ঢাকা,শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

৯০% ফার্মেসিতেই ওষুধ সংরক্ষণে চরম বিশৃঙ্খলা

farmeci

অনলাইন ডেস্ক ::

সাধারণ ওষুধ প্যারাসিটামলের ব্যবহার চলে ঘরে ঘরে। জ্বর কিংবা হালকা ব্যথা মানেই প্যারাসিটামল।

ট্যাবলেট, পাউডার, সিরাপ কিংবা সাপোজিটর ফরমেটে দেশে দেড় শটির বেশি প্রতিষ্ঠান আলাদা ব্র্যান্ড নামে এই ওষুধটি উৎপাদন ও বাজারজাত করছে। গ্যাস্ট্রিকের ওষুধও ব্যবহার করা হয় ঘরে ঘরে। তবে ফার্মেসির বিক্রেতাদের বেশির ভাগেরই এসব ওষুধ সংরক্ষণের যথাযথ নির্দেশনা কিংবা ঠিক কী ধরনের তাপমাত্রায় এই ওষুধ সংরক্ষণ করতে হয়, সে সম্পর্কে ধারণা নেই। ফলে যেনতেনভাবে এসব ওষুধ সংরক্ষণ করে তারা।

 ওষুধ বিশেষজ্ঞরা জানান, বাংলাদেশে প্রস্তুত প্যারাসিটামল সাধারণত ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে, ঠাণ্ডা ও শুকনো স্থানে আলোর আড়ালে রাখতে হয়। গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ ওমেপ্রাজল সংরক্ষণ করতে হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার নিচে আলোহীন, শুকনো ও ঠাণ্ডা স্থানে। কিন্তু দেশে গরমের সময়ে যখন তাপমাত্রা ২৫-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে থাকে কিংবা টিনের ঘরে এর তাপ আরো বেশি থাকে তখন অনেকেই ওষুধের তাপমাত্রার কথা ভাবে না।

সব ওষুধের বক্স, কার্টন বা স্ট্রিপের গায়ে বাংলা ও ইংরেজিতে সংরক্ষণের নির্দেশনা লেখা থাকে। এ ক্ষেত্রে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের নির্দিষ্ট বাধ্যবাধকতাও রয়েছে, যা ওষুধ প্রস্তুতকারী কম্পানি, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কিংবা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের জন্যও একইভাবে প্রযোজ্য।

এমনকি ভোক্তা বা ব্যবহারকারীরা যাতে ওষুধ সংরক্ষণে নির্দেশনা মেনে চলতে পারে সে জন্য ওষুধের সব ধরনের মোড়কের গায়ে সতর্কতামূলক নির্দেশনা দেওয়া থাকে। তবে শেষ পর্যন্ত কোনো নির্দেশনাই যথাযথভাবে

 পালন করা হয় না বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। ফলে তাপমাত্রার বিষয়ে স্পর্শকাতর অনেক ওষুধই রোগীর জন্য ফলদায়ক হয় না। বরং কোনো কোনো ওষুধ উল্টো ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

সারা দেশে যাচ্ছেতাইভাবে চলে ওষুধের কেনাবেচা ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিস্থিতি এতটাই ভয়ানক হয়ে উঠেছে যে দেশের ১০ শতাংশেরও কম ওষুধের দোকানে সঠিকভাবে তাপমাত্রা ব্যবস্থাপনা কার্যকর আছে, বাকি সবটাই চলছে বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্য দিয়ে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরও চেষ্টা চালাচ্ছে। চালু করেছে মডেল ফার্মেসি ব্যবস্থা। কিন্তু এ প্রক্রিয়াও এগোচ্ছে ধীরগতিতে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা ওষুধের তাপমাত্রাসহ আরো কিছু বিষয় নিয়ে একটি সার্ভে করছি। এর কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। তবে যতটুকু হয়েছে তাতে দেখছি, ৯০ শতাংশের বেশি ওষুধের দোকানই ওষুধ সংরক্ষণ ও সরবরাহ ব্যবস্থায় চরম গাফিলতি করছে। তাপমাত্রার দিকে তাদের তেমন কোনো নজরই নেই। তারা অন্য সব ব্যবসার মতোই ওষুধের ব্যবসা করে যাচ্ছে। এমনকি দু-একটি বিশেষ ওষুধ ছাড়া বাকি ওষুধের তাপমাত্রা সংরক্ষণে তাদের কোনো ধারণাও নেই। ’

আ ব ম ফারুক জানান, বেশির ভাগ ওষুধের কার্যকারিতার সঙ্গে তাপমাত্রার সম্পর্ক রয়েছে। যদি সঠিক তাপমাত্রায় এসব ওষুধ সংরক্ষণ করা না হয় তবে ওই ওষুধের ওপরের মোড়ক, স্ট্রিপ কিংবা বোতল যতই চকচকে থাকুক না কেন, মেয়াদ যত দিনই থাকুক না কেন ভেতরের গুণাগুণ নষ্ট হওয়া স্বাভাবিক। কিছু ওষুধ গলে যেতে পারে কিংবা রং বদলে যেতেও দেখা যায়। বাকি ওষুধের গুণাগুণ সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব হয় না। এসব ওষুধ সেবনে কাজের কাজ কিছুই হয় না। এর মাধ্যমে রোগীরা আসলে এক রকম প্রতারিত হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে নষ্ট ওষুধের কারণে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার শিকার হয় অনেকে।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশে বর্তমানে লাইসেন্সধারী অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের ফার্মেসির সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। এর মধ্যে গত বছর থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত ১৮০টি মডেল ফার্মেসি চালু করা হয়েছে। এসব মডেল ফার্মেসি আন্তর্জাতিক সব প্রটোকল মেনে চলছে। খুচরা ওষুধ বেচাকেনায় বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে এই মডেল ফার্মেসি স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এসব ফার্মেসি পরিচালিত হচ্ছে ন্যূনতম গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের দিয়ে। এ পর্যায়ে প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে দুই ক্যাটাগরির দুই হাজার ২০০টি মডেল ফার্মেসি চালুর কাজ চলছে। পর্যায়ক্রমে এ সংখ্যা আরো বাড়বে। এ জন্য গাইডলাইন তৈরি করে দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক রুহুল আমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশের বেশির ভাগ ফার্মেসিতেই উপযুক্ত ফার্মাসিস্ট থাকে না। ক্রেতাদের ওষুধ সম্পর্কে কোনো রকম ব্রিফ করে না। ফলে ওষুধ সেবনে রোগীরা বিভ্রান্তিতে থাকে। এ ছাড়া বেশির ভাগ ফার্মেসিতে ওষুধের তাপমাত্রা সঠিকভাবে সংরক্ষিত হয় না। অনেক ওষুধ নষ্ট হয়ে যায়।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্র জানায়, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ফার্মাসিস্টদের প্রশিক্ষণের নামে তিন দিন বা এক সপ্তাহের নামমাত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের ‘সি’ ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্ট হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হয়। এসব বিক্রেতা ওষুধের তাপমাত্রা বা অন্য নিয়ম-কানুন সম্পর্কে ভালোভাবে নিজেরাও যেমন জানে না, ক্রেতাদেরও জানাতে পারে না। যদিও আগের তুলনায় এখন ফার্মেসিগুলোর ওপর ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের নজরদারি অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে নিয়মিত পরিদর্শন করা হচ্ছে এবং ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আর লাইসেন্স দেওয়া ও নবায়নের ক্ষেত্রেও আগের তুলনায় অনেক কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

ওষুধ বিশেষজ্ঞরা জানান, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, অনেক ওষুধ একসঙ্গে একই তাপমাত্রার পরিবহনে বহন করা হয়। কিন্তু ওই সব ওষুধের ভেতরে অনেকগুলোরই ভিন্ন ভিন্ন তাপমাত্রা অপরিহার্য। সেদিকে খেয়াল রাখা হয় না। ওষুধের দোকানগুলোতেও একই তাপমাত্রায় অনেক ওষুধ রাখা হয়। এসব দোকানে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির ওপরে গেলেও যেখানে যেভাবে ওষুধ রাখা হয়, তাপমাত্রা নিচে থাকলেও একইভাবে তা সংরক্ষণ করা হয়, যা খুবই বিপজ্জনক।

অধ্যাপক আ ব ম ফারুক আগের একটি জরিপের চিত্র তুলে ধরে বলেন, ‘ওই জরিপের ফলাফল দেখে আমরা বিস্মিত। কোনো দেশে মানুষের জীবনরক্ষাকারী ওষুধ নিয়ে এমন বিশৃঙ্খল অবস্থা থাকতে পারে, এটা ভাবাও যায় না। জরিপে দেখেছি, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মুদির দোকান, চায়ের দোকানেও অনেকে ফার্মেসি খুলে বসেছে। এসব ওষুধ বিক্রেতার বেশির ভাগই ওষুধ বিক্রির জন্য সরকারি কোনো সনদ বা অনুমোদন তো নেই-ই এমনকি ওষুধ সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণাও নেই। তারা ওষুধের তাপমাত্রা বা অন্য বিষয়ে মোটেই অবহিত নয়। ’

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্র জানায়, এর আগে অধিদপ্তর থেকে চিঠি দিয়ে সারা দেশে ওষুধের তাপমাত্রা সঠিকভাবে অনুসরণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন সেটা পালিত হলেও পরে আবার বিশৃঙ্খল অবস্থা শুরু হয়। তবে এখন আবার সব নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

 

পাঠকের মতামত: