ঢাকা,শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

কাঁদছে বোবা পাহাড়

কালের কন্ঠ :: ‘পাহাড়ের কান্নাকে ঝর্ণা সবাই বলে, সেই ঝর্ণা ধারায় পাহাড় কষ্টের নদী বয়ে চলে…।’ পাহাড় নিয়ে এমন কথামালাকে ভরাট কণ্ঠে অন্য মাত্রা দেন ব্যান্ডশিল্পী জেমস। শূন্য দশকের সেই গান এখনো কানে বাজে। বাস্তবতাও তাই, ক্ষত বুকে চলছে পাহাড়ের বোবা কান্না! পার্বত্য জনপদসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাহাড়ের নান্দনিক সবুজ ঢেউ থামিয়ে দেওয়া হচ্ছে কারণে-অকারণে। কোথাও উন্নয়নের নামে, আবার কোথাও মাটিখেকোদের জুলুমে ফোকলা হচ্ছে এই প্রকৃতির দেয়াল। নতুন স্থাপনা নির্মাণ থেকে সড়ক সম্প্রসারণ বা নানা ছুতায় কোপ পড়ছে পাহাড়ে। কোনো রকম রাখঢাক ছাড়াই, ফকফকা দিনের আলোতেই চলছে এই পাহাড় লুট। অনেক এলাকায় পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। পাহাড় লোপাটের সেই গল্পে সরকারি দলের নেতাকর্মীরা থাকেন ‘নায়ক’, আর স্থানীয় প্রশাসন হয়ে যায় নীরব দর্শক!

শুধুই কি পাহাড়, মাটি লুটের কারণে উজাড় হচ্ছে পাহাড়ি বন। পাহাড় ধসে মাটিচাপায় নিভছে মানুষের প্রাণ, হারিয়ে যাচ্ছে ঘরবাড়ি। ইটভাটায় পাহাড়ের মাটি তুলে দিয়ে দুর্বৃত্তরা পকেটে ভরছে টাকা। আর ভাটায় পুড়ে খাক হচ্ছে শত শত বছরের পুরনো পাহাড়ের সোনামাটি। একের পর এক পাহাড় ন্যাড়া হতে থাকলেও যেন দেখার কেউ নেই।

পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে নির্বিচারে পাহাড় খোদাই চলতে থাকলে আগামী পাঁচ দশকের মধ্যে বিশেষ করে চট্টগ্রামে আর পাহাড় দেখা যাবে না। পাহাড় কাটার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ-প্রতিবেশ। বন হারাচ্ছে তার চেনা রূপ। এ কারণে বনের নানা প্রাণী হাঁটছে বিলুপ্তির পথে।

বন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশে পাহাড়ের আয়তন প্রায় ১৩ লাখ ৭৭ হাজার হেক্টর, যা মোট আয়তনের ৯.৩৩ শতাংশ। এর মধ্যে বন অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ছয় লাখ ৭০ হাজার হেক্টর পাহাড়ি বন। তবে তিন পার্বত্য জেলাকে বলা হয় পাহাড়ের আঁতুড়ঘর। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, কক্সবাজার আর সিলেট অঞ্চলে রয়েছে আরো ছোট-বড় পাহাড়-টিলা। নির্দয়ভাবে পাহাড় কাটার কারণে এখন পাহাড়ের আয়তন কতটুকু কমেছে তার হিসাব সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থার কাছেই নেই।

বন্দরনগরী চট্টগ্রামের পাহাড়ে প্রথম কোপ দিয়েছিল ব্রিটিশরা। ১৭৬০ সালে পাহাড় কাটার যে অশুভ তৎপরতা শুরু হয়েছিল সেই ধারা বজায় ছিল পাকিস্তান আমলেও। আর এখন স্বাধীন বাংলাদেশে পাহাড়কে করা হচ্ছে ক্ষত-বিক্ষত। রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির পাহাড় কাটার গল্পটা আরো ভয়ংকর। পাহাড় কেটে কেটে সেখানকার রূপ-সৌন্দর্য সবই কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। আর কক্সবাজার ও সিলেটে নিয়মিতই চলছে ছোট-বড় পাহাড়-টিলা কাটার মচ্ছব। কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন সব পীড়াদায়ক তথ্য।

১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে বলা আছে, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সরকারি, আধা-সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কাটা বা মোচন করা যাবে না। তবে শর্ত দিয়ে বলা হয়েছে, অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে পাহাড় বা টিলা কাটা বা মোচন করা যাবে।

ফলে উন্নয়নের কারণে অনেক এলাকায়ই চলছে পাহাড় কাটা। চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজারের ঘুনধুম পর্যন্ত নতুন রেললাইনের পথে অনেক পাহাড়ই কাটা পড়েছে। এসব পাহাড় কাটার ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতিও রয়েছে। কিন্তু এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে সেখানে অনেকেই পাহাড় কেটে মাটি বিক্রির অপতৎপরতায় নেমেছে। এদিকে রাঙামাটির আসামবস্তি-কাপ্তাইয়ের ১৮ কিলোমিটার সড়কটি চওড়া করার কাজ চলছে। সড়কটির উন্নয়ন করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে অকারণেই কেড়ে নেওয়া হয়েছে সবুজ পাহাড়ের সৌন্দর্য।

নির্বিচারে পাহাড় কাটার কারণে বৃহত্তর চট্টগ্রামে নিয়মিতই ঘটছে পাহাড়ধসের ঘটনা। নিকট অতীতে ২০১৭ সালের ১৩ জুন সবচেয়ে প্রলয়ংকরী পাহাড়ধসের ঘটনায় দেশ দেখেছিল মৃত্যুর মিছিল। সেই বছর বৃহত্তর চট্টগ্রামে এক দিনেই ১৪২ জন এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণ হারিয়েছিল। এদের মধ্যে ১২০ জনই ছিল রাঙামাটির। উদ্ধার তৎপরতা চালাতে গিয়ে মাটিচাপায় জীবন দিয়েছিলেন পাঁচ সেনা সদস্যও।

২০১৩ সালের ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনে বলা আছে, পাহাড় বা টিলা থেকে মাটি কেটে বা সংগ্রহ করে ইটের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। তা ছাড়া কোনো পাহাড় বা টিলার উপরিভাগে, ঢালে বা তত্সংলগ্ন সমতলে এবং পাদদেশ থেকে আধাকিলোমিটারের মধ্যে কোনো ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। কোনো ইটভাটায় কাঠ পুড়িয়ে ইট তৈরির বিধানও নেই। তারপরও এই আইন মানার ভ্রুক্ষেপ নেই কারো। পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে ইটভাটা গিজগিজ করছে! বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাহাড় কেটে কতগুলো ইটভাটায় এ মাটি যাচ্ছে তার সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও সংখ্যাটা পাঁচ শ ছাড়িয়ে যেতে পারে।

পাহাড় কাটা বন্ধে প্রয়োজন আইনের যথাযথ প্রয়োগ, অথচ পার্বত্য তিন জেলায় সরাসরি নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যালয়। অভিযোগ পেলে মাঝে মাঝে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা স্বল্প সময়ের জন্য এসে ঘুরে গেলেও তাঁরা কোথাও পাহাড় কাটা বন্ধ করতে পেরেছেন—এমন নজির বিরল!

তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি দাবি করেছেন, অন্যান্য সরকারি বিভাগের মাধ্যমে সামাজিক বনায়ন, শাকসবজি ও মিশ্র ফল চাষ, বাঁশ-বেত চাষ এবং সবুজায়নের মাধ্যমে পাহাড় রক্ষার চেষ্টা করছে সরকার।

এদিকে পাহাড় কাটা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেসের সাবেক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, পাহাড় রক্ষার দায়িত্ব সরকারি সংস্থাগুলোকেই নিতে হবে। পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে যাঁরা পাহাড়ের মালিক হয়ে আছেন তাঁদেরও এগিয়ে আসতে হবে। বসতি কিংবা কলকারখানা স্থাপনের নামে আর পাহাড় কাটা যাবে না। এটা সরকারকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।

ইটভাটায় রাঙামাটির পাহাড়ের মাটি : রাঙামাটি থেকে ফজলে এলাহী ও জয়নাল আবেদিন জানান, আগ্রাসী পাহাড় কাটার গ্যাঁড়াকলে পড়ে দিন দিন বিবর্ণ হচ্ছে প্রকৃতির রানি রাঙামাটি। জেলা শহর থেকে শুরু করে দুর্গম সাজেক—সর্বত্রই যেন চলছে পাহাড় খোদাইয়ের ‘উৎসব’। এই পাহাড় কাটার চূড়ান্ত ফল ২০১৭ সালেই দেখিয়েছিল প্রকৃতি। তোলপাড় করা সেই পাহাড়ধসের ঘটনায় শুধু রাঙামাটিতেই এক দিনে ১২০ জনের মৃত্যু দেখেছিল জেলাবাসী। এই মৃত্যুর মিছিল ভুলে এখনো সমানতালে চলছে পাহাড় কাটা। প্রশাসনের হস্তক্ষেপে কালেভদ্রে পাহাড় কাটা কিছুটা বাগে আনা গেলেও কিছুদিন পর রাজনৈতিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ফের শুরু হয় দুর্বৃত্তপনা।

রাঙামাটির পাহাড়ের মাটির বেশির ভাগই যায় ইটভাটায়। জেলায় যত ইটভাটা আছে, দুই-তৃতীয়াংশের বেশিই রাঙামাটির সীমান্ত লাগোয়া চট্টগ্রামের রানীরহাট আর রাঙামাটির কাউখালী উপজেলায়। এক কিলোমিটারের মধ্যে অর্ধশতাধিক ইটভাটার সব মাটিই আসে রাঙামাটির বিভিন্ন প্রান্তের কাটা পাহাড় থেকেই।

সরেজমিনে কাউখালীর কলমপতি ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, উপজেলা থেকে নাইল্যাছড়ি হয়ে সুগারমিল যাওয়ার সড়কটির পাশে তারাবুনিয়া, ডাব্বুনিয়া, মাঝের পাড়ায় পাহাড় ও টিলা ঘেঁষে রয়েছে বেশ কটি অবৈধ ইটভাটা। তবে বর্তমানে ছয়টি ইটভাটা চালু রয়েছে, যার কোনোটিরই বৈধ কাগজপত্র নেই।

শুধু কাউখালীতেই নয়, নানিয়ারচর, লংগদু, বাঘাইছড়ি, কাপ্তাই উপজেলায়ও চলছে বিধ্বংসী পাহাড় কাটা। রাঙামাটি শহরের মানিকছড়ি, কুতুকছড়ি, কেরানী পাহাড়, পুলিশ লাইন, হ্যাচারি এলাকা, মানিকছড়ি, টিভি স্টেশন এলাকা, ভেদভেদী, কলেজ গেট, আসামবস্তি, রাঙাপানিসহ বিভিন্ন এলাকারও একই ছবি।

লংগদু আটারকছড়া ইউনিয়নে তিন ব্রিজ এলাকায় পাহাড় কেটে দোকানের প্লট তৈরি করছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ইউপি সদস্য জিয়াউর রহমান। এ ব্যাপারে বিভিন্ন সময় অভিযোগ উঠলেও কোনো পদক্ষেপই নেয়নি প্রশাসন।

রাঙামাটির পরিবেশবাদী সংগঠন গ্লোবাল ভিলেজের পরিচালক হেফাজত সবুজ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বাড়ি নির্মাণ, রাস্তা সংস্কার, ইটভাটাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের জন্য পাহাড় কাটছে একটি চক্র। দিনের আলোয় পাহাড় কাটা চললেও প্রশাসন নির্বিকার।’

চকরিয়ায় পাহাড় কাটার সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা : কক্সবাজারের চকরিয়া থেকে ছোটন কান্তি নাথ জানান, পাহাড়-টিলা কাটার রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলছে কক্সবাজারের চকরিয়ায়। পাহাড় খেকো চক্রের অপতৎপরতায় একের পর এক সাবাড় হয়ে যাচ্ছে সংরক্ষিত পাহাড়।

সংরক্ষিত বন দখল করে উঁচু-নিচু ও টিলা কোনো পাহাড়ই অবশিষ্ট রাখছে না পাহাড়খেকো একাধিক চক্র। সংরক্ষিত পাহাড় কেটে প্লট আকারে বিক্রিও চলছে। পাশাপাশি সরকারের চলমান উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যবহারের জন্যও পাহাড় কেটে প্রতিদিন শত শত গাড়ি মাটি বিক্রি করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতাচ্ছেন প্রভাবশালীরা। আর অবৈধ ইটভাটায় পাহাড়ের মাটি ব্যবহারের তৎপরতা চলছে দীর্ঘদিন ধরেই।

বিশেষ করে কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জের আলোচিত উচিতার বিল মৌজার বুনো হাতির অভয়ারণ্যের বন উজাড় করে ইটভাটায় ব্যবহার করা হচ্ছে পাহাড়ের মাটি। কয়েক বছরে এই মৌজার অর্ধশতাধিক পাহাড় সাবাড় করার ঘটনায় প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর, বন বিভাগসহ সংশিষ্টরা জানলেও ইটভাটার মালিক প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা হওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে প্রশাসনিক কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হচ্ছে না।

সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জের ফাঁসিয়াখালী বিটের উচিতার বিল, নোয়াপাড়া, মুসলিমনগর, ঘুনিয়ায় পাহাড় সাবাড় চলছেই। শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে এখানে পাহাড় কাটায় জড়িত রয়েছেন চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী। সঙ্গে তাঁর একাধিক ভাইও পাহাড় কেটে অন্যত্র মাটি বিক্রি করেন বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।

পরিবেশ বিধ্বংসী এসব কর্মকাণ্ডে সরাসরি জড়িত আওয়ামী লীগ নেতা । তাঁর পক্ষে এই কাজ সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন হামিদ রেজা সাগর। পাহাড় কাটার ছবি যাতে কোনো গণমাধ্যমকর্মী ধারণ করতে না পারেন সে জন্য সেখানে বসানো হয়েছে পাহারাও।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খুটাখালী ইউনিয়নে পাহাড় খেকোচক্রের অন্তত পাঁচটি সিন্ডিকেট রয়েছে। এসব সিন্ডিকেট প্রধানের মধ্যে বিএনপি থেকে অনুপ্রবেশকারী আওয়ামী লীগ নেতা জিল্লুর রহমান, রেজাউল করিম ওরফে রেজু মাস্টার, শফিউল আলম মেম্বার, শফিউল আলম, বন মামলার আসামি জসীম উদ্দিন, যুবলীগ নেতা আরাফাত রানা, আওয়ামী লীগ নেতা রফিকুল ইসলাম, আবদু শুক্কুর, মোহাম্মদ ফারুক অন্যতম।

এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মোহাম্মদ মোয়াজ্জম হোসাইন বলেন, ‘চকরিয়ায় বিভিন্ন স্থানে পাহাড় কাটাসহ পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে কক্সবাজার কার্যালয়ের সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

চট্টগ্রামের পরিবেশ বিপন্ন : চট্টগ্রাম থেকে এস এম রানা জানান, চট্টগ্রামে পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হচ্ছে আবাসিক এলাকা, ইটভাটা ও কারখানা। সেই সঙ্গে দেদার চলছে মাটি বিক্রি। নগরীর পাহাড় কেটে ফৌজদারহাট-বায়েজিদ বোস্তামী সংযোগ সড়ক নির্মাণ করেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে শুরুতে পাহাড় কাটার অনুমতি নেওয়া হলেও পরে অনুমোদনের চেয়ে অতিরিক্ত পাহাড় কাটা হয়েছে। এখন খাড়া পাহাড়ে নির্মাণ করা সড়কটি অনেকটাই ঝুঁকিতে। ১৫টি পাহাড় কেটে যে সড়ক তৈরি করা হয়েছে, সেখানে সিডিএ পাহাড় কাটার শর্ত না মানায় সিডিএকে ১০ কোটি টাকা জরিমানাও করে পরিবেশ অধিদপ্তর।

এ ছাড়া নগরীর খুলশী, শেরশাহ, বাংলাবাজার, আকবর শাহ, চন্দ্রনগর এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে পাহাড় কাটছে মাটি দস্যুরা। নাছিয়াঘোনায় গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে পাহাড় কাটা চলছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা সরেজমিনে গিয়ে মামলা দিয়েও পাহাড় কাটা বন্ধ করতে পারেনি। সেখানে পাহাড় কেটে গাউসিয়া লেকসিটি নিউ আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়েছে। একইভাবে পাহাড় কাটতে দেখা গেছে শেরশাহ বাংলাবাজার ও আকবরশাহ থানার শাপলা আবাসিক এলাকায়। রাতের আঁধারে পাহাড় কাটা হয় জঙ্গল ছলিমপুরেও।

এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক নূরুল্লাহ নুরু বলেন, ‘যেখানেই পাহাড় কাটা হচ্ছে, সেখানেই অভিযান চলছে। জরিমানা করা হচ্ছে। মামলা হচ্ছে। আইন প্রয়োগ করে পাহাড় কাটা বন্ধে সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হচ্ছে।’

বান্দরবানের পাহাড়ে ঠিকাদারের লোভী চোখ : বান্দরবানের নিজস্ব প্রতিবেদক মনু ইসলাম জানান, ব্যক্তিপর্যায়ে কিছুটা লাগাম টানা গেলেও বান্দরবানে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের নামে চলছে পাহাড় কাটার মচ্ছব। কখনো সড়ক, আবার কখনো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নির্মাণের আড়ালে পাহাড় কেটে সাবাড় করা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, বান্দরবান সদর, রোয়াংছড়ি, লামা, আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ির পাহাড়ের মাটি চলে যাচ্ছে ইটভাটায়। এক লামা উপজেলার ফাইতং ইউনিয়নেই রয়েছে ২৯টি ইটভাটা। এসব ইটভাটায় প্রতি মৌসুমে লাখ লাখ ট্রাক পাহাড়ি মাটি পোড়ানো হয়।

সাদা চোখে অবকাঠামো নির্মাণের জন্য পাহাড় কাটার আয়োজন মনে হলেও গভীর পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, চড়া দামে মাটি বিক্রিই পাহাড়খেকোদের আসল উদ্দেশ্য। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটার কারণে হাফেজঘোনা এলাকায় বিস্তীর্ণ জনপদ হুমকির মুখে পড়েছে। এক্সকাভেটর দিয়ে দিন-রাত পাহাড় কেটে পাশের একটি সামাজিক ও একটি ব্যক্তিগত অবকাঠামো ভরাটের পাশাপাশি প্রতিদিন ৮০ থেকে ১০০ ট্রাক মাটি পাচার করে চড়া দামে বিক্রি করা হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বান্দরবান পৌরসভার একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ‘খুব একটা প্রয়োজনীয় নয়’ এমন একটি প্রকল্পকে জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ ও অগ্রাধিকার দেখিয়ে এক কোটি ৩৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কৌশলে এই প্রকল্পের ঠিকাদারও মাটি বেচে বাগিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। ওই সূত্র দাবি করে, প্রকল্প বাস্তবায়ন করে লাভ করার জন্য নয়, মাটি বিক্রি করার অসৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার এই কাজটি হাতে নেন। ধারণা করা হচ্ছে, প্রকল্প বাস্তবায়ন করে ঠিকাদার যত টাকা লাভ করেছেন, মাটি বিক্রি করে তার দ্বিগুণ লাভ তুলে নিয়েছেন।

সূত্র জানায়, সাধারন কোনো এলাকা থেকে আনা অননুমোদিত মাটি ট্রাক প্রতি ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়। ঝামেলা না থাকায় লোকজন সরকারি প্রকল্পের মাটি কিনতে বেশি আগ্রহী হওয়ায় সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প থেকে নিয়ে আসা মাটি ট্রাক প্রতি আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়।

খাগড়াছড়িতে পাহাড় কাটছেন প্রভাবশালীরা : খাগড়াছড়ি থেকে আবু দাউদ জানান, খাগড়াছড়িতে দিনেদুপুরে চলছে পাহাড় কাটা। ঘরবাড়ি নির্মাণ, বিভিন্ন উন্নয়নকাজসহ ইটভাটায় যাচ্ছে এসব মাটি। রামগড় উপজেলার বল্টুরাম টিলা, সোনাইআগা, কালাডেবা, খাগড়াবিল, বলিপাড়াসহ বেশ কয়েকটি স্থানে কোথাও এক্সকাভেটর, আবার কোথাও ফেলোডার ব্যবহার করে চলছে পাহাড় লুট। এমনকি কৃষি জমির উপরিভাগের মাটিও কেটে নেওয়া হচ্ছে অবাধে। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীরা সিন্ডিকেট করে এসব অপকর্ম করে গেলেও দেখার কেউ নেই।

রামগড়ের কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এসব এলাকায় বুলডোজার ব্যবহার করে পাহাড় কাটা হচ্ছে। এসব মাটি এনে খাগড়াবিল, সোনাইপুল ও রামগড়ের বিভিন্ন সড়ক উন্নয়নে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ছাড়া গুইমারা ও মাটিরাঙ্গা উপজেলায়ও পাহাড়খেকোরা সক্রিয়। খাগড়াছড়ি সদরের শালবন, কুমিল্লা টিলা, সবুজবাগ এলাকায়ও মাঝে মাঝে ঘর নির্মাণের নামে পাহাড় কাটা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

এ ব্যাপারে খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, পাহাড় কাটা, টপসয়েল কাটা, অবৈধ বালু তোলা, বন উজাড়সহ পরিবেশ আইন পরিপন্থী কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে প্রশাসন সর্বোচ্চ মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে।

পার্বত্যমন্ত্রী যা বললেন : পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি বলেন, ‘বিগত সরকারগুলোর উদাসীনতার কারণে যুগ যুগ ধরে পিছিয়ে ছিল এই অঞ্চল। সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামকে দেশের অন্যান্য এলাকার মতো সাজানোর পরিকল্পনা নেওয়ায় এই অঞ্চলে গত ১২ বছরে বৈপ্লবিক উন্নয়ন হয়েছে। উন্নয়নের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকেই। পাহাড়ি এলাকায় সড়ক যোগাযোগ, পানি সরবরাহ প্রকল্প, হাসপাতাল, স্কুলসহ যেকোনো অবকাঠামো নির্মাণ করতে গেলে পাহাড় কাটা বা ভূমিরূপে কিছুটা পরিবর্তন আনতে হয়। তবে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে পাহাড় কাটার কারণে পরিবেশে যেন বড় ধরনের বিপর্যয় না ঘটে।’ তিনি আরো বলেন, ‘যেকোনো মূল্যে আমাদের পাহাড় রক্ষা করতে হবে। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পাহাড় কাটা যতটা সম্ভব কমানো যায়, এ ব্যাপারে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

পাঠকের মতামত: