসামীও আদালতের কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন। তবে মামলার প্রধান আসামী এসআই লিয়াকত আলী ও দুই নাম্বার আসামী ওসি (বরখাস্ত) প্রদীপ কুমার দাশের আইনজীবীরা জেরা করবেন মঙ্গলবার (২৪ আগস্ট)।

মামলার বাদী ও নিহত সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস সাংবাদিকদের জানান, ‘প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে বিস্তারিত বিবরণ জেনে ২০২০ সালের ৫ আগস্ট আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। আজকে মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের প্রথমদিনে আমি মূলত জবানবন্দি দিয়েছি। আমাকে বিভিন্ন আসামীদের আইনজীবীরা আমাকে জেরা করেছে। আমি তাঁর জবাব দিয়েছি। এটি পূর্ব পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। ওসি প্রদীপ—লিয়াকতসহ সকল আসামীদের সবোর্চ্চ শাস্তি দাবি করছি। আশা করছি আমি ন্যায় বিচার পাবো।’

মামলার আসামী পক্ষের আইনজীবী এড. রানা দাশ গুপ্ত বলেন, ‘মেজর (অব.) সিনহা হত্যা মামলার রাষ্ট্র পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছে। মামলার বাদি মেজর সিনহার বড়বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস ১ নম্বর সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন। অন্য আসামীদের আইনজীবীরা তাদের জেরা শেষ করেছে। তবে ওসি প্রদীপ ও এসআই লিয়াকতের জেরা হবে মঙ্গলবার।’

এর আগে কড়া নিরাপত্তায় কক্সবাজার জেলা কারাগার থেকে ওসি প্রদীসসহ ১৫ জন আসামীকে ১০টার দিকে আদালতে হাজির করা হয়। তাদের আনার পর আদালত চত্বরে হাজারো উৎসুক জনতা ভীড় করে। বিকালে আসামীদের নিয়ে যাওয়ার সময় সাধারণ মানুষ ওসি প্রদীপসহ সকল আসামীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে নানা শ্লোগান দিতে দেখা যায়। সকালে কোর্ট বিল্ডিং চত্বরে একই দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশে করে ওসি প্রদীপের হাতে নির্যাতিতদের স্বজনেরা।

এর আগে আদালতে সমন দেওয়া ৫ জন সাক্ষীর মধ্যে ৩ জন সাক্ষী যথাক্রমে বাদী শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস, পিতা—বীর মুক্তিযোদ্ধা এরশাদ খান, টেকনাফের শামলাপুরের ডা. মৃত ফজল করিমের পুত্র মোঃ আবদুল হামিদ এবং শামলাপুরের মৃত নুরুল ইসলামের পুত্র মোঃ ইউনুচ সমন পেয়ে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য সোমবার সকালে আদালতে হাজিরা দেন। সোমবার সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আদালত থেকে সমন দেওয়া সাক্ষী মেজর (অব:) সিনহার ‘জাস্ট গো’ ডকুমেন্টারি টিমের সদস্য সাহিদুল ইসলাম প্রকাশ সিফাত, টেকনাফের মিনাবাজারের কাজী ঠান্ডা মিয়ার পুত্র মোহাম্মদ আলী অনুপস্থিত ছিলেন। সোমবার হাজিরা দেওয়া বাকী ২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যও আদালতে নেওয়া হবে।

আদালতে শুরু হওয়া সাক্ষ্য গ্রহন একটানা আরো ২ দিন ২৪ ও ২৫ আগস্ট, যথাক্রমে মঙ্গলবার ও বুধবারও চলবে। মামলাটির চার্জসীটভুক্ত প্রথম ১৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহনের জন্য আদালত থেকে সমন দেওয়া হয়েছে বলে জানান কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সেরেস্তাদার নুরুল কবির। প্রতিদিন ৫ জন করে সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করার কথা রয়েছে।

কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সিনিয়র বেঞ্চ সহকারী (পেশকার) সন্তোষ বড়ুয়া জানান, চলতি বছরের গত ২৭ জুন কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল মামলাটির চার্জ গঠন করে সাক্ষ্য গ্রহনের দিন ধার্য্য করে আদেশ দিয়েছিলেন। তিনি আরো জানান, এ মামলায় ৮৩ জন চার্জসীট ভুক্ত সাক্ষী রয়েছে।

চলতি বছরের গত ২৭ জুন ফৌজদারী দন্ডবিধির ৩০২/২০১/১০৯/ ১১৪/১২০—খ/ ৩৪ ধারায় সকল আসামীর উপস্থিতিতে মামলাটির চার্জ গঠন করা হয়। তার আগে গত ১০ জুন আসামি বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কক্সবাজার জেলা কারাগারে নিয়ে আসা হয়।

২০২০ সালের ৩১ জুলাই ঈদুল আজহার আগের রাত সাড়ে সাড়ে ৯টার দিকে কক্সবাজার—টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশ কর্মকর্তা লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। হত্যার পাঁচদিনের মাথায় ৫ আগস্ট সিনহার তাঁর বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে টেকনাফ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশসহ ৯ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। যার মামলা নম্বর : এসটি—৪৯৩/২০২১ ইংরেজী। যার জিআর মামলা নম্বর : ৭০৩/২০২০ ইংরেজি। যার টেকনাফ মডেল থানা মামলা নম্বর : ৯/২০২০ ইংরেজি।

মামলায় প্রধান আসামি করা হয় বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে। ওসি (বরখাস্ত) প্রদীপ কুমার দাশকে করা হয় দুই নম্বর আসামি। মামলার তিন নম্বর আসামি করা হয় টেকনাফ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দদুলাল রক্ষিতকে। আদালত থেকে মামলাটির তদন্তভার দেওয়া হয় র‌্যাব—১৫ কে।

এরপর আসামি ৭ পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পরে তদন্তে নেমে হত্যার ঘটনায় স্থানীয় ৩ জন, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) ৩ সদস্য এবং প্রদীপের দেহরক্ষীসহ আরো মোট ৭ জনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। গত ২৪ জুন মামলার চার্জশীটভুক্ত আসামী কনস্টেবল সাগর দেব আদালতে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে আলোচিত এই মামলার ১৫ আসামির সবাই আইনের আওতায় আসে।

এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় চার মাসের বেশি সময় ধরে চলা তদন্ত শেষে গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর ৮৩ জন সাক্ষী সহ আলোচিত মামলাটির অভিযোগপত্র দাখিল করেন র‌্যাব—১৫ এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম। ১৫ জনকে আসামি করে দায়ের করা অভিযোগপত্রে সিনহা হত্যাকান্ডকে একটি ‘পরিকল্পিত ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

মামলায় কারাগারে থাকা ১৫ আসামি হলো: বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, দেহরক্ষী রুবেল শর্মা, টেকনাফ থানার এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, কনস্টেবল সাগর দেব, এপিবিএনের এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজীব ও মো. আবদুল্লাহ, পুলিশের মামলার সাক্ষী টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মো. নিজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন।

পাঠকের মতামত: