সেদিন ৮ ফাল্গুন। পিচঢালা রাজপথে তাজাপ্রাণ নেমেছিল রাষ্ট্রভাষার অধিকারের কথা জানাতে। অধিকার আদায়ের সেই লড়াইয়ে ঘাতকের গুলিতে ঝরে পড়েছিলেন যারা,আজ তাদের স্মরণের দিন।আজ অমর একুশে। ‘আমাদের চেতনার সৈকতে একুশের ঢেউ মাথা কুটলো, শহীদের রক্তের বিনিময়ে চোখে জল কয়ফোঁটা জুটলো’- কিন্তু বায়ান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদের রক্ত শত শোকের মাঝেও আমাদের আজ ভাষার অধিকার দিয়েছে। আর সেই গৌরব আজ বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশকে পরিচিত করে তুলেছে। আমাদের হাত ধরেই এ বিশ্ব পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও শফিউরসহ নাম না-জানা শহীদ ঢাকার রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে রচনা করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তি। তাদের আত্মদানের স্মৃতিকে মনে রেখে দেশে উদযাপিত হয়ে আসছে মাসজুড়ে অমর একুশে।
মাতৃভাষার গুরুত্ব নিয়ে যারা প্রশ্ন তোলেন তাদের জন্য আবুল ফজল ১৯৬৯ সালে লিখেছিলেন ‘ভাষা:এক ভয়ঙ্কর হাতিয়ার’ প্রবন্ধটি। তিনি লিখেছেন, ‘পূর্ণাঙ্গ মানুষ হওয়ার পথে ভাষা তার প্রধানতম হাতিয়ার। ভাষা মানে, মাতৃভাষা- কারণ এ ভাষা তার সহজাত।’
এরই মধ্যে কেটে গেছে ৬৭ বছর। বাংলা এখনও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেলো কাগজে কলমে। এখনও কাজের ভাষা বাংলা নয় অনেক জায়গায়। যে লক্ষ্য নিয়ে ছাত্ররা সেদিন ১৪৪ ধারা ভেঙে বুক পেতে দিয়েছিল বন্দুকের নলের সামনে, জীবন দিয়েছিল, তাঁদের আত্মত্যাগকে আমরা যথাযথ মর্যাদা দিতে পেরেছি কিনা, সে নিয়ে প্রশ্ন উঠছে নতুন করে। আজও আইনি আদেশ বা রায়ের ক্ষেত্রে, চিকিৎসা সেবায়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামকরণে, মুঠোফোনে ইংরেজিই অগ্রাধিকার পায়।
অথচ বায়ান্নোর এসময় উত্তাল ছিল বাংলাকে প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা অমান্য করে রাজপথে বেরিয়ে এলে পুলিশ গুলি চালায়। নিহত হন সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বারের মতো তরুণ প্রাণ। প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ ঢাকাবাসী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে সমবেত হয়। পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারি আবারও রাজপথে নেমে আসে। ভাষা শহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখতে ২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেল প্রাঙ্গণে গড়ে ওঠে একটি স্মৃতিস্তম্ভ।এরপর একাধিকবার গুঁড়িয়ে ফেলা হয়েছে সেই বেদী। আবারও মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে ভাষা শহীদদের স্মৃতি। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে ৯ মে গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সেই থেকে আমাদের মুখের ভাষা, কাগজে-কলমে আমারই ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়- আ-মরি বাংলা ভাষা।
এদিন কেবল আর আমাদের রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার দিন নেই। দিনটি এখন বিশ্বব্যাপী উদযাপনের জায়গায় এসে গেছে। ১৯৯৭ সাল থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এখন একুশে কেবল বাংলাদেশের নয়, সমগ্র বিশ্বের। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে এখন বিশ্বের দেশে-দেশে পালিত হয়।
একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে দেশব্যাপী চলবে নানা আয়োজন। সকালের আলো ফোটার আগে থেকে শুরু হবে প্রভাত ফেরি। নিজ নিজ এলাকার শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে যাওয়ার পাশাপাশি নিজেরা সাময়িক শহীদ মিনার বানিয়েও দিনটিকে স্মরণ করার রেওয়াজ আছে দেশজুড়ে অলিতেগলিতে।
আজ রাত ১২টা ১ মিনিটে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুলেল শ্রদ্ধা জানিয়ে আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেছেন। সারা রাতজুড়ে এমনকি একুশের দুপুর গড়িয়ে গেলেও এ ফুলের শ্রদ্ধা জানানো শেষ হয় না। বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ ও শিশু এসে মিলিত হন, শহীদদের স্মরণে, শাসকদের হাত থেকে মাতৃভাষাকে ছিনিয়ে আনার অর্জনের গৌরবে। সেই বাংলা ভাষা আমাদের ভাষা শিক্ষার বুনিয়াদ হয়ে থাকবে। সেই প্রত্যাশায় শুরু হোক ভাষার মাসের প্রথম প্রহর। আলতাফ মাহমুদের সুরে গেয়ে উঠুক বাংলাদেশ- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’।
পাঠকের মতামত: