ঢাকা,মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪

শুধু প্রাণ বাচাঁতে পালিয়ে আসছি বাংলাদেশে

rohiiiiজসিম মাহমুদ, টেকনাফ সংবাদদাতা ::

এখনও কৈশোরের ছাপ শরীরে। হয়তো মা হওয়ার বয়স হয়নি, তা বলা যেতেই পারে। তবুও কোলজুড়ে চাঁদের আলোর মত এক ফুটফুটে সন্তান। গত এক মাস আগে মা হয়েছেন খতিজা বেগম। মিয়ানমার গজরবিল গ্রামে স্বামী নবী হোসনের সঙ্গে সুখের সংসার ছিল। যেখানে সুখের শেষ ছিল না রোহিঙ্গা এই নারীর। কিন্তু সাজানো সংসার শেষ করে দিয়েছে মিয়ানমার সেনা বাহিনী।

গতকাল শনিবার মৌচনি নয়া পাড়া নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাশে মাঠে ত্রাণ নিতে আসা খতিজা বেগম এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, তিন বছর প্রেম করে একই এলাকার নবী হোসেনের সঙ্গে বিয়ে করে জীবন সংসার সাজিয়েছিলেন। তারপর তাদের সংসার বাগানে এক সন্তান জন্ম দেয়। কিন্তু গত ১৫ দিন আগে তাদের গ্রামে সেনারা হামলা চালিয়ে ঘরে ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। সামনে যাদের পেয়েছে তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এসময় আরো বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা এক সঙ্গে জড়ো হয়ে সবাই পালানোর চেষ্টকরে। তখন তাদের লক্ষ্য করে গুলি বর্ষন করে। গুলিবিদ্ধ হয়ে স্বামী তার হাত ছেড়ে দেয় এবং তাকে বাচ্চা নিয়ে পালিয়ে যেতে বলেন। কিভাবে স্বামীকে ফেলে আসলাম শুধু সেই কষ্টে বুকে জমানো রয়েছে। শুধু এক মাত্র সন্তানকে বাচাঁনোর জন্য তাকে রেখে চলে আসছি। নয়তো আমাদেরও মেরে ফেলতো। জীবনের আনন্দ ভুলে গেছেন খতিজা। ওপারের সেনা বাহিনী আমার স্বামী, ঘর , সম্পদ ও আত্মীস্বজন সব নিঃস্ব করে দিয়েছে। এখন সন্তান কি হবে কিছুই বুঝতে পারছি না। গত শনিবার নাফনদী পাড়ি দিয়ে টেকনাফের জাদিমুড়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে মৌচনি ক্যাম্পে পাশে তাঁবু টাঙ্গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন ।

গতকাল শনিবার দুপুরে সাবরাং ইউনিয়ের হারিয়াখালী এলাকা গিয়ে দেখা যায় অন্যদিনের তুলনায় বেশি রোহিঙ্গা দলে দলে অনুপ্রবেশ করছে। তারা বেশি ভাগই বুশিদং এলাকা। এতো দিন মিয়ানমার মংডু এলাকার লোকজন আসলেও এখন বুশিদং-এর গুদাম পাড়া, নোয়া পাড়া, সোংতা পাড়া, জাংহামা পাড়া, টংসং পাড়া, প্রিংঙ্গী পাড়া, হালিজা পাড়া, জুমসং পাড়া ও ময়দং পাড়া লোকজন আসতে শুরু করেছে।

টিক দুুপুর ২ টার দিকে প্রচন্ড রোধে চার সন্তান নিয়ে হেটে হেটে আসছিল ইয়াছমিন আরা নামে আরেক রোহিঙ্গা নারী। তার সঙ্গে সাবরাং হারিয়াখালীর ভাঙ্গার মাথায়। তিনি বলেন, সেদেশের সেনারা আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে গিয়ে জবাই করে হত্যা করছে। তার পুরো শরীর রক্তাক্ত হয়ে গেছে, এমনকি পরে থাকা রাস্তাও রক্তে লাল হয়ে গেছে। স্বামীকে হত্যার পর অসহায় ইয়াছমিন বাঁচার চেষ্টায় সন্তানদের নিয়ে এপারে পালিয়ে আসেন। ক্ষোভের সঙ্গে জানালেন কিভাবে বাঁচবেন তিনি। স্বামী হারানোর বেদনা কেউ কি সহজে ভুলতে পারে। তাছাড়া চোখের দেখা আশপাশে নির্মম অত্যাচার আর নির্যাতনের দৃশ্য। কেন যেন মনে হয় স্বামী আমাকে এখনো ডাকছে। অনেক রোহিঙ্গা নারী স্বামী হারা হয়ে গেছে। তারা রোহিঙ্গা পুরুষদের আগুন, জবাই, গুলি করে হত্যা করেছে পাখির মতো। বাঁচার আকুতি করলেও কেউ বাঁচতে পারেনি। জনশূন্য হতে চলেছে আশপাশের এলাকাগুলোও। বসে থাকার সময় নেই। সন্তানদের নিয়ে গত শুক্রবার রাতে নাফনদী পাড়ি দিয়ে শাহপরীর দ্বীপ সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করে শনিবার ভোরে বাংলাদেশে পৌছি। হাতে টাকা ছিলনা তাই স্বামীর শেষ স্বৃতি নাকফুল বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে নৌকা ভাড়া দিতে হয়েছে। তার বাড়ি মিয়ানমার বুশিদং গুদাম পাড়া গ্রাম এলাকায়।

নাফনদী পাড়ি দিয়ে হারিয়াখালী বিদ্যালয়ে অবস্থান নিয়েছেন মিয়ানমার রাশিদং ময়দং গ্রামের বাসিন্দা আরফা বেগম। তিনি বলেন, পাচঁ সন্তান নিয়ে স্বামী আবু তালেবের সঙ্গে সুখেই দিন যাচ্ছিল। হঠাৎ করেই যেন নেমে এলো ঘোর অন্ধকার। গোটা রাখাইন সম্প্রদায়ের ওপর শুরু হয় নিষ্ঠুর অত্যাচার নির্যাতন। গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ মানুষের সঙ্গে যা না করার কথা সবই করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, গত ৫ দিন আগে সেনা ও বৌদ্ধরা মিলে ঘর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া জন্য মাইকিং করছিল। এর দুই দিন পর তারা গ্রামে এসে ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। শুরু হয় মানুষ হত্যা। হাসতে হাসতে মানুষকে হত্যা করে। ঘরে তখন আমার স্বামী ছিল না। গ্রামবাসী নিজেদের মতো করে পালাতে শুরু করে। আমি জীবন নিয়ে সন্তানরাসহ কোন রকম পালিয়ে বাঁচি। কিন্তু তার সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই। শুনেছি আমার স্বামী যাদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়েছিল তাদের সবাইকেই একযোগে হত্যা করেছে সেনা সদস্যরা। সেনারা আমার স্বামীকে বাঁচিয়ে রাখবে এমন চিন্তা করা যায় না। বারবার সন্তানরা বাবার কথা জানতে চায়। আমি কি জবাব দেব। এই বলে কাঁদতে লাগলেন। তারপর বললেন, মাঝে মাঝে অবুঝ শিশুদের প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারিনা। আবার কোন কোন সময় বলি ‘বাবা আসবেন’। পাশে স্বামী নেই। তাই আরফা বেগম।

মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা নারীদের মধ্যে অনেকের জীবনের কাহিনীটা ঠিক এরকম। হারিয়াখালী বিদ্যালয়ে সামনে অনুপ্রবেশকারি স্বামীহারা রোহিঙ্গা নারীদের সঙ্গে কথা হয়। তাদের প্রত্যেকের হৃদয়ে গেথে আছে জীবনের একেকটি করুণ গল্প। তাই নিভৃতে কাঁদেন। এর মধ্যে সন্তানদের নিয়ে বাঁচার সংগ্রাম করছেন ২৪ ঘণ্টা। সন্তানরা যখন বাবার খোঁজ করেন তখন নিশ্চুপ থাকেন মায়েরা। জবাব হারিয়ে গেছে এ রকম রোহিঙ্গা অনেক নারীর।

টেকনাফ লেদা অনবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা আবদুল মতলব বলেন, এ ক্যাম্পে অনুপ্রবেশকারি নতুন রোহিঙ্গাদের এ পর্যন্ত প্রায় ৬০০ পরিবারের তালিকা করা হয়েছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এর মধ্যে প্রায় ২০০ পরিবার রোহিঙ্গা নারীদের স্বামী নেই। তালিকা শেষে বুঝা যাবে মোট কতজন রোহিঙ্গা নারী স্বামী হারা। মিয়ানমার সেনারা এখন গোপনে গোপনে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এতোদিন মংডু থেকে লোকজন আসলে বর্তমানে বুশিদং থেকে দলে দলে লোকজন বাংলাদেশে ঢুকছে।

তিনি আরো বলেন, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের উন্মুক্ত বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকটের ভিবিন্ন আলোচনা হলেও কোন সিন্ধন্ত দিতে পারেনি, এতে রোহিঙ্গা জনগেষ্টীরা খুবই হতাশ ও মর্মাহত। এতে বাংলাদেশের জনগনও হতাশ দেখা দিয়েছে। চীন-রাশিয়া মিয়ানমার পক্ষে রয়েছে তাই নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে কোন সুরাহা আসেনি। তবুও আমরা আশা করি রোহিঙ্গারা যাতে মিয়ানমারে ফিরে তাদের অধিকার নিয়ে স্বাধীনভাবে চলতে পারে সেই চেষ্টা চালিয়ে যাবেন জাতিসংঘ ।

সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর হোসেন বলেন, শনিবার ভোরে শাহপরীর দ্বীপ সীমান্ত দিয়ে প্রায় ৪ হাজারের মত রোহিঙ্গা একদিনে অনুপ্রবেশ করেছে। বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেও রোহিঙ্গারা নাফনদী পাড়ি দিচ্ছে। ফলে নৌকা ডুবির আশংকাও রয়েছে।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন ছিদ্দিক বলেন, শনিবার হঠাৎ করে শাহপরীর দ্বীপ সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রশে বৃদ্ধি পেয়েছে। যা অন্যদিনের তুলনায় অনেকটা বেশি।

###############

শাহপরীরদ্বীপে এক গৃহবধুর লাশ উদ্ধার

জসিম মাহমুদ,টেকনাফ সংবাদদাতা ::

টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপে তসলিমা আক্তার (২০) নামে এক গৃহবধু আতœহত্যা করেছে। নিহত গৃহবধু সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীরদ্বীপ কোনাপাড়ার শহিদুল্লাহর স্ত্রী।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, শাহপরীরদ্বীপ কোনার পাড়ার ইউছুপ মিস্ত্রির ছেলে শহিদুল্লাহ দু-বছর আগে প্রেম করে বিয়ে করে মিস্ত্রিপাড়ার মৃত আবদুল মোনাফের মাষ্টারের মেয়ে তসলিমা আক্তারকে। তাদের সংসারে একটি সাদিয়া আক্তার নামে একটি মেয়ে সন্তান রয়েছে। গতকাল শনিবার সকাল ১০ টার দিকে তসলিমা আক্তার গলায় ফাঁস লাগিয়ে আতœহত্যা করে বলে জানিয়েছেন তাদের পরিবারের লোকজন।

খবর পেয়ে টেকনাফ মডেল থানার উপ-পরিদর্শক মনজুরুল হক ঘটনাস্থল থেকে লাশটির সুরতহাল রির্পোট তৈরী করে উদ্ধার করে কক্সবাজার মর্গে প্রেরণ করেন।

এব্যাপারে টেকনাফ মডেল থানার অফিসার ইনর্চাজ (ওসি) মাইন উদ্দিন খাঁন জানান, স্থানীয়দের সংবাদের ভিত্তিতে লাশটি উদ্ধার করে একটি ইউডি মামলা করে কক্সবাজার মর্গে প্রেরণ করা হয়েছে। ময়নাতদন্তের রির্পোট পেলে জানা যাবে এটি আতœহত্যা বা হত্যাকান্ড কিনা।

পাঠকের মতামত: