নিউজ ডেস্ক :: আকাশ থেকে দেখলে মনে হবে পাশ্চাত্যের কোনো স্থাপনা। লাল টিনের ছাউনি দেয়া একতলা ভবনগুলো লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। পাশ দিয়েই গেছে ঢালাই করা পাকা রাস্তা। এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ি যাওয়ার সহজ পথ। সাগরের বুকে জেগে ওঠা চরে ছবির মতো করে সাজানো হয়েছে ঘরবাড়ি, মাঠ, জলাধারসহ ম্যানগ্রোভ বন। ওপরে নীল আকাশ দূরে সমুদ্র সমতলে লাল আর সবুজ। সবমিলে চারদিক একাকার হয়ে গেছে।
এখানেই গড়ে উঠেছে ভাসানচরের অস্থায়ী আশ্রয়ণ প্রকল্প। মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতনে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের থাকার জায়গা। সব তৈরি, অপেক্ষা শুধু তাদের বরণের। সেই প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে ব্রিটিশ নকশায় আধুনিক সুবিধাসহ তৈরি নোয়াখালীর ভাসানচরের প্রকল্পটি।
বিট্রিশ কোম্পানির ডিজাইনে শক্তিশালী বাঁধ দিয়ে দ্বীপকে সুরক্ষিত করা হয়েছে। সাগরের মাঝে গড়ে ওঠা নিরাপদ, সুরক্ষিত এবং পরিবেশসম্মত এই নগরীতে একসঙ্গে এক লাখ মানুষ থাকতে পারবে। যে কোনো পরিস্থিতিতে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবনের লক্ষ্যে, ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, থানা, বাজার এবং ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ সহ সব সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে এখানে। এতিমখানা, ডে-কেয়ার সেন্টার এবং সুপারশপের জন্য আলাদা ভবন করা হয়েছে।
জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এবং এনজিওগুলোর জন্য রয়েছে পৃথক ভবন। পুরো প্রকল্পটি সার্বক্ষণিক সিসি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রিত। সরকারের সবচেয়ে বেশি প্রাধান্যের এই প্রকল্পটিতে ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ১শ’ কোটি টাকা। এখানেও রেশন কার্ডের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের খাবার নিশ্চিত করা হবে। তবে তারা চাইলে বিশাল এই দ্বীপে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেও যুক্ত হাতে পারবে।
এই মেগা প্রকল্পটি নির্মাণ, বাস্তবায়ন ও ব্যবস্থাপনা করছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। প্রশাসনিক বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় নজরদারি করছে। এটি বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই সার্বক্ষণিক নির্দেশনা দিয়েছেন। এই এলাকার মাটি, পানি এবং বাতাস মানুষের বসবাস উপযোগী হওয়ায় প্রকল্পের জন্য এই দ্বীপটিকেই বেছে নেয়া হয়েছে। সবকিছু মিলে এমন সুবিধা সেখানে দেয়া হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক নাগরিকও তা পায় না।
জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক নৌবাহিনীর কমোডর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, সরকার অগ্রাধিকার প্রকল্পের মধ্যে এটি অন্যতম। এর সফল বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী সার্বক্ষণিক নির্দেশনা দিয়েছেন। যে কারণে করোনার মধ্যেও দ্রুত এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের জীবনধারণের সব সুবিধা রয়েছে এখানে। যেটি কক্সবাজারের চেয়ে হাজারগুণ উন্নত। বিদেশি প্রতিষ্ঠানের পরামর্শে পরিকল্পিত নকশায় দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করে এটি গড়ে তোলা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গারা এখানে অস্থায়ীভাবে থাকবে। তারা নিজ দেশে চলে গেলে বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি অংশ এখানে স্থানান্তরের পরিকল্পনা রয়েছে।
সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা গেছে, মূলত ক্লাস্টার হাউস, শেল্টার স্টেশন বা গুচ্ছগ্রামকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এ নগরী। প্রকল্পে রয়েছে মোট ১২০টি ক্লাস্টার হাউস। পরিকল্পিত নকশায় ভূমি থেকে প্রতিটি ক্লাস্টার হাউস ৪ ফুট উঁচু করে নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি হাউসে ১২টি গৃহ এবং প্রতিটি গৃহে ১৬টি কক্ষ। প্রতিটি রুমে পরিবারের ৪ জন করে থাকতে পারবেন। নারী-পুরুষের জন্য রয়েছে আলাদা টয়লেট, গোসলখানা।
এছাড়া দুর্যোগ থেকে রক্ষায় প্রতিটি ক্লাস্টার হাউসের সঙ্গে রয়েছে একটি করে সাইক্লোন শেল্টার। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় রোহিঙ্গারা সেখানে আশ্রয় নিতে পারবে। এক্ষেত্রে প্রতিটিতে ১ হাজার করে ১২০টি সেন্টারে ১ লাখ ২০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। এছাড়া প্রতিটি সাইক্লোন শেল্টারের নিচতলায় আশ্রয় নিতে পারবে ২শ’ করে গবাদিপশু। এই সাইক্লোন শেল্টারের স্টেশনগুলো এমনভাবে স্টিল, কংক্রিট এবং কম্পোজিট স্ট্র্যাকচারে তৈরি যা ২৬০ কিলোমিটার গতির ঘূর্ণিঝড় সহ্যে সক্ষম।
দ্বীপটির নিরাপত্তার জন্য ৯ ফুট উচ্চতার ১৮টি স্লুইসগেটসহ ১২ কিলোমিটার বাঁধের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। সমুদ্রের ঢেউ থেকে দ্বীপটির সুরক্ষায় ২ দশমিক ১ কিলোমিটার স্ক্রিন ব্রেকওয়াটারের মাধ্যমে শোর প্রটেকশনের কাজ শেষ হয়েছে। এছাড়া ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস প্রতিরোধে বাঁধের উচ্চতা ৯ থেকে ১৯ ফুট পর্যন্ত বৃদ্ধির কাজ চলমান। জীবনমানে রয়েছে আধুনিক সুবিধা। রোহিঙ্গাবিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্সের সিদ্ধান্তের আলোকে ৪ তলাবিশিষ্ট দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে।
জ্বালানি সরবরাহে ২৫০ টন ধারণক্ষমতার ২টি ফুয়েল ট্যাংক নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। আবাসন এলাকা পরিবেশসম্মত করা এবং বাতাস ঠাণ্ডা রাখার জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত জলাধার। প্রতিটি ক্লাস্টার হাউসের সামনে একটি করে পুকুর। জ্বালানির জন্য রান্নাঘরে গ্যাস সিলিন্ডার রাখার সুবিধা আছে। ২৪ ঘণ্টাই বিদ্যুতের ব্যবস্থা ্আছে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয়ভাবে ১ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ এবং আরও ১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ ২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা আছে।
এর বাইরে প্রতিটি ক্লাস্টার হাউসে আছে সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা। কেন্দ্রীয়ভাবে করা হয়েছে বায়োগ্যাস প্লান্ট। জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এবং সরকারের শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) জন্য রয়েছে আলাদা ভবন। খাদ্য মজুদের জন্য এখানে সুবিশাল গোডাউন নির্মাণ করা হয়েছে।
রয়েছে ৩টি সুরক্ষিত ওয়্যার হাউস। এসব গোডাউনে ১ লাখ মানুষের তিন মাসের খাবার মজুদ রাখা যাবে। নামাজ আদায়ের জন্য তৈরি করা হয়েছে ৩টি মসজিদ। স্বাস্থ্যসেবায় রয়েছে ২টি ২০ শয্যার হাসপাতাল এবং ৪টি কমিউনিটি ক্লিনিক। এসব হাসপাতাল থেকে রোগীদের ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসা ও ফ্রি ওষুধ সেবা দেয়া হবে।
ভাসানচর এই দ্বীপটির মোট আয়তন ১৩ হাজার কিলোমিটার। এর মধ্যে ব্যবহার উপযোগী ৬ হাজার ৪২৭ একর। প্রকল্প এলাকা ১ হাজার ৭০২ একর। তবে ক্লাস্টার এরিয়া নির্মাণ করা হয়েছে কেন্দ্রের মাত্র ৪৩২ একরের মধ্যে। এখনও ৯১৮ একর জমি অব্যবহৃত। এর মধ্যে ৩৫২ একর জমি ভবিষ্যতে নৌবাহিনীর ফরওয়ার্ড বেইস তৈরির জন্য রাখা হয়েছে। বাকি এলাকার মাটি অত্যন্ত উর্বর হওয়ায় বাংলাদেশের যে কোনো নিয়মিত ফসল এখানে চাষযোগ্য।
সন্দ্বীপ থেকে এই চরের দূরত্ব ৪ দশমিক ৫ নটিক্যাল মাইল। সন্দ্বীপ থেকে ট্রলারে সেখানে যেতে সময় লাগে মাত্র এক ঘণ্টা। এছাড়া জাহাঙ্গীরচর থেকে ১১, হাতিয়া থেকে ১৩ দশমিক ২, নোয়াখালী থেকে ২১ এবং চট্টগ্রামের পতেঙ্গা পয়েন্ট থেকে মাত্র ২৮ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থান করছে এই দ্বীপ। যোগাযোগের জন্য এখানে পরিকল্পিত ব্যবস্থা রয়েছে।
সরকারি কোম্পানি টেলিটকসহ ইতোমধ্যে তিনটি মোবাইল ফোন কোম্পানির ফোরজি নেটওয়ার্ক রয়েছে এই প্রকল্পে। এছাড়া সবগুলো মোবাইল কোম্পানির নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। দ্রুত সেবার জন্য নৌবাহিনীর ৪টি এলইউসি, ৮টি জলযান এবং দুটি হেলিপ্যাডের মাধ্যমে জরুরি প্রয়োজনে দিনরাত মানুষকে স্থানান্তরের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
বৃহৎ এই আশ্রয় প্রকল্পে নিরাপত্তার বিষয়টি সবার আগে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পুরো প্রকল্পটি সার্বক্ষণিক সিসি ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। নৌবাহিনীর পাশাপাশি দুটি থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সেখানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুরুষের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় মহিলা পুলিশ এবং এপিবিএনের সদস্যরা থাকবে।
রোহিঙ্গারা চাইলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেও যুক্ত হতে পারবে। সরাসরি তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার সুযোগ না থাকলেও নৌবাহিনী এবং স্থানীয় প্রশাসনের কিছু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সেখানে রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- গবাদিপশু পালন, দুগ্ধ উৎপাদন, মাছ চাষ, ফল ও ফসলের চাষ এবং ক্ষুদ্র কুটির শিল্প।
এসব প্রকল্পে রোহিঙ্গারা যুক্ত হতে পারবে। ইতোমধ্যে সেখানে ১০ হাজার মহিষ, কয়েকশ’ ভেড়া, রাজহাঁস, দেশি হাঁস, মুরগি এবং বিভিন্ন ফল ও ফসলের বাগান তৈরি করেছে নৌবাহিনী।
জানা গেছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনে ২০১৭ সালে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এরা কক্সবাজার এবং টেকনাফে আশ্রয় নিয়েছে। ট্রিপল আরসির তথ্য অনুসারে এদের জন্য ৬ হাজার ৫শ’ একর জমিতে মোট ৩২টি ক্যাম্প করা হয়েছে। এখানে ঘরের সংখ্যা ২ লাখ ১২ হাজার ৬০৭টি। দুই প্রক্রিয়ায় এদের খাদ্য সহায়তা দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে সাধারণ খাদ্য বণ্টন এবং ই-ভাউচার।
সাধারণ খাদ্য বণ্টন কর্মসূচিতে ১ থেকে ৩ সদস্যবিশিষ্ট পরিবারের জন্য মাসে ৩০ কেজি চাল, ৯ কেজি ডাল এবং ৩ লিটার তেল দেয়া হয়। এছাড়া ৪ থেকে ৭ সদস্যবিশিষ্ট পরিবারের জন্য ৬০ কেজি চাল, ১৮ কেজি ডাল এবং ৬ লিটার তেল দেয়া হয়।
এভাবে পরিবারের সদস্য সংখ্যা যত বেশি, রেশিও অনুসারে খাবার দেয়া হয়। আর ই-ভাউচারের আওতায় যারা আছেন, তারা দোকান থেকে জনপ্রতি ২১শ’ ক্যালোরি সমান খাদ্য নিতে পারে। এক্ষেত্রে বরাদ্দ সর্বোচ্চ ৭৮০ টাকা। তবে জাতিসংঘের অনুরোধে এদের আশ্রয় দেয়া হলেও এ খাতে আন্তর্জাতিক সহায়তা কমছে। সরকারের বাজেট থেকে সেখানে ব্যয় করতে হচ্ছে।
পাঠকের মতামত: