কক্সবাজার প্রতিনিধি ::
রামু উপজেলার এগার ইউনিয়নে প্রায় ৭০ হাজার বাসিন্দা ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাহাড়ে বসবাস করছে। পাহাড়ধসে হতাহতের ঘটনা ঘটলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো নজরদারি নেই। ফলে পাহাড় ধসে অপমৃত্যুর ঘটনা মাটির নিচে চাপা পড়ে। টানা কয়েক ঘণ্টা বৃষ্টি হলেই পাহাড় ধসের আতঙ্কে থাকে এসব মানুষ। পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের নিয়ে প্রশাসনের কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ না করায়, দিন দিন বেড়েই চলছে পাহাড়ের বসতি।
সম্প্রতি রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের পানেরছড়া লম্বাঘোনা এলাকায় পাহাড়ধসে প্রাণ হারায় ২ বছরের শিশু মোর্শেদ আলম। মোর্শেদ আলম ওই এলাকার জাকের হোসেনের ছেলে। এ ঘটনায় জাকের হোসেনের বসতবাড়িটিও মাটিচাপায় বিধ্বস্ত হয়।
পরিবেশবাদীরা অভিযোগ করেছেন, স্থানীয় প্রভাবশালীরাই পাহাড় দখল করে অবৈধভাবে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি গড়ে তুলে ভাড়া ও দখলস্বত্ব বিক্রি করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
রামু উপজেলার জোয়ারিয়ানালা, কাউয়ারখোপ, দক্ষিণ মিঠাছড়ি, রাজারকুল, গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া, রশিদনগর, ঈদগড় ও খুনিয়াপালং ইউনিয়নে ১৫ হাজারেরও বেশি পরিবার পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। এসব ইউনিয়নের ৭০ হাজারেরও বেশি বাসিন্দার জীবন ঝুঁকিপূর্ণ।
কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সাইফুল আশ্রাব জানান, ভূমিহীন, ছিন্নমূল পরিবার, রোহিঙ্গারাই মূলত সরকারি বনভূমি ও খাস পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। স্থানীয় প্রভাবশালীরাও সরকারি জায়গা দখল করার জন্য ভূমিহীন, ছিন্নমূল মানুষদের ব্যবহার করে। তিনি বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। রামুর বিভিন্ন স্থানের পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের মধ্যে ২০ পরিবারকে সনাক্ত করা হয়েছে।
রামু কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের লট উখিয়ার ঘোনা এলাকায় দেখা যায়, রামু-নাইক্ষ্যংছড়ি সড়কের পাশে পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে প্রায় অর্ধশত পরিবার। পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাসকারী স্থানীয় আবদু শুক্কুরের মেয়ে খতিজা বেগম বলেন, অনেক বছর আগে থেকে তার বাবা পাহাড়ের ওপরে বসতঘর নির্মাণ করে বসবাস করে আসছে। স্থানীয় জসিম উদ্দিনের সাথে বিয়ে হওয়ার পর উঁচু পাহাড়ের মাঝামাঝি জায়গায় বাড়ি নির্মাণ করে তারাও বসবাস করছে। তাদের যাওয়ার আর কোন জায়গা নেই, তাই বাধ্য হয়ে পাহাড়েই থাকতে হচ্ছে। রামু-নাইক্ষ্যংছড়ি সড়ক হয়ে লট উখিয়ার ঘোনা সড়কে ঢুকতেই দেখা যায়, সরকারি উচু পাহাড় কেটে ফেলার ভয়াবহ চিত্র। ওই কাটা পাহাড়ের ওপরে বিপদজনকভাবে নির্মাণ করা হয়েছে একটি কাঠের বাড়ি। স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘদিন আগে আসা রোহিঙ্গা নুরুল হক পাহাড়ের ওপর ওই বাড়িটি করেছেন। সে পাহাড়ের মাটি বিক্রিতেও জড়িত।
রামুর মুক্তিযোদ্ধা মোজাফ্ফর আহমদ বলেন, বৃক্ষনিধন করে নির্বিচারে পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন ও পাথর উত্তোলনও অনেক সময় ধসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়নের পাহাড়ি অঞ্চল পূর্ব জোয়ারিয়ানালা মুরাপাড়া, কাঁঠাল বাগান, জুমছড়ি, নন্দাখালী মুরাপাড়া, উত্তর মিঠাছড়ি পাহাড়ীয়াপাড়া, হাসপাতাল পাহাড়, গুচ্ছগ্রাম, পূর্ব নোনাছড়ি পাহাড়িয়া পাড়া ও রমনিপাহাড় এলাকায় বসবাস করছে প্রায় চার হাজার পরিবার। কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের লট উখিয়ারঘোনা ঝর্ণারমুরা, মুরারকাচা, টেইলাপাড়া, নাপিতাঘোনা, গোদামকাটা, কালারঘোনা, লামারপাড়া, পূর্ব কাউয়ারখোপ, পূর্ব মনিরঝিল পাহাড়িয়া পাড়া, মধ্যম মনিরঝিল চাককাটা, সোনাইছড়ি, পশ্চিম মনিরঝিল দরগাপাড়া, মধ্যম কাউয়ারখোপ, মইশকুম ও উখিয়ারঘোনা এলাকায় অন্তত দেড় হাজার পরিবার পাহাড়ি এলাকায় বসবাস করছে। দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের লম্বাঘোনা, চেইন্দা, শিয়াপাড়া, খরুলিয়াছড়ি, জিনরঘোনা, পানেরছড়া পশ্চিমকুল, সমিতিপাড়া, কালা খন্দকারপাড়া, ঘোনারপাড়া ও মোরাপাড়া এলাকার পাহাড়ে প্রায় পাঁচশ পরিবার বসবাস করছে। গত বছর বর্ষায় চেইন্দা এলাকায় পাহাড় ধ্বসে মাটি চাপা পড়ে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে বলেও জানান, দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. ইউনুচ ভূট্টো।
রাজারকুল ইউনিয়নের ভিলিজার পাড়া, ঘোনারপাড়া, হাতিরঘোনা, পঞ্জেখানা, ঢালারমুখ, ছাগলিয়াকাটা, কাট্টলিয়া পাড়া, পশ্চিম ঘোনার পাড়া, চৌকিদার পাড়া, দক্ষিণ সিকদার পাড়া ও পাহাড়তলী এলাকায় দুই হাজার পরিবার পাহাড়ে বসবাস করছে। তম্মধ্যে পাহাড়তলী এলাকাটা ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানান রাজারকুল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মুফিজুর রহমান। স্থানীয়রা জানান, এসব এলাকার বনাঞ্চলের বৃক্ষনিধন, পাহাড় ও টিলার মাটি কেটে বসতি স্থাপনকারী অধিকাংশই মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিক।
পরিবেশ সাংবাদিক ফোরাম রামু’র সভাপতি খালেদ শহীদ জানান, রামু উপজেলার পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে পুর্নবাসন বা অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার কাজ আজ পর্যন্ত চোখে পড়েনি। সরকারিভাবে নজরদারি না থাকায় পাহাড়ে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে মানুষের বসবাস বেড়েই চলছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. লুৎফুর রহমান জানান, পাহাড়ে কত সংখ্যক লোক বসবাস করে, কত পরিবার পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভাবে বসবাস করছেন, এমন তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে দু’মাস আগে এ ব্যপারে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের জানানো হয়েছে। স্ব স্ব ইউনিয়নের পাহাড়ি বাসিন্দাদের ব্যাপারে সতর্কাবস্থা গ্রহণ করার জন্য বলা হয়েছে। বন বিভাগ ও সরকারি খাস পাহাড়ে কিছু মানুষ বসবাস করছেন। এ ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়েছি। কয়েকদিনের মধ্যে পাহাড়ে বসবাসকারীদের কাছে যাবো, পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের ব্যপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।
পাঠকের মতামত: