নিউজ ডেস্ক ::
ইয়াবা কারবারে জড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কেউ কেউ। এর পাশাপাশি ক্যাম্পে আধিপত্য ঘিরে ঘটছে খুনোখুনি। এ ছাড়া তাদের টার্গেট করে মানব পাচারকারী চক্রও সক্রিয়। এই চক্রে রোহিঙ্গারাও রয়েছে। কেউ কেউ জড়াচ্ছে অস্ত্র কারবারে। তবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখাসহ সেখানকার নিরাপত্তা ঘিরে নতুনভাবে ভাবছে সরকার। ক্যাম্পের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের পাশাপাশি করণীয় নির্ধারণ করতে চান নীতিনির্ধারকরা। বিশেষ করে সম্প্রতি একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা পরিস্থিতি তুলে ধরে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। এমন বাস্তবতায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার আলোকে তিনটি বাহিনী ও একটি সংস্থার প্রধানরা মঙ্গলবার টেকনাফ যাচ্ছেন।
টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করবেন বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলাম, পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, র্যাব মহাপরিচালক ড. বেনজীর আহমেদ ও পুলিশের বিশেষ শাখা এসবির প্রধান মীর শহিদুল ইসলাম। তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সমস্যা সরেজমিনে দেখবেন। রোহিঙ্গাদের কথা শোনার পাশাপাশি সেখানে নিয়োজিত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের মাঠপর্যায়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করার কথাও রয়েছে তাদের। এরপর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে তাদের পরিকল্পনার কথা জানাবেন বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার প্রধানরা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন সমকালকে বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে তাদের ভাবনার কথা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে তুলে ধরবেন তারা। এরপর তাদের পরামর্শ অনুযায়ী পরবর্তী করণীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
কক্সবাজারের র্যাব-১৫-এর অধিনায়ক উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তাজনিত পরিস্থিতি এতটা নাজুক হয়নি, যেটা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে। তবে রোহিঙ্গারা যাতে মাদকের সঙ্গে জড়াতে না পারে, সে ব্যাপারে তীক্ষষ্ট দৃষ্টি রাখা হচ্ছে।’
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম সমকালকে বলেন, ‘বিজিবি, পুলিশ, র্যাব ও এসবিপ্রধান রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনের সময় তাদের প্রতিনিধি সেখানে থাকবে। বর্ষা মৌসুমে ক্যাম্পের প্রধান সমস্যা অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত। এতে ক্যাম্পের বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার ব্যাঘাত ঘটছে।’
একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, বেশ কিছুদিন ধরেই রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প ঘিরে বেআইনি নানা ধরনের কাজ করে আসছে কিছু সংঘবদ্ধ চক্র। পুলিশের তথ্যমতে, গত দুই মাসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খুন হয়েছে পাঁচজন। এ ছাড়া বিভিন্ন ক্যাম্পে দেশি অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারও বাড়ছে। সঠিক তথ্য না পাওয়ায় ঘনবসতিপূর্ণ এসব ক্যাম্পে অভিযান চালানোও অনেক সময় সম্ভব হয় না।
পুলিশের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, রোহিঙ্গাদের ঘিরে যেসব বিষয়ে সবচেয়ে বেশি খেয়াল রাখা হচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো তারা যাতে বাঙালি পরিচয়ে পাসপোর্ট তৈরি করতে না পারে। এমনকি ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে অন্য কোথাও আশ্রয় নিতে না পারে। এ ছাড়া কোনো উগ্রপন্থি গোষ্ঠী যাতে তাদের টার্গেট করে জঙ্গি সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করতে না পারে। তবে এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের জঙ্গি সংগঠনে ভেড়ানো হয়েছে এমন কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য গোয়েন্দাদের কাছে নেই।
একটি চক্র রোহিঙ্গা নারীদের টাকার বিনিময়ে অন্য জায়গায় পাচার করছে। তারা ক্যাম্প ঘুরে যেসব রোহিঙ্গা নারী খুব অসহায়, তাদের ঢাকায় নিয়ে পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন জায়গায় চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেয় প্রথমে। আবার কোনো নারীকে বিদেশে নিয়ে চাকরি দেওয়ার কথাও জানায়। এরপর তাদের ঢাকায় পাচারকারী অন্য গ্রুপের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে কিছু সংঘবদ্ধ ডাকাত গ্রুপও রয়েছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা বিদেশে অবস্থান করে অর্থ উপার্জন করছে, ক্যাম্পে তাদের পরিবারের সদস্যদের টার্গেট করে মুক্তিপণ আদায় করাই তাদের কাজ। এই অপরাধে তারা একনলা বন্দুক ও কাটা রাইফেলও ব্যবহার করে থাকে।
সূত্র বলছে, বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে কোনো সীমানাপ্রাচীর নেই। তাই যে কোনো জায়গা হয়ে তারা ক্যাম্প থেকে আসা-যাওয়া করতে পারে। কোনো নির্দিষ্ট পথ হয়ে ক্যাম্পে যাতায়াতের ব্যবস্থা থাকলে সেখানকার নিরাপত্তা আরও স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হতো। তিনটি বাহিনী ও একটি সংস্থার প্রধান রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনের পর ক্যাম্পের নিরাপত্তার স্বার্থে সীমানাপ্রাচীরের বিষয়টি উঠে আসতে পারে।
দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তায় টেকনাফে পাঁচটি পুলিশ ক্যাম্প রয়েছে। সেখানে ক্যাম্পের সংখ্যা আরও বাড়ানো হতে পারে। ক্যাম্পের মধ্যে আরও কিছু এলাকায় বসানো হবে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। ক্যাম্পের ভেতরে আরও লাইটের ব্যবস্থা করার সিদ্ধান্ত আসবে। রাস্তা খারাপ হওয়ায় ক্যাম্পের ভেতরে সব জায়গায় গাড়ি নিয়ে টহল দেওয়া যায় না এখন, সেদিকেও নজর দেওয়া হতে পারে। ক্যাম্পে থাকা যেসব রোহিঙ্গা নিয়মিত রেশন পাচ্ছে, তাদের তালিকা হালনাগাদ করা হবে। যেসব রোহিঙ্গা অপরাধে জড়িয়ে পালিয়ে আছে, তাদের রেশন বন্ধ করার ব্যবস্থা করা হবে।
২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর নিষ্ঠুর সামরিক অভিযান শুরু করলে প্রাণভয়ে সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এর আগে চার লাখের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রিত ছিল। সব মিলিয়ে ১১ লাখের মতো রোহিঙ্গা কক্সবাজার জেলার ৩৪ শিবিরে রয়েছে। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছে তারা।
পাঠকের মতামত: