১৯৭১ সাল। সে এক আশ্চর্য সময় এসেছিল আমাদের জীবনে। আমাদের ইতিহাসে এত দু:সময় আর কখনো আসেনি, এত সুসময়ও আর কখনো দেখিনি আমরা। কলম ফেলে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল ছাত্র, লাঙ্গল ফেলে চাষী, হতিয়ার ফেলে মজুর, নারী তুলে ধরেছিল মায়াঘেরা সেই পতাকা। সকলেরই চূড়ান্ত আকাঙ্খা ছিল মহান স্বাধীনতা। নয় মাস ব্যাপি সীমাহীন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙ্গালী পেল স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ, পেল লাল সবুজের মুক্ত পতাকা।
অসংখ্য নদী উপনদীর মিলিত স্রোতধারা যেমন মোহনায় একাকার হয়ে সৃষ্টি করে মহাসমুদ্রের, তেমনি আমাদের স্বাধীনতার লোহিত সাগরে মিলিত হয়েছে কক্সবাজারের দুই বীর শহীদের রক্তধারা। বাংলা মায়ের নাম না জানা লাখো শহীদের মাঝে অনির্বান শিখা হয়ে জ্বলছে যে দু’টি নাম আজ স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি তাদের। কক্সবাজারবাসী তথা সারা বাংলার স্বাধীনতা পিপাসু মানুষের স্মৃতির সরোবরে চির অম্লান হয়ে থাকবে তাদের মহান আত্মদান। কক্সবাজারের এই দুই বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম শহীদ সুভাষ ও শহীদ ফরহাদ।
১৯৭১ সালের ৬ই মে এক দল মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে সুভাষ ও ফরহাদকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রবল প্রতিরোধ বুহ্য ভেঙ্গে পড়লে হানাদার বাহিনীর হাতে কক্সবাজারের পতন ঘটে এবং সুভাষ ও ফরহাদ কক্সবাজারেরই হানাদারদের মদদকারী তথাকথিত শান্তি কমিটির হোমরা-চোমরাদের হাতে ধরা পড়েন। পাকসেনারা কক্সবাজারে ঢুকে পড়লে স্থানীয় দালালরা জিন্দাবাদ দিতে দিতে হানাদারদের সাদর সম্ভাষণ জানায় এবং উপঢৌকন স্বরূপ সুভাষ ও ফরহাদকে হানাদারদের হাতে তুলে দেয়। তারপরের ঘটনা বর্ণনাতীত। কথিত আছে যে, পাকিস্তানী পতাকা পোড়ানোর অজুহাতে সুভাষকে গুলি করার পরিবর্তে অত্যন্ত নির্মম শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়। অপর দিকে ফরহাদকে আরো কয়েক জনের সাথে বাঁকখালী নদীর তীরে নিয়ে হানাদারেরা ব্রাশফায়ার করে এবং অন্যদের সাথে ফরহাদকেও মৃত ভেবে ফেলে চলে আসে। কিন্তু ভাগ্যচক্রে মৃত্যু মুখ থেকে ফিরতে সক্ষম হলেও মারাত্বক আহত অবস্থায় ফরহাদ পুনরায় স্বধীনতা বিরোধী কুচক্রি মহলের হাতে ধরা পড়েন। পরে তাকে আবার হানাদারদের কাছে হস্তান্তর করলে হানাদাররা নির্মম ভাবে তাকে হত্যা করে।
দেশ মাতৃকার টানে পরাধীনতার গ্লানিময় শৃঙ্খল মুক্ত করতে যারা নিজের জীবন দিয়ে জ্বালিয়ে গেলেন বিজয়ের অগ্নিমশাল তাদেরই একটি প্রত্যয়দীপ্ত নাম শহীদ ফরহাদুল্লাহ্ মোহাম্মদ এজহারুল ইসলাম। কঠোর মনোবল নিয়ে ফরহাদ এসেছিলেন বিপ্লবী মুক্তিযোদ্ধার কাতারে। তিনি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মার্চের কালরাত্রে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যখন বাঙ্গালী নিধনে মেতে উঠলো ফরহাদ তখন কলম ছেড়ে হাতে তোলে নিলেন রাইফেল। রণাঙ্গনে তিনি অনেকবার সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। তার হাতে নিহত হয়েছে অনেক পাকসেনা ও এদেশীয় রাজাকার। মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত তিনি ছিলেন একজন সক্রিয় বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে শত্রুসেনার হাতে চট্টগ্রামের কালুরঘাটের পতন ঘটলে ফরহাদ আরো শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ার উদ্দেশ্যে কক্সবাজার ছুটে আসেন। এখানে এসে যথেষ্ট মুক্তিযোদ্ধাও তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু অনাদিকালের চির কাঙ্খিত স্বপ্ন স্বাধীনতার সোনালী সূর্য উদিত হওয়ার আগেই তাকে চিরতরে হারিয়ে যেতে হলো শ্যামল বাংলার কোল ছেড়ে রক্তের অথৈ পাথারে। তার মৃতদেহ নিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়লো পাক হানাদারদের এদেশীয় পদলেহনকারী দোসরেরা।
দরিদ্র ঘরের সন্তান শহীদ সুভাষও ছিলেন রাজনীতির ক্ষেত্রে একজন নিরলস, নি:স্বর্থ, অক্লান্ত একনিষ্টকর্মী। রাতদিন অভুক্ত থেকে পোষ্টার লিখতেন এবং তা নিজ হাতে দেয়ালে দেয়ালে এঁটে দিতেন। সংগঠনের সভায় প্রচারণা চালাতেন সমাজ, দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি তার অগাধ ভালবাসা ছিল। তার প্রতিফলন ঘটতো তার প্রতিটি কথা ও কাজে। তিনি বলতেন- “গরীব বলেই আমি রাজনীতি করি। কারন রাজনীতিই হচ্ছে বর্তমান জীর্ণ সমাজ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে চুরে দেয়ার জন্য গরীবের একমাত্র হাতিয়ার।” একাত্তরের ২৫শে মার্চের পরে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মত কক্সবাজারেও প্রতিরোধ গড়ে তোলা হলে সুভাষ চন্দ্র তার সংগঠনের সহকর্মীদের নিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগদান করেন। উল্লেখ্য যে, সুভাষ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ছাত্র সংগঠন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) কক্সবাজার মহকুমা শাখার একজন প্রভাবশালী নেতা এবং ৭১ সনের মার্চ মাসের অসহযোগ আন্দোলনে কক্সবাজার সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের অত্যন্ত উদ্যমী কর্মী ছিলেন।
শহীদ সুভাষের প্রবল আকাঙ্খা ছিল যুগ যুগ ধরে বন্দিনী বাংলা মায়ের পরাধীনতার শিকল ছিন্ন করে ছিনিয়ে আনবো স্বাধীনতার লাল সূর্য। নিপিড়িত শোষিত জাতির হাতে তুলে দেবে নবযুগের বিজয় পতাকা। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস সুভাষের জীবনভর লালিত স্বপ্ন-মুকুল পুষ্পিত হওয়ার আগেই ঝরে পড়লো হায়েনার পাশবিক অত্যাচারের যুপকাষ্ঠে।
শহীদ সুভাষ ও শহীদ ফরহাদ ছাড়াও কক্সবাজারের আরো অনেক বীর সন্তান স্বীয় রক্ত দিয়ে এঁকে গেছেন স্বাধীন বাংলাদেশের নাম। নিজের প্রাণ দিয়ে আমাদের মাথায় পরিয়ে গেছেন স্বর্ণালী বিজয় মুকুট। সেই সব শহীদদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন আব্দুল হামিদ, গোলাম কাদের, আবুল কলাম, জ্ঞানেন্দ্র লাল চৌধুরী, মাস্টার মোহাম্মদ ইলিয়াছ, মোহাম্মদ সোলায়মান, বাবু অজিত পাল, শাসুল ইসলাম, শংকর বড়ুয়া, মোহাম্মদ আলী, মোহাম্মদ এজহার, আবু জাফর প্রমুখ।
মহান স্বাধীনতা দিবসের এই মহান দিনে আজ স্মরণ করছি সুভাষ ফরহাদ সহ কক্সবাজার তথা সারা বাংলার লাখো লাখো শহীদদের অমর স্মৃতিকে। যারা শহীদ হয়েছেন, যারা দেশের জন্য, দেশের প্রতি ইঞ্চি জমি মুক্ত করার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন, তারা আর ফিরে আসবেন না। তাদের ইচ্ছা ছিল, আকাঙ্খা ছিল লাল সবুজের এই পতাকা স্বাধীন দেশে নিজের হাতে তুলে ধরার। তারা শুধু নিজের শরীরের সবটুকু রক্ত দিয়ে আয়ু দিয়ে রাঙ্গিয়ে গেলেন এই পতাকা। আমাদের শপথ থাকবে এই পতাকার মর্যাদা আমরা অক্ষুন্ন রাখবোই।
[ প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে আরো বিস্তারিত ভাবে লিখা সম্ভব হলোনা। তথ্যগত ভুল ত্রুটি যদি থাকে জানালে কৃতার্থ হবো। ]
নজরুল ইসলাম বকসী
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
Email- [email protected]
পাঠকের মতামত: