ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

বাংলাদেশের সীমানায় ভারতীয়দের মাছ শিকারের অভিযোগ জেলেদের

বৈরি আবহাওয়ায় ১০ হাজার ট্রলার সাগরে মাছ শিকারে যেতে পারছে না

নিজস্ব প্রতিবেদক :: চাক্তাই নতুন ফিশারিঘাট এলাকায় পুরনো জাল রিপু করছিলেন নোয়াখালীর জেলে এয়াকুব আলী। তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার আগে থেকেই বোটে মাছ মারতে যাই। সাগরে মাছ শিকারি জেলেদের মধ্যে বেশিরভাগ ভোলা ও নোয়াখালী জেলার।

২৩ জুলাই মৌসুম শুরুর দিনই আমরা সাগরে গিয়েছিলাম। কিন্তু আবহাওয়া খারাপ হওয়ায় দুইদিন পর ফিরে আসি।’ এয়াকুব আলীর মতো শত শত জেলে এখন চাক্তাই, ফিশারিঘাট, ফিরিঙ্গীবাজার, পাথরঘাটা, কাট্টলী, পতেঙ্গা ও জেলার কর্ণফুলী, আনোয়ারা, বাঁশখালী এবং সীতাকুণ্ড এলাকার সাগরপাড়ে নৌকা নিয়ে অপেক্ষায় আছেন কখন আবহাওয়া স্বাভাবিক হবে।

তাছাড়া দেশের কক্সবাজার, ভোলা, বরগুনা, খুলনা, পটুয়াখালী এলাকার জেলেরা গভীর সাগরে মাছ শিকারে যেতে উন্মুখ হয়ে আছেন। আবহাওয়া স্বাভাবিক হলেই তারা সাগরে রওয়ানা দিবেন।

জানা যায়, বঙ্গোপসাগরের মৎস্যভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে সামুদ্রিক মাছের প্রজনন মৌসুমে বিশেষ করে ইলিশ মৌসুমে সাগরে ৬৫ দিনের জন্য মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সরকার। গত কয়েক বছরের ন্যায় এ বছরও ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত সাগরে মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা ছিল।

নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর ২৩ জুলাই রাতেই সাগরে মাছ শিকারে রওয়ানা হয় ইঞ্জিনচালিত অনেক ট্রলার। আবহাওয়া বিরূপ থাকায় বেশিরভাগ ট্রলার ও বড় বাণিজ্যিক ট্রলিং জাহাজগুলো সাগরে যায়নি। প্রথমদিন যারা গিয়েছেন আবহাওয়ার অবনতি ঘটলে দুইদিনের মাথায় তারাও উপকূলে ফিরে আসেন।

শুক্রবার বিকেলে নগরীর চাক্তাই ফিশারিঘাট, ফিরিঙ্গীবাজার ঘাট, অভয়মিত্র ঘাট এলাকায় দেখা যায় শত শত জেলে ট্রলার নিয়ে অপেক্ষায় আছেন সাগরে যেতে। কর্ণফুলী নদীর মধ্যখানে, চরপাথরঘাটা ও ইছানগর এলাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঘাটে নোঙর করা রয়েছে বাণিজ্যিক ট্রলিং জাহাজগুলো। শুধু আবহাওয়ার বৈরিতা নয়, সাগরে মাছ শিকারে গেলে নানান প্রতিবন্ধকতার কথা উঠে আসে জেলেদের বক্তব্যে। তন্মধ্যে বড় অভিযোগ, ভারতীয় জেলেদের আগ্রাসন।

চাক্তাই এলাকায় কথা হয় আবদুল মতিন মাঝির সাথে। ভোলা জেলার মনপুরায় গ্রামের বাড়ি মতিন মাঝির। ২৮ বছর ধরে সাগরে মাছ শিকারে যান তিনি। এই অভিজ্ঞ জেলের অভিযোগ, ‘বছরে ৬৫ দিন আমাদের দেশে সাগরে মাছ শিকার বন্ধ থাকে। এই সময়ে ভারতীয় ট্রলিং জাহাজ আমাদের অভ্যন্তর থেকে মাছ শিকার করে নিয়ে যায়। মাছ শিকারের মৌসুমেও ভারতীয় ট্রলিং জাহাজ আমাদের সীমানার মধ্যে এসে মাছ শিকার করে। অনেক সময় আমাদের জালও কেটে নেয়।’

পাশে দাঁড়ানো জেলে মোসলেহ উদ্দীন বলেন, ‘এই ট্রিপেও আমাদের সাথে দেখা হয়েছে ভারতীয় জেলেদের। তারা কেউ ট্রলিং করছে, কেউ লম্বা জাল ফেলছে। তাদের জন্য আমরা মাছ মারতে (শিকার করা) পারি না। এবারেও আমাদের জালকে দুই কাটা দিছে। ওদের ওয়ারলেস আছে। আমাদের ওয়ারলেস নেই। আমরা তাদের বাঁধা দিতে চাইলে তারা ওয়ারলেসে অন্য জাহাজগুলোকে ডেকে নেয়। তখন তাদের ১০-২০টি ট্রলিং জাহাজ এক জায়গায় হয়ে যায়। আর আমাদের আর কোনো উপায় থাকে না।’

এসময় জাকির হোসেন মাঝি বলেন, ‘আমাদেরগুলো কাঠের নৌকা, যে কারণে আমাদের তারা (ভারতীয় ট্রলিং) কেয়ার (ভয় পাওয়া) করে না। তবে আমাদের দেশীয় ট্রলিং জাহাজগুলো দেখলে তারা চলে যায়। আবার কোস্টগার্ড, নৌ-বাহিনী দেখলেও তারা পালিয়ে যায়।’ তিনি বলেন, আমি ৪০ বছর ধরে সাগরে যাই। অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করেই মাছ শিকার করি। এখন খারাপ আবহাওয়া হওয়ায় যেতে পারছি না।

মকছুদ নামের আরেক জেলে বলেন, ‘বছরের এই সময়ে পূবের বাতাস শুরু হলে সাগরে ঠেকা যায় না। পূবালী বাতাসের কারণে সাগর গরম (উত্তাল) হয়ে যায়। প্রথম ট্রিপে গিয়ে দুইদিনে ফিরে আসায় আমাদের প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা লস (লোকসান) হয়েছে।’ তিনি বলেন, যারা ইঞ্জিন চালিত ডিঙি নৌকায় মাছ শিকার করেন, তারা সাগর উত্তাল থাকলেও উপকূলের কাছাকাছি ছোট জাল দিয়ে মাছ শিকার করতে পারে। সকালে গিয়ে তারা বিকেলে ফিরে আসে।

বাণিজ্যিক জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ফিশ গার্ডেনের পরিচালক মো. সৈয়দ আহমেদ বলেন, ‘২৩ জুলাই নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর আবহাওয়া বৈরি থাকায় আমাদের জাহাজগুলো সাগরে যেতে পারেনি। তবে আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। এখন আবহাওয়া স্বাভাবিক হলে জাহাজগুলো রোববারের মধ্যে রওয়ানা হতে পারে।’

মেরিন হোয়াইট ফিস ট্রলার ওনার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. তাজ উদ্দিন তাজু বলেন, ‘দেশে ২৫৩টি বাণিজ্যিক ট্রলার রয়েছে। আবহাওয়া খারাপ হওয়ায় কোনো জাহাজ সাগরে যেতে পারছে না। সবগুলোই নিরাপদে রয়েছে। বেশিরভাগ রয়েছে কর্ণফুলী নদীতে।’

সোনালি যান্ত্রিক মৎস্য শিল্প সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক বাবুল সরকার বলেন, ‘গত বছর মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে জেলেরা সুফল পেয়েছে। নিষেধাজ্ঞার পর আশাতীত মাছ পেয়েছে জেলেরা। এবারও করোনার কারণে সবকিছু বন্ধ রয়েছে। কিন্তু মাছ শিকারের নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পরও জেলেরা সাগরে মাছ শিকারে যেতে পারছেন না। যারা প্রথমদিন গিয়েছিল, দুইদিন পর তারাও সামান্য কিছু ইলিশ ধরে ফিরে এসেছে। দেশে ১০ হাজারের কাছাকাছি ট্রলার রয়েছে। এসব ট্রলার গভীর সাগরে মাছ শিকারে যায়। এখন সবাই বেকার বসে রয়েছে।’

সাগরে মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের সামুদ্রিক জলসীমার পরিমাণ এক লক্ষ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার। দেশে প্রায় ৬৮ হাজার মাছ শিকারি নৌযান রয়েছে। তন্মধ্যে ইঞ্জিন চালিত নৌকা রয়েছে প্রায় ৩৩ হাজারের কাছাকাছি। এরমধ্যে দুই তৃতীয়াংশের বেশি উপকূলের কাছাকাছি ডিঙি নৌকা দিয়ে মাছ শিকার করে। জেলের সংখ্যা প্রায় ৫ লক্ষ ১৬ হাজার।

পাঠকের মতামত: