নিজস্ব প্রতিবেদক :: কক্সবাজারের মহেশখালীর সমুদ্র উপকূলে নিষিদ্ধ চরজাল, বিহিন্দী জাল এবং কুমজাল দিয়ে অপরিকল্পিতভাবে মাছ আহরণ করা হচ্ছে। এতে ছোট চিংড়িসহ মৎস্য প্রজাতির অপরিণত পোনা আটকে যাচ্ছে জালে। আর এ ধরনের জালে অতিমাত্রায় মৎস্য আহরণ করা হচ্ছে। এছাড়া উপকূলে অতিরিক্ত চরজাল বসানোয় ট্রলার চলাচলও হুমকির মুখে রয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে যা মৎস্য সম্পদের জন্য অশনি সংকেত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা মৎস্য সম্পদ সুরক্ষায় সাগরে ব্যবহৃত জালে ফাঁদের আকারে পরিবর্তন আনার দাবিও জানান।
বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানা অর্থনৈতিক অঞ্চলের পরিমাণ দেশের মোট আয়তনের চেয়ে ২০ হাজার বর্গ কিলোমিটারেরও অধিক। এ বিশাল সামুদ্রিক এলাকা প্রাচীনকাল থেকে রুপালী মৎস্য সম্পদে ভরপুর ছিল। এ সম্পদের উপর নির্ভরশীল হয়ে উপকূলীয় দ্বীপাঞ্চলে গড়ে উঠেছিল জনবসতি। হয়ত বিকাশ হয়েছিল আজকের এই বাঙালি সভ্যতার। পরিচিত হয়েছিল ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ নামে। কিন্তু সেই খ্যাতি এখন হারানো পথে। এই সম্পদ রক্ষার প্রয়োজনীয়তা পাকিস্তান আমল থেকে অনুভব করলেও শুধুমাত্র ২/১ টি আইন প্রণয়ন করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেমে থাকে। যখন পিঠ একেবারে দেয়ালে এসে ঠেকে তখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সবকিছু আবার নতুন করে গড়তে মরিয়া হয়ে উঠে।
অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশের সামুদ্রিক মৎস্য আইন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অকার্যকর। সামুদ্রিক মৎস্য আইন ১৯৮৩ এর ১৪ ধারায় বিহিন্দী জালের ফাঁদের আকার ছিল সর্বনিম্ন ৩০ মি. মি.। ২০০৪ সালে এক সংশোধনীর মাধ্যমে এই ফাঁদের আকার সর্বনিম্ন ৪৫ মি. মি. করা হয়। কিন্তু এই আইন বাস্তবায়নে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। ফলে বিহিন্দী জাল, চরজালের ফাঁদের আকার এখনো ৩-৪ মি. মি.-ই রয়ে গেছে। শুধুমাত্র গভীর সাগরের বিহিন্দী জালের ফাঁদ সর্বোচ্চ ৩০ মি.মি. পর্যন্ত দেখা গেছে। মৎস্য আইনে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ মাটির সাথে স্থায়ীভাবে সংযুক্ত চরজালের দৈর্ঘ্য ৫শ’ থেকে সর্বোচ্চ ১০০০ মি. পর্যন্ত হয়ে থাকে। ভাটার সর্বনিম্ন সীমায় শত শত খুঁটির সাহায্যে ৮-১২ ফুট উচ্চতার এই জাল অনেকটা ক্রিসেন্ট আকৃতির করে জালের নিম্ন প্রান্তে মাটিতে পুঁতে রাখা হয়। জালের মাঝ বরাবর ৩-৪ মি. মি. ফাঁদের একটি থলে যুক্ত করে দেয়া হয়। পুঁতে রাখা চরজাল থেকে সর্বোচ্চ ২ কি. মি. ভিতরে পর্যন্ত জোয়ার হয়। সর্বোচ্চ জোয়ারের সময় বোটের সাহায্যে গিয়ে জালের উপরের প্রান্ত খুঁটির সাথে বেঁধে রাখা হয়। ভাটার সময় ছোট-বড় সব ধরণের মাছ এবং পোনা আর সাগরে ফিরে যেতে পারে না। জাল এবং ফাঁদে এসে আটকা পড়ে। এভাবে প্রতিদিন ২ বার সামুদ্রিক মৎস্য প্রজাতি ধ্বংস করা হচ্ছে। অপরদিকে প্রতি বছর সামুদ্রিক কাছিম ডিম পাড়ার মৌসুমে ডিম পাড়তে এসে ফিরে যাওয়ার সময় চরজাল ও বিহিন্দী জালে আটকা পড়ে।
এভাবে বাংলাদেশে প্রতিদিন ১২ হাজার মোহনার বিহিন্দী জাল এবং ৫ হাজার সাগর বিহিন্দী জাল দিয়ে মৎস্য সম্পদ ধ্বংস করা হচ্ছে। কিন্তু মৎস্য আইনে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ চরজালের কোন পরিসংখ্যান সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা স্থানীয় মহেশখালী মৎস্য অফিসে নেই। অথচ মহেশখালী উপকূলে বহু সংখ্যক চরজাল পাতা হয়েছে। বিশেষ করে চরপাড়া সি বিচ এলাকা ও জেটি সংলগ্ন এলাকায়। এদিকে ইঞ্জিন চালিত বোটে করে ৩-৪ মি.মি. ফাঁদের কুমজাল দিয়ে ব্যাপক হারে অপরিণত পোনা মাছ আহরণ করা হচ্ছে। অন্যদিকে উপকূলীয় এলাকায় দিন দিন প্যারাবন বা ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল কেটে ধ্বংস করায় বিভিন্ন প্রকার মৎস্য প্রজাতির ক্ষুদ্র পোনা এবং অপরিণত মাছের আবাস ভূমি ধ্বংস হচ্ছে। এতে করে বঙ্গোপসাগরে আশংকাজনকহারে মৎস্য সম্পদ হ্রাস পাচ্ছে।
মহেশখালীর হোয়ানকের কালাগাজীর পাড়া গ্রামের সত্তরোর্ধ্ব বয়সের জেলে অলি আহমদ চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘২০-৩০ বছর আগে যখন আমরা সাগরে বোট নিয়ে মাছ ধরতে যেতাম তখন জালের প্রস্থ ছিল মাত্র ০৮-১০ হাত এবং প্রতিদিন সাগর থেকে ফিশিং করে কূলে চলে আসতাম। তখন বরফও ছিল না। এখন বরফ নিয়ে সাগরে ১০-১৫ দিনের জন্য মাছ ধরতে যাওয়া হয়। জালের প্রস্থও ৪০-৮০ হাত। অর্থাৎ সেই সময় সাগরের উপরের মাছ ধরা হতো। এখন সাগরের তল দেশ থেকেও মাছ তুলে আনা হচ্ছে।’
জেলে অলি আহমদ সহ একাধিক অভিজ্ঞ মৎস্যজীবী সাগরের মৎস্য সম্পদ সুরক্ষায় ব্যবহৃত জালগুলোর ফাঁদের আকারে পরিবর্তন আনতে নতুন আইন করার দাবি জানান।
সূত্র জানায়, জালের ফাঁদ ৬০ মি. মি. পর্যন্ত বাড়ালে অধিকাংশ পোনা মাছ ছাড়া পায় এবং আহরিত মাছের পরিমাণ মোট আহরণের প্রায় ৪৩ শতাংশ হয়। বিহিন্দী জালের ফাঁদ ৪৫ মি. মি. বাস্তবায়ন করতে পারলে ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমে যেত।
সমপ্রতি মৎস্য গবেষণা কেন্দ্র কক্সবাজারের মৎস্য গবেষণায় দেখা গেছে, ৪৫ মি. মি. থেকে ৬০ মি. মি. করা হলে সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের অনেক অপরিণত পোনা মাছ বেঁচে যায় এবং এটাই বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে উত্তম হত।
এ ব্যাপারে মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ জামিরুল ইসলাম চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘অবৈধ কারেন্ট জাল, চরজাল ও বিহিন্দীজাল ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ইতিমধ্যে প্রচুর পরিমাণ কারেন্ট জাল ও বিহিন্দী জাল জব্দ করে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। আগামীতেও অভিযান অব্যাহত থাকবে এবং অবৈধ ফাঁদের জাল ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
পাঠকের মতামত: