এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ::
মিয়ানমারের নাগরিক ছিলাম আমি। ছিলাম মিয়ানমার সরকারের সেনাবাহিনীর জেনারেল পদে একজন সেনা কর্মকর্তা। বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গা হিসেবে বসবাস করছি। এক সময় সেখানে সকল রোহিঙ্গার নাগরিকত্ব ছিল। ১৯৮২ সালে আইন করে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। দেশটির বর্তমান সেনা প্রধান মিন অংহ্লাইং আমার জুনিয়র ব্যাচের। সে আমাকে খুব শ্রদ্ধা করত। কথাগুলো বলেছেন মিয়ানমারের একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা চিংহ্লা অং অর্থাৎ রোহিঙ্গা ওমর হাকিম।
উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গা হিসেবে অবস্থান করছেন ওমর হাকিম নামে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর জেনারেল পদ মর্যাদার সাবেক কর্মকর্তা একজন রোহিঙ্গা। আগস্টের শেষ সপ্তাহে রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে মিয়ানমার সেনাবাহিনী অভিযান শুরু“ করলে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেন তিনি। কুতুপালং নতুন ক্যাম্পে পলিথিনের ঝুপড়িতে থাকেন তিনি। ১৯৪৯ সালে মংডুর খিলাদং গ্রামে জন্ম নেন ওমর হাকিম। তার বাবা ছিলেন ওই এলাকার তৎকালীন জমিদার আব্দুল লতিফ।
কুতুপালং পুরনো ক্যাম্পে আশ্রিত সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা ইংরেজী ও রোহিঙ্গা মিশ্রিত ভাষায় জানান, মিয়ানমারে (সরকারের রেজিস্টারে) তার নাম ছিল চিংহ্লা অং। ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইনের শাসনকালে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তখনও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয়নি। সংসদ ও প্রশাসন থেকে শুরু করে সরকারী দফতরে রোহিঙ্গারা বিভিন্ন পদে আসীন ছিলেন। সত্তরের দশকে পদোন্নতি পেয়ে রেঙ্গুন (ইয়াঙ্গুন) চলে যান ওমর হাকিম। সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থায় তিনি পড়ালেখা চালিয়ে যান। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হয়ে লন্ডনের স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে পরমাণু, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও প্রতিরক্ষা বিষয়ে মাস্টার্স করেন সাবেক জেনারেল চিংহ্লা অং।
তিনি বলেন, ব্যাচমেটরা আমাকে ওমর খান হিসেবে জানেন। বাহিনী ও পড়ালেখা দুটোতে দক্ষ হওয়ায় একজন সিপাহী থেকে আমি ধাপে ধাপে জেনারেল পদমর্যাদা লাভ করি। ১৯৮২ সালে নতুন আইন করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করার পর রোহিঙ্গাদের চাকরি থেকে বাদ দেয়া হয়। সে সময় নিজেদের নাগরিকত্ব বাতিলের প্রতিবাদী রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ছিলেন জেনারেল চিংহ্লা অং ওরফে ওমর হাকিম ওরফে ওমর খানও। ফলে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলাও হয়। মামলা হওয়ার পর নিজেকে আড়াল করতে ওমর খান পালিয়ে যান থাইল্যান্ডে। সেখান থেকে মালয়েশিয়ায় সংসার পাতেন।
২০০০ সালের শুরুর দিকে গোপনে দেশে ফিরে আসেন তিনি। স্বদেশে ফিরতে পেরে নতুন করে স্বপ্ন দেখেন। গ্রামের বাড়িতে ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনীদের সঙ্গে সময় কাটান। গত আগস্টে সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ করে বর্বরতা চালায়। ওই সময় প্রাণ বাঁচাতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশ সীমান্তে ছুটে আসে। ওমর হাকিমও তার পরিবার পরিজনের সঙ্গে বাংলাদেশ ছুটে যান। বয়োবৃদ্ধ মিয়ানমারের সাবেক এ সেনা কর্মকর্তা আশ্রয় নেন পলিথিনের তাবুতে। ওমর হাকিম বলেন, দেশ মানে মা। এক সময় এ মা’কে রক্ষা করার শপথ নিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীতে নিয়োজিত ছিলাম। কিন্তু বর্বর রাখাইনরা বৈষম্যনীতি প্রয়োগ করে রোহিঙ্গাদের সকল প্রকার অধিকার হরণ করে নেয়। অন্যায়ভাবে শাসন ও শোষণের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করে। তিনি বলেন, যে দেশের জন্য অস্ত্র হাতে নিয়েছিলাম, আজ সে দেশের নাগরিকই নাকি আমি নই।
পাঠকের মতামত: