আলহাজ্ব মাস্টার আবুল কাসেম মিয়ান শুধু একটি নাম নয়, একটি বর্ণাঢ্য ইতিহাস। ১৯২৭ সালে কক্সবাজার সদর খুরুশকুলের তেতৈয়া গ্রামে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে আবুল কাসেম মিয়ানের জন্ম। বাবা মরহুম কালা মিয়া সিকদার, মা মরহুমা শামশাদ খাতুন। আবুল কাসেম মিয়ানের তিন পুত্র জাহাঙ্গীর কাসেম, তানভীর কাসেম, খুররম কাসেম প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। তাছাড়া মরহুমের ৬ মেয়েও স্বস্ব অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত।
মাস্টার আবুল কাসেম মিয়ান একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এবং সরকারের বড় মাফের আয়কর দাতা ছিলেন। আদর্শিকভাবে তিনি আজীবন আপোষহীন ছিলেন। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তিনি মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া জীবনে কারো কাছে মাথা নত করেননি।
কক্সবাজারের খ্যাতিমান শিল্পপতি আলহাজ্ব মাস্টার আবুল কাসেম মিয়ান একাধারে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের স্পন্সর ডাইরেক্টর, আল্লাহওয়ালা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য ছিলেন। ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত তিনি ইসলামী ব্যাংকের ডাইরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
আলহাজ্ব মাস্টার আবুল কাসেম মিয়ানের সংক্ষিপ্ত জীবনী:
আবুল কাসেম মিয়ান ১৯৪৫ সালে রামু খিজারী উচ্চবিদ্যালয় থেকে মেট্টিক (এসএসসি) পাশ করে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য কলকাতা রিপন কলেজে ভর্তি হন। পড়ালেখার ব্যয় নির্বাহের জন্য সেখানে তিনি সরকারী কালেক্টরেটে চাকরী করেন।
কলকাতা অধ্যয়নকালে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি, শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের সাথে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেন। দেশ বিভাজনের পর তিনি কলকাতা থেকে দেশে ফিরে বরিশালে বদলি হয়ে বিএম কলেজে ভর্তি হন। ওখান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম শ্রেনীতে উত্তীর্ণ হন। পরে তিনি বদলি হয়ে কক্সবাজার টিপিও অফিসে যোগদান করেন। কিছুদিন চাকরী করার পর আলোকিত সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের প্রত্যাশায় তিনি স্বেচ্ছায় সরকারী চাকরী ইস্তফা দিয়ে রামু মিঠাছড়িতে প্রখ্যাত রাজনীতিক ও এমএলএ মরহুম জাফর আহমদ চৌধুরীর অনুরোধে তার প্রতিষ্ঠিত নিম্মমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান করেন।
১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনের ঢেউ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ভাষা আন্দোলনের সময় রামুতে তিনি সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। পরে রামু খিজারী উচ্চবিদ্যালয়ে ইংরেজি শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। শিক্ষকতাকালে তিনি রামুর পানিরছড়া এলাকার ধনাঢ্য ব্যক্তিত্ব আলহাজ্ব মতিউর রহমান চৌধুরীর বড় মেয়ে জোহার বেগমের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
১৯৫৬/৫৭ সালে শিক্ষকতা পেশা ত্যাগ করে ব্যবসার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামের কাপ্তাই চন্দ্রঘোনা গমন করেন আবুল কাশেম মিয়ান। ওই সময় সবেমাত্র পূর্ববাংলার একমাত্র কাগজকল ‘চন্দ্রঘোনা পেপারমিল’-এ পেপার উৎপাদন শুরু হয়। ওখানে তিনি কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত বাঁশ ও নরম কাঠ সরবরাহে ঠিকাদারী পান। ২/৩ বছর ঠিকাদারী করে কিছু মূলধন সংগ্রহ হলে তিনি কক্সবাজার চলে আসেন। কক্সবাজারে পানি উন্নয়নবোর্ডে প্রথম ঠিকাদার হিসাবে কাজ আরম্ভ করেন। প্রথম কাজ হিসাবে মরহুম জাফর আহমদ চৌধুরীর এলাকা মিঠাছড়ি খাল খনন করেন। এরপরে পানি উন্নয়নবোর্ডে বিভিন্ন বড় বড় কাজ করে সুনাম-সুখ্যাতি কুড়ান। ঠিকাদারীর পাশাপাশি ব্রিকফিল্ড ও লবনসহ অন্যান্য ব্যবসাও করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কক্সবাজার জেলায় প্রথম বাগদা চিংড়ি খামার স্থাপন করেন।
১৯৮১/৮২ সালে তিনি শহরের মাঝেরঘাট অঞ্চলে দেশের প্রথম পরীক্ষামূলক চিংড়ি হ্যাচারী স্থাপন করেন। সে জন্য তাকে দেশের বাগদা চাষ এবং হ্যাচারীর পথিকৃত বলা হয়।
শিক্ষা, সমাজসেবা ও শিল্পোদ্যোক্তা আলহাজ্ব মাস্টার আবুল কাসেম মিয়ান:
মেট্টিক পাশ করার পর তিনি জালাল উদ্দিন মাতবর, এডভোকেট ফজল করিম, মনিরুল হক চৌধুরী, ওবাইদুল হক মোকতার এর পৃষ্টপোষকতায় পঞ্চায়েত অফিসে খুরুশকুলের প্রথম জুনিয়ার হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে কক্সবাজার-মহেশাখালী আসনে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে অল্পভোটে হেরে যান।
মাস্টার আবুল কাসেম মিয়ান নিজ এলাকা খুরুশকুলের সামাজিক উন্নয়নে ‘ডাক দিয়ে যাই’ নামক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। সংগঠনটির মাধ্যমে তিনি খুরুশকুলের রাস্তাঘাট প্রশস্তকরণ, সামাজিক ব্যাধি- মদ উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধের জন্য অভিনব ব্যবস্থা নেন। মদ ক্রেতা-বিক্রেতার প্রত্যেককে ‘নিরুৎসাহী ভাতা’ হিসাবে ৫০০ টাকা করে অনুদান দেন। উল্লেখ্য যে, এই সময়ে জমির মূল্য ছিল কানিতে ৩০০ টাকা। এই কাজের জন্য তিনি শহরের বাড়ী ছেড়ে খুরুশকুলের কমিউনিটি সেন্টারে (বর্তমান হাইস্কুলের পাশে আইয়ুব খানের তৈরী সাইক্লুন শেল্টার) থাকতেন। এই সময়ে খুরুশকুলের সমস্ত মানুষকে এক জায়গায় (খুরুশকুল পুরাডেইল) ঈদের জামাত পড়ার ব্যবস্থা করেন। তৎসময়ের ধর্মান্ধ ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠির বিরোধীতার মুখে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত মাস্টার আবুল কাসেম মিয়ান বাবু ধীরেন্দ্র চন্দ্র দে’কে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত করতে মূখ্য ভূমিকা রাখেন। কক্সবাজার সরকারী কলেজ ও কক্সবাজার পৌর প্রিপ্যারেটরী উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ছিলেন। কক্সবাজার সরকারী কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য তৎকালীন ২০ হাজার টাকা অনুদান প্রদান করেন। কক্সবাজার সিটি কলেজ প্রতিষ্ঠায়ও বলিষ্ট ভূমিকা রাখেন। খুরুশকুলের তেতৈয়ায় নিজ নামে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আবুল কাসেম মিয়ান (একেসি) উচ্চবিদ্যালয়।’ খুরুশকুল উচ্চবিদ্যালয়, খুরুশকুল মুনিরিয়া বাহারুল উলুম মাদরাসাসহ অসংখ্য স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, মসজিদ নিজ প্রচেষ্টা ও অনুদানে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর একক প্রচেষ্টায় বৃহত্তর অবহেলিত খুরুশকুলবাসীর যাতায়াতের সুবিধার্থে বাঁকখালী নদীর ওপর ‘খুরুশকুল ব্রিজ’ স্থাপিত হয়। রামুর খুনিয়াপালং-এ রাবেতা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবক ছিলেন।
তৎকালীন সৌদি রাষ্ট্রদূতকে দেশীয় ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সুচিকিৎসার আহবান জানান মাস্টার আবুল কাসেম মিয়ান। তার আহবানে সাড়া দিয়ে সৌদি রাষ্ট্রদূত রাবেতা-আল আলমে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে পুরো জেলার চিকিৎসা জগতকে সমৃদ্ধ করেন। দেশীয় লবন শিল্প রক্ষায় লবন অমদানী বন্ধে তিনি স্বোচ্ছার ভূমিকা রাখেন। সরকার বরফকলের ওপর ভ্যাটারোপ করলে সারাদেশের বরফকল মালিকদের সংগঠিত করে ‘বাংলাদেশ বরফকল মালিক সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময় ভ্যাটের বিরুদ্ধে তিনি ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলেন। ফলে বরফকলের ওপর ভ্যাট প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় সরকার। যা আজও বলবৎ।
১৯৯১/৯২ সালে ‘আল্লাহওয়ালা সাইন্টিফিক শ্রিম্প ফার্ম লিমিটেড’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তিনি বৈজ্ঞানিক উপায়ে চিংড়ি উৎপাদনের কাজ শুরু করেন। এ জন্য তাকে বৈজ্ঞানিক পন্থায় চিংড়ি চাষের পথিকৃৎ বলা হয়। চিংড়ি শিল্পে অবদানের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শ্রেষ্ট চিংড়ি চাষি হিসাবে ১৯৯৬ সালে তাঁকে পুরস্কৃত করেন। ১৯৭৮ সালে শহরের মাঝেরঘাট অঞ্চলে আল্লাহওয়ালা সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজ নামে লবন মিল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮১ সালে আল্লাহওয়ালা বরফকল প্রতিষ্ঠা করেন। যা জেলার সর্ববৃহৎ বরফকল। মাঝেরঘাট শিল্পাঞ্চল প্রতিষ্ঠায় তার অসামান্য অবদান রয়েছে।
দেশের নামকরা কয়েক’শ গুনীজনেরও শিক্ষক আবুল কাসেম মিয়ান। তার ছাত্রদের মধ্যে উল্লখযোগ্য হলেন- সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সংসদ সদস্য আলহাজ্ব ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী, রামু কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর মেশতাক আহমদ, অনারারী ম্যাজিস্ট্রেড ফজলুল করিম, কলকাতা শান্তি নিকেতন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মনমত বড়–য়া, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. শাহজাহান মুনীর, মেঘনা সী-ফুড্স এর চেয়ারম্যান শিল্পপতি মরহুম ফারুখ আহমদ, সাবেক সংসদ সদস্য দিদারুল আলম চৌধুরী, রফিকুল আলম চৌধুরী, অধ্যাপক নূর আহমদ এডভোকেট, এডভোকেট শাহজাহান। রাজনৈতিক, সমাজসংস্কারক ও মানবসেবক আবুল কাসেম মিয়ান ইতিহাসের কিংবদন্তি হয়ে থাকবেন।
আলহাজ্ব মাস্টার আবুল কাশেম মিয়ানের মৃত্যু:
২০১৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারী সকালে আলহাজ্ব মাস্টার আবুল কাসেম মিয়ান ৯০ বছর বয়সে রাজধানীর ইবনে সিনা হাসপাতালে মৃত্যু বরণ করেন। তাকে নিজ গ্রাম তেতৈয়ায় দাফন করা হয়।
আবুল কাসেম মিয়ানের ‘নাগরিক স্মরণসভা’ শনিবার
সংবাদ বিজ্ঞপ্তি ::
কক্সবাজারের খ্যাতিমান শিল্পপতি, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের স্পন্সর ডাইরেক্টর, আল্লাহওয়ালা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য আলহাজ্ব মাস্টার আবুল কাসেম মিয়ানের আলোকজ্জলজীবন স্মরণে ‘নাগরিক স্মরণসভা’ শনিবার বিকাল ৩ টায় শহরে ডায়াবেটি পয়েন্ট সংলগ্ন বিয়াম অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠিত হবে।
স্মরণসভায় স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের ব্যাক্তিত্ব, সমাজসেবক ও বিভিন্ন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিগণ মরহুমের জীবনীর ওপর আলোচনা রাখবেন।
মরহুম আবুল কাসেম মিয়ানের পরিবারের পক্ষ থেকে সভায় সকলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন নাগরিক স্মরণ সভা উদযাপন কমিটি।
-ইমাম খাইর
সংবাদকর্মী ও মানবাধিকার সংগঠক।
ঊ-সধরষ: শযধরৎপড়ী১০@মসধরষ.পড়স
পাঠকের মতামত: