শহিদুল ইসলাম, উখিয়া :: সব ধরনের প্রস্তুতির পরও শেষ মুহূর্তে এসে বহুল প্রত্যাশিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কার্যক্রম আবারও স্থগিত করা হয়েছে।এর আগে গত বছরের ১৫ নভেম্বর একই রকমের একটি প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ রোহিঙ্গাদের অনাগ্রহের কারণেই ভেস্তে যায়।
আজ বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে নয়াপাড়া-২৬ নং ক্যাম্পে কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম েএবং ঢাকাস্থ চীন দূতাবাসের দুজন প্রতিনিধি এবং মিয়ানমার দূতাবাসের এক জন প্রতিনিধি সংক্ষিপ্ত ব্রিফিংয়ে করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন স্থগিত করেন।
তিনি বলেন, “আজ প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য রোহিঙ্গাদের সীমান্তে পৌঁছে দেয়ার জন্য সব ধরণের প্রস্তুতি রাখা হয়েছিলো। কিন্তু সেখানে কোন রোহিঙ্গা আসেনি”।
এ খবরে স্থানীয় লোকজনকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেলেও ওই এলাকার রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী ও কতিপয় এনজিওগুলোর মাঝে কিছুটা স্বস্তির আভাস পাওয়া গেছে।
“এ পর্যন্ত ২৯৫টি পরিবারের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। যাদের কেউই মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেনি,” তিনি বলেন।
তবে এই কর্মসূচী অব্যাহত থাকবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত বাস ও ট্রাকগুলো উপস্থিত থাকবে সেখানে। প্রত্যাবাসনে আগ্রহী কোন শরণার্থী এলেই পরিবহণগুলোতে করে তাদের সীমান্তে পৌঁছে দেয়া হবে।
তিনি জানান, প্রত্যাবাসনের তালিকায় মোট ১০৩৭টি পরিবার রয়েছে। তাদের মতামত নেয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। এর ফলে খতিয়ে দেখা হবে যে, তাদের মধ্যে কেউ ফিরে যেতে রাজি হয় কিনা।
তবে কাউকে জোর করে ফেরত পাঠানো হবে না বলেও জানান তিনি।
সরেজমিন টেকনাফের শালবন ক্যাম্প ঘুরে দেখা যায়,গত দুইদিনে প্রত্যাবাসনের জন্য স্বাক্ষাত দেওয়া রোহিঙ্গাদরে কেউই ভয়ে ক্যাম্পে অবস্থান করিনি।রাতেই তারা অন্যত্র আত্বগোপনে চলে যায়। তবে ক্যাম্পের তালিকাভূক্ত জাফর আলম,ইয়াছমিন,কলিম উল্লাহ,মো: শাকেত বলেন,রাখাইনে সেনাবাহিনীর অনেক জুলু- নির্যাতন সহ্য করেছি।শেষ পর্যন্ত প্রাণ ভয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছি। এজন্য শেখ হাসিনা সরকারকে আমরা অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই।তাই তিনি যেন আমাদের আর বিপদের মুখে ঠেলে না দেন।
তারা আরও বলেন,আমরা এদেশে থাকতে চাইনা।স্বদেশে ফেরত যেতে চাই। কিন্তু আমাদের মিয়ানমারে সরাসরি নাগরিকত্ব প্রদান, রোহিঙ্গাদের ভিটে বাড়ি ও জমিজমা ফেরত,চলাচলের স্বাধীনতা, কারাগরে বন্ধি রোহিঙ্গাদের মুক্তি দিলেই তবে মিয়ানমারে ফেরত যাব।অন্যথায় নয়। তারা চীনের প্রত্যাবাসনের ভূমিকায়ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
এদিকে, বাংলাদেশ সীমান্তের ঘুমধুম সীমান্ত বহুল প্রত্যাশিত রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু ফেরত পাঠাতে উভয় দেশের কর্মকর্তাদের তৎপরতা লক্ষণীয় ছিল। উখিয়ার বালুখালী থেকে ঘুমধুম সীমান্তের মৈত্রী সেতু পর্যন্ত দুই কিলোমিটার নবনির্মিত মৈত্রী সড়কজুড়ে সীমান্তরক্ষী বিজিবি সদস্যদের সকাল থেকে কড়া নজরদারিতে থাকতে দেখা গেছে।
এর আগে সকাল সাড়ে ১১ টার দিকে বিজিবি কক্সবাজার সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান ঘুমধুম সীমান্তে আসেন।এরপর কক্সবাজার-৩৪ বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল আলী হায়দার আলী আজাদ সকাল থেকে ঘুমধুম বিজিবি বিওপিতে অবস্থান করেন।এছাড়া বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বাংলাদেশের ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার সীমান্তে রোহিঙ্গাদের অভ্যর্থনা জানাতে সেদেশের কেন্দ্রীয় ও রাখাইন প্রাদেশিক মন্ত্রীর নেতৃত্বে উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা অবস্থান করেন।এসময় তাদের সঙ্গে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা, উন্নয়ন সংস্থা, রেড ক্রস সহ সংশ্লিষ্টরাও ছিলেন।
পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের ঢেকিবনিয়া জিরো পয়েন্ট থেকে তুমব্রু লেটওয়ে ট্রানজিট ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি রাখা হয়।এরপর মিয়ানমারের ঢেকিবনিয়া সীমান্ত থেকে তুমব্রু ট্রানজিট ক্যাম্পে নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ট্রান্সপোর্টও ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আর মিয়ানমারের দেওয়া ছাড়পত্র অনুযায়ী টেকনাফের শালবন ক্যাম্পের ১ হাজার ৩৭টি পরিবারের মোট ৩ হাজার ৫৪০ জনকে ফেরত নেওয়ার প্রথম তালিকাটি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে গত দুই দিনে ৩১৬টি রোহিঙ্গা পরিবারের ৩৩৯৯ জনের মতামত নেওয়া হয়েছে। তাদের অনেকেই সম্মতি দিয়েছেন মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার জন্য।
রোহিঙ্গাদের বহন করতে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাচটি বাস ও তিনটি ট্রাক মজুদ করা হয়েছিল।
এসময় কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে: র্কনেল আলী হায়দার আজাদ আহমেদ বলেন প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য নাইক্ষ্যছি ড় উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তে বিজিবি সদস্যদের মোতায়েন করা হয়।
রোহিঙ্গা ফেরত কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে চীনের দু’জন,মিয়ানমার দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক র্কমর্কতা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরের অবস্থান করেন।একই সঙ্গে মার্কিন দূতাবাসের অপর তিন কর্মকর্তাও কক্সবাজার অবস্থান করেন।পুরো প্রক্রিয়াটি পর্যবেক্ষণের সঙ্গে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিভিন্ন স্থাপনা দেখবেন তারা।
এছাড়া মিয়ানমারের ওপারে দেশটির উচ্চ পর্যায়ের দুটি দল সীমান্তে অবস্থান করে বলে কক্সবাজার শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম সত্যতা নিশ্চিত করেন।
অন্যদিকে প্রত্যাবসনের দিন কতিপয় এনজিওগুলোর ইন্ধনে টেকনাফের শালবন রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু রোহিঙ্গা বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্য থাকলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্হা গ্রহন করায় তা সম্ভব হয়নি।
জানা যায়,২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোগত সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে নতুন করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ৭ লাখেরও বেশি মানুষ।তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত নানা অজুহাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেওয়া অন্তত সাড়ে ৩ লাখ রোহিঙ্গা। সব মিলে বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১২ লাখের কাছাকাছি।
এসব রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক চাপের মূখে মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে একাধিক চুক্তি করে।রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থা -ইউএনডিপি ও শরণার্থী সংস্থা – ইউএনএইচসিআর এর সঙ্গে মিয়ানমার ত্রিপক্ষীয় চুক্তিও করে।
সর্বশেষ জুলাই মাসে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে নতুন করে উদ্যোগের অংশ হিসেবে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব মিন্ট থোয়ের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধি দল।
১৯ সদস্যের দলটি দুই দিন ধরে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনা ও বৈঠক করে। ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু হতে পারে।
শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম জানিয়েছেন, ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সার্বিক পরিস্থিতি জানার জন্য বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের দূতাবাসের দুইজন ও মিয়ানমারের একজন কর্মকর্তা কক্সবাজারে এসেছেন।
এছাড়া মার্কিন দূতাবাসের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাউন্সিলর, আঞ্চলিক রিফুউজি কো-অর্ডিনেটর সহ তিনজন কর্মকর্তা রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে রয়েছেন। তারা তাদের মতো করে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করবেন।
আবুল কালাম আরও বলেন, ‘মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে। আমরা এই তথ্যটি রোহিঙ্গাদের জানিয়েছি।তাদের অনেকে সম্মতি দিয়েছেন মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার জন্য। তবে কতজন রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন হবে সেটি এখন নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
তবে এ রিপোর্ট লেখাকালীন পযর্ন্ত রোহিঙ্গাদের স্বাক্ষাতকার অব্যাহত রয়েছে।২২ আগস্ট ৩১৬টি রোহিঙ্গা পরিবারের ৩৩৯৯ জনের স্বাক্ষাতকার নেয়া হয়েছে।
পাঠকের মতামত: