কক্সবাজার প্রতিনিধি ::
কক্সবাজার-৩ (সদর-রামু-ঈদগাঁও) আসনের সংসদ-সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমলের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম-দুর্নীতি, সরকারি জমি দখল, জ্ঞাতআয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনসহ রয়েছে নানা অভিযোগ। শুধু তাই নয়, বন ও পাহাড়খেকোদের সহযোগিতা, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে জামায়াত-বিএনপির নেতাদের গুরুত্ব দিয়ে জনপ্রতিনিধি করাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া নিজস্ব বাহিনী দিয়ে এলাকায় নৈরাজ্য, শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে মারধর-হুমকি প্রদর্শনসহ বিভিন্ন অপকর্মের ঘটনায় সমানভাবে সমালোচিত এই সংসদ-সদস্য (এমপি)। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের অভিযোগ-এমপি কমল জনবিচ্ছিন্ন একজন জনপ্রতিনিধি। প্রতিনিয়ত দলীয় সিদ্ধান্তের বিপক্ষে অবস্থান, সরকারের বিপক্ষে কথা বলে আলোচনায় এসেছেন তিনি। তার নানা বিতর্কিত কর্মের কারণে আগামী জাতীয় নির্বাচনে এ আসনটি আওয়ামী লীগের হাতছাড়া হতে পারে-এমন শঙ্কাও তাদের।
রামু উপজেলা চেয়ারম্যান ও রামু উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সোহেল সরওয়ার কাজল বলেন, এমপি কমল সাহেব টিআর/কাবিখা/কাবিটা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে জনগণের কল্যাণে কাজ করার জন্য সরকার কর্তৃক বরাদ্দের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এজন্য আমরা জনপ্রতিনিধিরা দীর্ঘদিন ধরে কোনো বরাদ্দ পাই না। পৈতৃকভাবে এমপি কমল মাত্র দেড় কানির মতো জমি পেয়েছিলেন। কিন্তু এখন তিনি হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এসব জনগণের টাকা মেরে সম্পদ গড়েছেন।
তার আরও অভিযোগ-এমপি সাহেব স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দিরে গিয়ে লাখ লাখ টাকা বরাদ্দ ও দান করার ঘোষণা দিয়ে বাহবা নেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কোনো টাকা দেওয়া হয় না। এটা বড় ধরনের প্রতারণা বলেও মন্তব্য করেন সোহেল সরওয়ার কাজল।
রামু উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামশুল আলম মন্ডল জানান, দুই মেয়াদে এমপি হওয়ার সুবাদে সাইমুম সরওয়ার কমল যেন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছেন। অনিয়ম ও দুর্নীতি করে অর্থ ও অঢেল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন। জামায়াত-বিএনপির সঙ্গে আঁতাত করে দলের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করছেন। তার অনুসারীদের দিয়ে সাধারণ মানুষের জমি দখল ও চাঁদাবাজির ফলে এলাকায় দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে প্রার্থী নির্বাচনে ভুল করা হলে আসন হারানোর সম্ভাবনা দেখছেন এই নেতা।
এছাড়া কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, রামুতে পাহাড়খেকো ও বনখেকোদের কোনো ডাম্পার (মিনি ট্রাক) জব্দ বা অভিযান গেলে সেখানে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে বসেন এমপি কমল। তার উসকানিতে বনকর্মীদের ওপরে হামলার ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে।
উল্লিখিত সব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার ৩ আসনের এমপি সাইমুম সরওয়ার কমল বলেন, ‘দিনের ৩টার সময় ঘুম থেকে উঠা মানুষগুলো আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ করে বেড়ান। আমি তো মানুষকে সেবা করার জন্য ভোরে ঘুম থেকে উঠি। তাই মানুষের উন্নয়ন নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ হয় আমার।’
কমল তার দুই মেয়াদে খুরুশখুল আশ্রয়ণ প্রকল্প, রামু বিকেএসপি, রেললাইন, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, রাস্তাঘাট নির্মাণসহ অভাবনীয় ও উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন করেছেন বলে দাবি করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৮ সালে নতুন মুখ হিসাবে আওয়ামী লীগ তথা নৌকার মনোনয়ন পাওয়ায় স্থানীয় রাজনীতি ও ভোটের মাঠে নয়া দৃশ্যপটের উদ্ভব হয়। আওয়ামী লীগের জয়জয়কারের ওই নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী লুৎফর রহমান কাজলের কাছে পরাজিত হন। ওই নির্বাচনে প্রায় ৪০ হাজার ভোটে পরাজিত হন কমল। যেখানে লুৎফুর রহমান কাজল পেয়েছিলেন ১ লাখ ২৬ হাজার ৪৭৮ ভোট। ওখানে কমল পেয়েছিলেন ৮৬ হাজার ৪৩৬ ভোট।
টাকার অভাবে নির্বাচনি ব্যয় বহন করতে হিমশিম খাওয়া সাইমুম সরওয়ার কমল নির্বাচনে পরাজিত হলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের পরিচালক করা হয় তাকে। আর এতেই ভাগ্য যেন সুপ্রসন্ন হয়ে ধরা দেয়। বদলে যায় তার জীবনের গতিপথ।
পরে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়ে একে একে দুবার এমপি হন। এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর আর থেমে থাকেননি। জড়িয়ে পড়েন অনিয়ম-দুর্নীতিতে। ক্ষমতার প্রভাব ও স্বেচ্ছাচারিতায় এলাকার মানুষের কাছে তিনি এখন মূর্তিমান আতঙ্ক। নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলে জমি দখল করারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রামুর রশিদ নগরে মহাসড়কের পাশে কক্সবাজার ক্রীড়া ও কারিগরি কলেজের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দখল করে নিয়েছেন শতকোটি টাকা মূল্যের সরকারি মূল্যবান জমি। দখলকৃত ওই জমির পেছনভাগে খণ্ড খণ্ড করে দখল বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সরকারি একটি সংস্থার দেওয়া তথ্য বলছে, পৈতৃক বাড়ি ছাড়া আর কোনো বাড়ি ছিল না কমলের। আর এখন ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ছাড়াও নিজ এলাকার সব জায়গাতেই তার সম্পদ। কক্সবাজারে গড়েছেন আলিশান সুরম্য প্রাসাদ ওসমান ভবন, যেটি সবার কাছে ব্যাপক পরিচিত। দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা না থাকলেও এমপি হওয়ার সুবাদে বিগত ১০ বছরে তার সম্পদ বেড়েছে কয়েকশ গুণ।
আরও জানা গেছে, রামু বাইপাস এলাকায় জমি কিনে গড়েছেন মার্কেট, জোয়ারিয়ানালায় মহাসড়কের পাশে কিনেছেন ৩ একর জমি। এছাড়াও নামে-বেনামে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়।
এদিকে গত ১০ বছরে এমপি সাইমুম সরওয়ার কমলের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, দুদকসহ বিভিন্ন মহলে অভিযোগ করেও অপকর্মের তদন্ত না হওয়ায় ক্ষোভ রয়েছে তার নির্বাচনি এলাকায় সাধারণ মানুষের।
অভিযোগ আছে, এমপি কমল স্থানীয় প্রশাসনকে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে ইচ্ছেমতো নিজের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। এমনকি তার রক্তচক্ষুর কবল থেকে বাদ পড়েনি বিচারক (জজ) পর্যন্ত। সম্প্রতি অন্যের জমি দখলের ঘটনায় তার রাজনৈতিক অনুসারী রামু উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক তপন মল্লিক গংদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার আইনে একটি মামলার ঘটনায় বিচারকের বিরুদ্ধে হুমকি ও আপত্তিকর মন্তব্য করে বিতর্কিত হয়েছেন। এছাড়া রামুর প্রবীণ শিক্ষক সুনীল শর্মাকে জনসম্মুখে মারধর করে সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন। আলোচিত বাঁকখালী নদী দখল উচ্ছেদের ঘটনায়ও প্রকাশ্যে তিনি দখলদারের পক্ষাবলম্বন করে সরকারি কাজে বাধা দিয়েছেন। এমনকি তার রক্তচক্ষু থেকে রেহাই পাননি সাংবাদিকও। তার বিপক্ষে গেলে অন্যায় অপদস্ত ও লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছে। একটি নিউজের সূত্র ধরে কক্সবাজারের প্রবীণ সাংবাদিক তোফায়েল আহমদকেও হুমকি ও অপদস্ত করতে পিছপা হননি এমপি কমল।
আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি-মাদক ব্যবসায়ীর সঙ্গে রয়েছে এমপি কমলের দহরম-মহরম। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রাণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারি রামুর খুনিয়া পালংয়ের মোস্তাক আহমদ প্রকাশ ইয়াবা মোস্তাক ও চাকমারকুলের ইয়াবা ডন সাইদুল হোসেনের সঙ্গে তার সখ্য মানুষের মুখে মুখে। তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় নির্বিঘ্নে মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। সম্প্রতি তালিকাভুক্ত সদরের পিএম খালীর রাজাকার ফায়জুল্লাহর পুত্র মোহাম্মদ মুসলেমকে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের উল্লেখ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির সুপারিশ করতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি।
আওয়ামী লীগ সমর্থিত এক ইউপি চেয়ারম্যান জানান, সংসদ-সদস্য কমলের বির্তকিত কর্মকাণ্ডের ফলে আওয়ামী রাজনীতি আজ দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বেড়াজালে নিপতিত। স্থানীয়ভাবে নিজের আধিপত্য ও বলয় প্রতিষ্ঠার লক্ষে আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে সখ্য করার বিষয়টিও বেশ আলোচিত। আওয়ামী লীগের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টিতে প্রতিনিয়ত নানা অপতৎপরতায় লিপ্ত। বিগত ইউপি নির্বাচনে রামুর এগার ইউনিয়ন ও সদর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ সমর্থিত নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিএনপি-জামায়াত প্রার্থীদের বিজয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছেন।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি, প্রশাসনের লোকজনকে জিম্মি করে রেখেছেন কমল। এ কারণে এমপির বিরুদ্ধে বর্তমানে কেউ কথা বলার সাহস করেন না। প্রতিবাদ করলেই সর্বনাশ। বিভিন্ন মামলার আসামি হতে হয়েছে। বহু লোক মিথ্যা মামলার বোঝা নিয়ে বর্তমানে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। এমপি কমলের এসব বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে এলাকায় দল ও সরকারের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন্ন হয়েছে। যা আসন্ন সংসদ নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা আছে। সুত্র: যুগান্তর
পাঠকের মতামত: