ঢাকা,মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

আতংক বাড়ে বৃষ্টি নামলে ।। লামায় ঝুঁকিতে ২০ হাজার মানুষ

pahar,,লামা প্রতিনিধি :::

মুষলধারে বৃষ্টি নামলেই আতংকিত জনপদে পরিণত হয় পার্বত্য লামা উপজেলার পাহাড়ি জনপদ। পাহাড় চূড়া ও পাদদেশে বসবাসকারী মানুষগুলো আতংকিত হয়ে বিনিদ্র রজনী পার করেন। একাধিক পাহাড় ধস ট্রেজেডির পর পাহাড়ে বসবাসকারী মানুষ গুলো এখন বৃষ্টি নামলেই আতকিংত হয়ে পড়েন। বিকল্প কোন ব্যবস্থা না থাকায় বাধ্য এখনো মৃত্যু ঝুঁকিতে বসবাস করছেন প্রায় ৪ হাজার পরিবারের ২০ হাজার মানুষ। অন্যত্র পূনর্বাসনের মাধ্যমে এসকল ঝুকিপূর্ণ বসবাসকারীদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়া সম্ভব বলে স্থানীয়রা মনে করেন। মুষলধারে বৃষ্টি নামলে কিংবা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য মাইকিং করেই শুধু প্রশাসন দায়িত্ব শেষ করেন। স্থায়ীভাবে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।

সূত্র জানায়, মুষলধারে টানা বর্ষন ও সাম্প্রতিক পাহাড় ধসে ব্যাপক হতাহতের পর লামা উপজেলার পাহাড় চূড়া ও পাদদেশে বসবাসকারীদের মধ্যে পাহাড় ধস আতংক বিরাজ করছে। লামা উপজেলার ১টি পৌরসভা ও ৭ টি ইউনিয়নে দেড় লক্ষাধিক লোকের বসবাস। এখানকার ছোট বড় পাহাড়ে জনবসতির ইতিহাস প্রায় শত বছরের। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে এখানে শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ পাহাড় চূড়া, পাদদেশ ও কোল ঘেঁষে বসবাস করে আসছে।

সাম্প্রতিক বছর গুলোতে বর্ষা মৌসুম এলেই এ অঞ্চল পরিণত হয় আতঙ্কিত জনপদে। পরপর কয়েক বছরের পাহাড় ধস ট্র্যাজেডির কারণে এ পার্বত্য জনপদে বসবাসকারী অধিবাসীরা এখন বৃষ্টি দেখলেই রীতিমত আঁতকে ওঠে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ত্রাণ শাখার হিসেবে মতে গত ৫ বছরে শুধুমাত্র বান্দরবানেই পাহাড় ধ্বসে ৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৫ সালের ১ আগস্ট লামা হাসপাতাল পাড়ায় পাহাড় ধসে একই পরিবারের ৫ জন সহ ৬ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। ২০১৩ সালে প্রবল বর্ষণে উপজেলার ফাইতং ইউনিয়নের রইম্যাখোলা, পোঁকখাইয়া ঝিরি, মগনামা পাড়া ও রূপসীপাড়া ইউনিয়নের সামাইছড়িতে পাহাড় ধসে মাটি চাপায় মারা গেছে একই পরিবারের ১১ জনসহ ২৭ জন। এর আগে ২০০৯ সালের ৩০ আগস্ট আজিজনগর ও গজালিয়ায় একই পরিবারের ৬ জনসহ মারা গেল ১১ জন। ক্রমাগতভাবে প্রতি বছরই বাড়ছে পাহাড় ধসের ঘটনা। দীর্ঘ হচ্ছে লাশের মিছিল। বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দেয়া তথ্য এবং সরজমিন পরিদর্শনকালে দেখা গেছে, লামা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় চূড়া কিংবা পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে প্রায় ৪ হাজার পরিবারের ২০ হাজার মানুষ এখনো বসবাস করছে। পাহাড় ধসের চরম ঝুঁকিতে রয়েছে আজিজ নগরের হরিনমারা , চিউরতলী, চিউনি পাড়া ও তেলুনিয়া, ফাইতং ইউনিয়নের রইম্যাখোলা, পোঁকখাইয়া ঝিরি, মগনামাপাড়া, গজালিয়া, সরই, ফাসিয়াখালী এবং রুপসীপাড়ার পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীরা। এছাড়া লামা পৌর এলাকার হাসপাতাল পাড়া, চেয়ারম্যান পাড়া, মধুঝিরি, নুনারবিল পাড়া, কুড়ালিয়ার টেক, টি.এন্ড টি পাড়ায়ও লোকজন ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে।

জানা গেছে, পাহাড়ের পাদদেশ ও চূড়া অপরিকল্পিতভাবে কেটে বাড়িঘর নির্মাণ, অবাধে বৃক্ষ নিধন, পাহাড় খুঁড়ে পাথর উত্তোলন, অপরিকল্পিত জুম চাষ, পাহাড় কেটে ইটভাটা স্থাপনসহ প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি করায় পাহাড়গুলো ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সময় ভূকম্পনের ফলে ফাটল ধরা পাহাড়ের ফাটল দিয়ে বৃষ্টির পানি প্রবেশ করার ফলে ব্যাপক পাহাড় ধস সৃষ্টি হচ্ছে। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানগণ জানিয়েছেন, তাদের ইউনিয়নে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার জন্য কোন আশ্রয় কেন্দ্র নেই। আশ্রয় কেন্দ্র না থাকায় ভারি বর্ষণ শুরু হলে ঝুকিপূর্ণ বাসবাসকারীদের পার্শ্ববর্তী স্কুল, মাদ্রাসায় আশ্রয় নিতে বলা হয়। কিন্তু অনেক এলাকায় বিদ্যালয় না থাকায় ঝুঁকিপূর্ণদের প্রয়োজনীয় মুহূর্তে সরিয়ে নেয়া সম্ভব হয় না। বিভিন্ন এলাকার পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীরা জানিয়েছেন, মাথা গোঁজার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভাবেই তারা বসবাস করছেন।

লামা পৌরসভার চেয়ারম্যান পাড়া এলাকার বাসিন্দা নুরজাহান বেগম জানান, অন্যত্র কোন জায়গা না থাকায় বাধ্য হয়ে পাহাড় চূড়ায় বসবাস করছি। ইতিমধ্যে পাহাড়ের দু’পাশ থেকে কেটে ফেলায় আমরা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছি। মুক্তিযোদ্ধা প্রিয়দর্শী বড়ুয়া জানান, প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য শুধু মাইকিং করে দায়িত্ব শেষ করলে চলবেনা। পাহাড়ে ঝুকিপূর্ণ বসবাসকারীদের অন্যত্র পূণর্বাসনের মাধ্যমে নিরাপদে সরিয়ে নেয়া দরকার।

বান্দরবান জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিক জানিয়েছেন, যারা পাহাড় ধ্বংস করছে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। তিনি বলেন মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে পাহাড়ে বসবাসকারীদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার জন্য সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে। সরকারের কর্মসূিচ রয়েছে বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষের একটি ঠিকানা থাকবে, ঘর থাকবে। সে লক্ষ্যে গরীব মানুষদের তালিকা প্রনয়ন হচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় পাহাড়েও তালিকা হচ্ছে। কিভাবে তাদের টেকসই ঘর তৈরি করে দেয়া যায় সে ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা চলছে।

লামা উপজেলার পাহাড়ে বাধ্য হয়ে মৃত্যুঝুঁকিতে বসবাসকারীদের অন্যত্র পুনর্বাসনের মাধ্যমে নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার মাধ্যমে পাহাড় ধসে জানমালের ক্ষতির হাত থেকে অত্রাঞ্চলের বাসিন্দাদের রক্ষা করা সম্ভব বলে স্থানীয়রা মনে করছেন।

পাঠকের মতামত: