ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

৬ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করতে ১৫ পাহাড় সাবাড়!

জে. জাহেদ, চট্টগ্রাম ::  নগরীতে ছয় কিলোমিটার সড়ক তৈরি করতে সাবাড় করা হয়েছে ১৫টি পাহাড়। ছোট্ট একটি সড়ক করতে এত বেশি পাহাড় কাটার ঘটনা অতীতে কখনই ঘটেনি।

পরিবেশ অধিদপ্তর বারবার জরিমানা করার পরও ফৌজদারহাট-বায়েজিদের এই সংযোগ সড়ক তৈরি থেকে পিছু হটেনি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক বা সিডিএ)। আইনের তোয়াক্কা না করেই সরকারি সংস্থাটি প্রকল্পটি প্রায় শেষ করে ফেলেছে।

পরিবেশবিদরা বলছেন, সরকারি সংস্থার পরিবেশ ও আইনের প্রতি এমন অবজ্ঞা বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। বিশিষ্ট পরিবেশবিদ অধ্যাপক মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী বলেন, ‘পাহাড়, জলাশয়সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক স্থান রক্ষা করে পরিকল্পিত উন্নয়নের দায়িত্ব চউকের। তারা যদি পাহাড় রক্ষা না করে উল্টো তা কেটে সাবাড় করে, তা সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।’

তিনি বলেন, চউক চাইলে এ সড়কটি বিকল্প পথেও করতে পারত। পাহাড় রক্ষা তাদের অগ্রাধিকারে থাকলে বিকল্প ভাবত তারা।

ইমারত ও আবাসন প্রকল্প অনুমোদনের দায়িত্বে রয়েছে চউক। কিন্তু ঢাকা ট্রাঙ্ক রোডের সঙ্গে বায়েজিদ বোস্তামী রোডের সংযোগ ঘটাতে পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়াই তারা পাহাড় কাটতে শুরু করে। নগরীর বায়জিদ আরেফিন নগর ও সীতাকুণ্ডে পাহাড় কেটে এই বাইপাস সড়কটি তৈরি করছে তারা। আউটার রিং রোডের অংশ হিসেবে ঢাকা ট্রাঙ্ক রোডের সঙ্গে বায়েজিদ বোস্তামী রোডের সংযোগ ঘটাবে এ সড়ক।

অনুমতি ছাড়া পাহাড় কাটায় চউককে নোটিশ দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। তাদের নোটিশের জবাবে শুনানিতে অংশ নিয়ে পাহাড় কাটার কথা স্বীকারও করে চউক। তার পরও পাহাড় কাটা অব্যাহত রাখায় ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এর পরও থেমে থাকেনি পাহাড় কাটা। শেরশাহ বাংলাবাজার থেকে শুরু হয়ে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইম্যান পর্যন্ত এসব পাহাড় কেটেছে তারা।

উত্তর পাহাড়তলী মৌজার ৭৭৩-৭৭৪, ৩০১, ২০০, ১৯৮, ১৩৯, ১৯৫, ১৮৭; জঙ্গল সলিমপুর মৌজার ৩৬১, ৩৫৯, ৩৫৭-৩৫৮ এবং জঙ্গল লতিফপুর মৌজার ৬২, ৬০-৬২ ও ৩৪নং দাগের পাহাড় কেটে এ সড়ক তৈরি করেছে চউক। প্রকল্প চলাকালে পরিবেশ অধিদপ্তর এটি নিয়ে একটি সরেজমিন রিপোর্টও তৈরি করে। এ রিপোর্টে তখন বিভিন্ন মৌজার ৩৫৭, ৩৫৮ এবং ৩৫৯ দাগের পাহাড় কাটার প্রমাণও পায় তারা। তবে এ নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের কেউ নিজ নামে কথা বলতে রাজি হননি।

সরেজমিন দেখা যায়, এই সংযোগ সড়ক তৈরি করতে গিয়ে নির্বিচারে পাহাড় কেটেছে চউক। উত্তর পাহাড়তলীতে পাশাপাশি তিনটি পাহাড়ে চালিয়েছে বুলডোজার। জঙ্গল সলিমপুর মৌজার পাহাড়গুলো এমনভাবে কাটা হয়েছে যে, সামান্য বৃষ্টিতেই পাহাড়ধসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। খাড়াভাবে কাটার পর এসব পাহাড়ের পাদদেশে কোনো গাছও লাগানো হয়নি।

বুলডোজারের চিহ্ন এখনও দেখা যাচ্ছে জঙ্গল লতিফুর মৌজার পাহাড়ে। রাস্তার পাশে ড্রেন করা হলেও পাহাড় বেয়ে নেমে আসা পুরো পানি নিস্কাশন হওয়ার সুযোগ কম। আর পানি সরে যাওয়ার পথ না পেলে বর্ষা মৌসুমে এই সড়কে ঘটতে পারে পাহাড়ধসের ঘটনা।

এভাবে পাহাড় কাটার জন্য চউককে একাধিকবার জরিমানা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। সর্বশেষ পাহাড়কে ৪৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে কেটে গাছ লাগিয়ে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়ার শর্তও দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। এই নির্দেশনাও মানা হয়নি। ৯০ ডিগ্রি খাড়াভাবে পাহাড় কেটেছে চউক। সড়কের কোনো কোনো অংশে তাই সোজা দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়।

পাহাড় কেটে সড়ক তৈরির কথা স্বীকার করে চউকের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী রাজীব দাশ চকরিয়া নিউজকে বলেন, প্রকল্পের প্রায় ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এখন ড্রেনের কাজ চলছে। রেলওয়ে ওভারপাস এবং রাস্তার সামান্য কাজ বাকি রয়েছে। চলতি মাসের শেষ দিকে অথবা ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই ফৌজদারহাট-বায়েজিদ রোডে পরীক্ষামূলকভাবে গাড়ি চলাচলের কাজ শুরু হবে বলে তারা আশাবাদী।

তিনি দাবি করেন, এ সড়কটি নির্মিত হলে চট্টগ্রাম শহরের যানজট অনেকাংশে কমে যাবে। সিটি গেট দিয়ে ঢুকে পুরো শহর ঘুরে এখন আর কোনো গাড়িকে বায়েজিদ কিংবা অক্সিজেন যেতে হবে না। বিকল্প এ সড়ক দিয়ে ১০ মিনিটের মধ্যে বায়েজিদ এলাকায় যেতে পারবে যে কেউ। সড়কটি শিগগিরই পরীক্ষামূলকভাবে চালু হলেও জনসাধারণের জন্য এটি আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মুক্ত করতে আরও তিন থেকে চার মাস লেগে যেতে পারে।

পরিবেশ অধিদপ্তর আগে জরিমানা করলেও পরে তাদের নির্দেশনা মেনে প্রকল্প শেষ করা হয়েছে বলে দাবি করেন এই পরিচালক। পাহাড়গুলো আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে নতুন করে গাছ লাগানোর পরিকল্পনা আছে বলেও জানান তিনি। তবে কর্তিত পাহাড়ে নতুন করে গাছ লাগিয়ে এটিকে আগের অবস্থায় ফেরানো যাবে না বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা।

পাঠকের মতামত: