ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

টেকনাফ থানার বহুল আলোচিত বরখাস্ত হওয়া

ওসি প্রদীপ কুমার দাশ এ কি বললেন!

:: এম.আর মাহমুদ ::

প্রদীপ কুমার দাশ। কক্সবাজারের টেকনাফ থানার এক সময়ের প্রতাপশালী ওসি ছিলেন। সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান কে গুলি করে হত্যার পর গ্রেফতার হয়ে শ্রীঘরে দিনাতিপাত করছে।

ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস মাত্র ৪০ দিন আগেও পুরো টেকনাফের ছিল তার রাম-রাজত্ব। টেকনাফের শিশু থেকে বৃদ্ধ বনিত ছিল তার ফার্মের খাঁচা বন্দী মুরগী। যখন যা খুশি তা-ই করেছে। তার শিকার থেকে রক্ষা পায়নি উখিয়ার আলোচিত বখতিয়ার মেম্বারও।

একে একে তার নেতৃত্বে প্রাণ দিয়েছে ২০৪ জন। সর্বশেষ কুরবানি ঈদের আগের রাত তার সহযোদ্ধা পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীর গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে চৌকষ সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। এ ঘটনার পর প্রদীপ ও লিয়াকতের গণেশ উল্টে গেছে।

টেকনাফবাসী অন্তত একজন কৃত্রিম মানুষরূপী আজরাঈলের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। মেজর রাশেদ খানকে গুলি করে হত্যার পর তার বোন বাদী হয়ে আদালতে মামলা করলে আদালত মামলাটি নিয়মিত মামলা হিসেবে টেকনাফ থানায় রেকর্ড করার নির্দেশনা দেয়ার পর বেশ ক’জন পুলিশ আটক হয়। এ চাঞ্চল্যকর মামলাটি র‌্যাব-১৫ তদন্ত করছে। তদন্তকারী সংস্থা অভিযুক্তদের রিমান্ডে নিয়ে ৯৯ ভাগ সফলতা পেলেও নাটেরগুরু প্রদীপ ১৫ দিন রিমান্ডে থাকার পরও স্বীকারোক্তি দিতে রাজি হয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি ইতিমধ্যে অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। তবে প্রতিবেদনে কি আছে তা এখনও কেউ দেখেনি। ঢাকার একটি শীর্ষ দৈনিকে প্রদীপের কিছু কথা উল্লেখ করে বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। তদন্ত কমিটি তার কাছে জানতে চেয়েছে তার সহকর্মী পরিদর্শক লিয়াকত আলী কোন মানের কর্মকর্তা। প্রদীপ জবাব দিয়েছে সে মধ্যম মানের। তবে পরিদর্শক লিয়াকত আলী নাকি “ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে ঘাস খায়”। তদন্ত কমিটি তার কাছে জানতে চেয়েছে বন্দুক যুদ্ধে সে নিজে থাকত কিনা। প্রদীপ জবাব দিয়েছেন, তিনি নিজেই নেতৃত্ব দিতেন। তবে বন্দুক যুদ্ধে সরকারি অস্ত্র ব্যবহার করতেন না। তার নিজস্ব মূল্যবান রিভলবার ব্যবহার করতেন। কেন করতেন জানতে চাইলে সে বলেছেন, সরকারি অস্ত্র ব্যবহার করতে ভালো লাগে না। প্রদীপ শুধু সাহসী নয়, সে দুঃসাহসী বটে। প্রদীপ সেনা কর্মকর্তাদের স্যার সম্বোধন করতেন না।

এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটি জানতে চাইলে প্রদীপ পরিষ্কার জবাব দিয়েছেন, স্যার সম্বোধনে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। তদন্ত কমিটির সামনে প্রদীপ যেভাবে কথা বলেছেন, তা শুনে মনে হয়েছে পুলিশে তার চাইতে বড় কোন কর্মকর্তা নেই। ওসি প্রদীপ টেকনাফবাসীর জন্য একটি আতঙ্কের নাম। তবে তার এমন পতন স্বপ্নেও কোনদিন ভাবেনি। টেকনাফের একজন ভদ্র লোক (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) কথা প্রসঙ্গে বলতে শুনেছি, অপরাধীসহ নিরাপরাধীও তার ভয়ে শংকিত থাকত। ছোট শিশুরাও তার নাম শুনলে বালিশ ছাড়া ঘুমিয়ে পড়ত।

প্রদীপের এসব অপকর্মের দায় সমগ্র পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের হজম করতে হচ্ছে। অথচ পুলিশের অনেক ভাল দিক আছে। যা মানুষ কোনদিনই ভুলবে না। বিশেষ করে করোনাকালে পুলিশের মহানুভবতা মানুষ দেখেছে। এছাড়া স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পুলিশ গৌরবময় ভূমিকা ইতিহাস থেকে কোনদিনই মুছে ফেলা যাবে না। একজন প্রদীপের কারণে সমগ্র পুলিশ বাহিনী আজ অনেকটা হতাশ। ১৮৬১ সালে পুলিশ বাহিনী সৃষ্টি হওয়ার পর এত দুষ্কর্মের অপবাদ সহ্য করতে হয়নি পুলিশ বাহিনীকে। দেশের বেশিরভাগ মানুষ টেকনাফের সাবেক ওসির অপকর্মের কথা শুনেছে ও জেনেছে। এক্ষেত্রে তার মত একজন পুলিশ অফিসারের বেপরোয়া আচরণ ও কর্মকান্ডের কারণে পুলিশ বাহিনীর শীর্ষ অনেক কর্মকর্তা বিতর্কের জালে জড়িয়ে পড়ছে। পড়ার যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। প্রদীপের মতো লাগামহীন পুলিশ কর্মকর্তার লাগাম যথাসময়ে না টানার কারণে আজ পুলিশের এ বিপর্যয়। প্রতিদিনই প্রদীপসহ বিভিন্ন থানার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আদালতে একের পর এক মামলা দায়ের হচ্ছে। মামলাগুলো বিভিন্ন সংস্থাকে তদন্তের দায়িত্ব দিচ্ছে আদালত। তবে এসব মামলার কিছু কিছু সত্যতা থাকলেও কিছু কিছু মামলার পুলিশকে পরিকল্পিতভাবে ঘায়েল করার জন্য অপরাধী চক্র অর্থায়ন করছে বলেও শোনা যাচ্ছে। তবে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তির মামলা করার অধিকার রয়েছে। সাংবাদিকতার সুবাধে এক সময় পার্বত্য বান্দরবান জেলার লামায় অবস্থান করতাম। সে সময় দেখতাম কোন কারণে পাহাড়ের চূড়ায় বসবাসরত মুরং সম্প্রদায়ের পাড়ায় আগুন লাগলে ওই সম্প্রদায়ের লোকজন নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে গণনা করতে থাকত এ বাড়ির পর ওই বাড়ি পুড়ে যাবে। কিন্তু তারা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার কোন চেষ্টা করত না। কারণ পাহাড়ের চূড়ায় তৈরী করা টংঘরের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার উপকরণ তাদের নেই। জানি না হাতে গোনা কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার অপকর্মের কারণে পুরো পুলিশ বাহিনী যদি ভেঙ্গে পড়ে দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষা হবে কিভাবে? ছোটখাট ইয়াবা পাচারকারীরা এখন অনেকটা নিরাপদ। সীমান্ত রক্ষায় নিয়োজিত বিজিবি ও র‌্যাবের হাতে বড় বড় ইয়াবার চালান ধরা পড়লেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাচারকারীরা অধরায় রয়ে যাচ্ছে। প্রদীপ ও লিয়াকত নন্দলালসহ পুলিশের অনেক সদস্য কারাগারে রয়েছে। তারা নাকি রাজার হালে দিন কাটাচ্ছে। প্রদীপ কারাগারে, তার স্ত্রী পলাতক, ব্যাংক একাউন্ট ফ্রিজ। তারপরও তার জন্য কারা অর্থ যোগান দিচ্ছে? এর পিছনে রাঘব বোয়ালেরা জড়িত। বেশ ক’জন বিজ্ঞ আইনজীবীরা তার মামলায় জামিন চাওয়ার জন্য আদালতে দৌঁড়-ঝাপ শুরু করেছে। আদালত থেকে প্রিজনভ্যানে করে কারাগারে নিয়ে যাওয়ার সময় মোবাইলে কথা বলার দৃশ্য ভাইরাল হয়েছে। তার স্যারকে বার বার বলতে শোনা গেছে, তাদেরকে র‌্যাব নির্যাতন করেছে। অথচ সে কি করেছে তা তার স্মরণ নেই। কথা প্রসঙ্গে না বললে হয় না, তার দাম্বিকতার সুরে কথা বলার কারণ নিশ্চয়ই আছে। কারো কাছে তর্কিত কারো কাছে নন্দিত যুদ্ধাপরাধ মামলায় মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত মরহুম সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী আদালত ভবনে ফাঁসির রায় শুনে হাসতে দেখে একজন সংবাদকর্মী জানতে চেয়েছিলেন, ‘লিডার আপনি হাসছেন কেন? ক’দিন পরে আপনার মৃত্যুদন্ড কার্যকর হবে, সে দিন কাড়গড়ায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘ধর্ষণ যখন অনিবার্য প্রতিবাদ করার চাইতে উপভোগ করাই শ্রেয়।’ মনে হচ্ছে প্রদীপের অবস্থাও অনুরূপ হতে যাচ্ছে।

লেথক:  এম.আর মাহমুদ, দৈনিক সমকাল চকরিয়া প্রতিনিধি।

সভাপতি -চকরিয়া অনলাইন প্রেসক্লাব, চকরিয়া. কক্সবাজার।

পাঠকের মতামত: