ঢাকা,মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪

সরকারি পাহাড় বেচে কোটিপতি ওরা

সমকাল ::  চট্টগ্রামে সরকারি পাহাড় কেনাবেচা হচ্ছে স্ট্যাম্প দিয়ে! সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুরে পাহাড়ঘেরা সরকারি ৬২৩ একর জায়গা এভাবেই হয়ে গেছে ভাগবাটোয়ারা। ভুয়া স্ট্যাম্প তৈরি করে সাধারণ মানুষের কাছে প্রতিটি প্লট ৮ থেকে ১০ লাখ টাকায় বিক্রি করছে ৫০ থেকে ৬০ জনের একটি সিন্ডিকেট। সরকারি জায়গা বেচে এই সিন্ডিকেটের সবাই এখন কোটিপতি। পাহাড়ে এদের কথাই আইন। সীতাকুণ্ড ভূমি অফিস থেকে সহকারী কমিশনারের দেওয়া এক প্রতিবেদনেও এমনই বলা হয়েছে। সরকারি পাহাড় কীভাবে বেচাকেনা হয়েছে, তার বিবরণ উঠে এসেছে এই প্রতিবেদনে।

দুর্গম সলিমপুরে ৩৭টি পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হয়েছে দুটি আবাসিক এলাকা। এগুলোর মধ্যে ৩৪টি পাহাড় কেটে ৫৮৬ দশমিক ৬০ একর জায়গা দখল করে চট্টগ্রাম মহানগর ছিন্নমূল বস্তিবাসী সমন্বয় সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলেছে ১৩ হাজার ৯০০টি প্লট। আর আলী নগর সমবায় সমিতি লিমিটেড তিনটি পাহাড় কেটে ২৩৬ দশমিক ৩২ একর জায়গা দখল করে গড়ে তুলেছে প্রায় আড়াই হাজার প্লট। বায়েজিদ সংলগ্ন মাছেরঘোনা এলাকায় পাঁচ শতাধিক প্লট নিয়ে গড়ে উঠেছে আরেকটি আবাসিক এলাকা। একইভাবে সহস্রাধিক প্লটের আরেকটি আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে ইসলামপুরের উত্তরপাড়ায়।

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াছ হোসেন বলেন, ‘চট্টগ্রামের বিভিন্ন পাহাড় নানাজন নানা কৌশলে দখল করছে। কেউ কেউ সরকারি জায়গা ভুয়া স্ট্যাম্প দিয়ে বেচাকেনাও করছে। পরিবেশ অধিদপ্তরকে নিয়ে বিভিন্ন সময় অভিযান চালানো হয়। কিন্তু এদের পুরোপুরি রোধ করতে হলে দরকার রাজনৈতিক ও সামাজিক চাপ। সরকারি সব সংস্থা যদি একযোগে এগিয়ে আসে, তবে পাহাড় রক্ষা করা অনেক সহজ হবে।’

৪০ পাহাড়ে যেভাবে হলো ২০ হাজার প্লট :সীতাকুণ্ড উপজেলার জঙ্গল সলিমপুর মৌজার ১ নম্বর খাস খতিয়ানের বিএস ৩৫০ দাগে ২০০ দশমিক ১০ একর, ৩৫১ দাগে ৪৮ দশমিক ৫০ একর, ৩৫৫ দাগে ৭৪ দশমিক ৭৫ একর, ২০৩ দাগে ৪৩২ দশমিক ৯৯ একর, ২৭৮ দাগে ৩৯ দশমিক ৬৫ একর, ২০৩ দাগে ৪৩২ দশমিক ৯৯ একর এবং ২৭৮ দাগে ৩৯ দশমিক ৬৫ একর শ্রেণি পাহাড়; ৩৫২ দাগে ৩ দশমিক ৪০ একর, ২৬২ দাগে ৩ দশমিক ৭০ একর, ২৬২ দাগে ৩ দশমিক ৭০ একর এবং ২০২ দাগে ০ দশমিক ৯৯ একর শ্রেণি ছড়া; ২১২ দাগে ০ দশমিক ০৭ একর শ্রেণি নাল এবং ছুট খতিয়ানের ৩০৯, ৩৪৯, ৩০৭ দাগ ও ১৯ নম্বর খতিয়ানের বিএস ২০১ দাগে ১৮ দশমিক ৭৭ একর শ্রেণি পাহাড় সরেজমিন তদন্ত করে সীতাকুণ্ড ভূমি অফিস।
তদন্তে জানা যায়, ৩৪টি পাহাড় ও আটটি টিলা কেটে চট্টগ্রাম মহানগর ছিন্নমূল বস্তিবাসী সমন্বয় সংগ্রাম পরিষদ ১৩ হাজার ৯০০ প্লট তৈরি করে। এসব প্লটে আছে প্রায় আট হাজার ৯৫০টি পরিবার। এ ছাড়া তিনটি কেজি স্কুল, একটি প্রাইমারি স্কুল, একটি উচ্চ বিদ্যালয়, একটি কাঁচাবাজার ও প্রায় ৪০০টি দোকানও গড়ে তোলা হয়েছে এ এলাকায়। প্রতিটি পাহাড়ে ৪৭৬টি পরিবার আছে। এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যেতে এখানে ছয়টি ব্রিজ এবং ১৫টি কালভার্টও বানানো হয়েছে! একইভাবে ‘আলীনগর সমবায় সমিতি’ নামের আরেকটি সংগঠন তিনটি পাহাড় কেটে গড়ে তুলেছে প্রায় আড়াই হাজার প্লট। এসব প্লটে বসবাস করছে দুই হাজার পরিবারের প্রায় ১০ হাজার মানুষ। প্লটের পাশাপাশি এ সমিতির নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় পাহাড় কেটে একটি প্রাইমারি ও উচ্চ বিদ্যালয়, একটি মসজিদ ও একটি ইবাদতখানা গড়ে তোলা হয়েছে। এই সমিতির সদস্য সংখ্যা পাঁচ হাজার। প্রতিটি পাহাড়ের ভাজে ১৫ থেকে ২০টি করে পরিবার বসবাস আছে। চট্টগ্রাম মহানগর ছিন্নমূল বস্তিবাসী সমন্বয় সংগ্রাম পরিষদ স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও আলীনগর সমবায় সমিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণবিহীন।

জঙ্গল সলিমপুরের এই দখল সীতাকুণ্ড ছাড়িয়ে এখন প্রবেশ করেছে নগরের পাহাড়ে। বায়েজিদ সংলগ্ন এলাকায় পাহাড় বেচাকেনা করতে একইভাবে এখন গড়ে তোলা হয়েছে সহস্রাধিক প্লট। এটি ক্রমশ আরও বিস্তৃত হচ্ছে। জালালাবাদ থেকে সম্প্রসারিত হয়ে দখলদাররা এখন সক্রিয় আছে এশিয়ান উইমেন ইউনিভার্সিটি সংলগ্ন পাহাড়ে। এ এলাকায়ও বেচাকেনা হচ্ছে স্ট্যাম্পে।

সরকারি জায়গা বেচে কোটিপতি যারা :এসব পাহাড়ে রাজত্ব চলে দখলদারদের। জঙ্গল সলিমপুরে চট্টগ্রাম মহানগর ছিন্নমূল বস্তিবাসী সমন্বয় সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি গাজী সাদেকুর রহমান ও সেক্রেটারি কাজী মশিউর রহমান এবং ছলিমপুর ইউনিয়নের ওয়ার্ড সদস্য গোলাম গফুরের কথায় চলে ৩৪টি পাহাড়ের ৪০ হাজার বাসিন্দা। আবার আলীনগর সমবায় সমিতির তিনটি পাহাড়ে থাকা ১০ হাজার মানুষ মেনে চলে সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ হাকিম, সেক্রেটারি মো. ইয়াসীন ও ইয়াসীনের ভাই মো. ফারুকের নির্দেশকে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, এদের কথা ছাড়া পাতাও নড়ে না ৩৭ পাহাড়ে। সরকারি পাহাড় স্ট্যাম্পে বিক্রি করে এরা সবাই এখন কোটিপতি। কেউ কেউ হয়েছেন জনপ্রতিনিধিও। তবে শুরুতে এসব পাহাড়ে একক আধিপত্য ছিল আলী আক্কাসের। র‌্যাবের ক্রসফায়ারে তার মৃত্যু হলে রোকন উদ্দিন, কসাই নাছির হয়ে ক্ষমতার পালাবদল হয় মশিউর ও ইয়াসীনের হাতে। ক্ষমতা পোক্ত করতে এরা সহযোগী হিসেবে রেখেছে ইয়াকুব, আনোয়ার হোসেন নয়ন, খোকরা শাহজাহান, নুরুল হক ভাণ্ডারি, আল আমীন, মিজান, জামাল শেখ, আরমান, রফিক, শাহ আলম, আকতার, আইনুল, ধামা জাহাঙ্গীরসহ ৫০ থেকে ৬০ জনকে।

মাছেরঘোনা এলাকায় পাহাড় কেটে তৈরি করা সহস্রাধিক প্লট বেচাকেনা করে কোটিপতি হয়েছে শাহজাহান বাদশা, আরিফ, জামাল ও কামালরা। বসতঘরের পাশাপাশি তারা পাহাড়ে তুলেছে দোকানপাটও। শাহজাহান বাদশা বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে রাজত্ব করা আরিফের সঙ্গেও গভীর সখ্য তার।

পাহাড় বেচাকেনা করে কোটি টাকার মালিক হয়েছেন কাছিয়ানগর বাস্তুহারা সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ নাছির ও সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান। এদের সহযোগী হিসেবে আছে আজহার, শামসুল, মাবুদ, ছাবের, নুরুল ইসলাম ও বেলাল হোসেন।

কে কী বলেন : চট্টগ্রামে দখল হওয়া পাহাড়ের বেশিরভাগ সীতাকুণ্ড ও হাটহাজারীতে। আগে সীতাকুণ্ড ভূমি অফিসে দায়িত্ব পালন করা মোহাম্মদ রুহুল আমীন এখন হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। পাহাড় বেচে অনেকের কোটিপতি হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘সীতাকুণ্ড ভূমি অফিসে সহকারী কমিশনারের দায়িত্ব পালন করার সময় জঙ্গল সলিমপুর ও আলীনগরে পাহাড় বেচাকেনা করে কীভাবে শত শত প্লট তৈরি করা হয়েছে সে ব্যাপারে প্রতিবেদন দিয়েছিলাম ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে। হাটহাজারী অংশেও পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে সোচ্চার আছি। সরকারি পাহাড় স্ট্যাম্পে বেচাকেনার কোনো বৈধতা নেই। সরল বিশ্বাসে তবু অনেকে পাহাড়ে প্লট কিনছে আর প্রতারিত হচ্ছে।’
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল্লাহ নূরী বলেন, ‘জাল কাগজপত্র তৈরি করে পাহাড়ে প্লট বেচাকেনা করছে অনেকে। কিন্তু এগুলোর কোনো বৈধতা নেই। সরকারি পাহাড় বেচাকেনা করার অধিকার নেই কারোরই।’

পাহাড় কাটায় সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে ১নং জঙ্গল সলিমপুর ওয়ার্ডের মেম্বার গোলাম গফুর বলেন, ‘সরকারি জায়গা যাতে কেউ বেচাকেনা করতে না পারে জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাতে বাধা দিই। আমি পাহাড় বেচাকেনার সঙ্গে কখনোই যুক্ত ছিলাম না। যারা এর সঙ্গে যুক্ত তারা আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। আমি কোটি টাকার মালিক নই। শহরে আমার বাড়িগাড়িও নেই। তবে পাহাড় বেচাকেনার সঙ্গে যুক্ত অনেকের শহরে বাড়ি গাড়ি আছে।’

পাঠকের মতামত: