ঢাকা,সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪

মার্কিন সাংবাদিকের চোখে ‘দিশাহীন’ রোহিঙ্গারা, আকাশে তবুও স্বপ্নের ঘুড়ি

ডেস্ক নিউজ :

সম্প্রতি বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও (এনপিআর)-এর বিশ্বস্বাস্থ্য-বিষয়ক প্রতিবেদক জ্যাসন বিউবিয়ে। সরকারি-বেসরকারি দুই ধারার অর্থায়নে পরিচালিত এনআরপির রেডিও ও ওয়েব ভার্সনের জন্য কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের শরণার্থী শিবির নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন হাজির করেন তিনি। সেইসব প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা জীবনের উত্থান-পতন, আশা-নিরাশা আর শঙ্কা-স্বপ্নের গল্প বলেছেন জ্যাসন। তুলে এনেছেন রাষ্ট্রহীন গর্ভবতী নারীর আর্তনাদ, প্রাকৃতিক দুর্যোগের শঙ্কা কিংবা প্রত্যাবাসনের ঝুঁকির কথা। জ্যাসন দেখেছেন, এইসব দিশাহীন বাস্তবতাতেও জীবন থামে না। তার ব্যক্তিগত টুইটার অ্যাকাউন্টে মিলেছে শরণার্থী শিবিরে সাপ খেলার দৃশ্যের বর্ণনা। নিজ প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও তিনি আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ধর্ম-সংস্কৃতিসহ সামগ্রিক জীবনবোধের কথা বলেছেন। রোহিঙ্গা শিশুর ঘুড়িতে থাকা স্বপ্ন-সম্ভাবনাও তাই তার প্রতিবেদনের উপজীব্য হয়েছে।

রোহিঙ্গা শিশুগত বছরের ২৫ আগস্ট রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর পূর্ব-পরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭ লাখ মানুষ। তারা কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পালিয়ে আসা বাংলাদেশ-মিয়ানমার প্রত্যাবাসন চুক্তি সম্পন্ন হলেও তা কার্যকরের বিষয়টি এখনও প্রক্রিয়াধীন।

বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের রাখাইনে প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা ছিল চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি। তবে মিয়ানমার-বাংলাদেশ প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুযায়ী সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন না হওয়ার কথা বলে প্রত্যাবাসন স্থগিতের ঘোষণা আসে একদিন আগে (২২ জানুয়ারি)। ওই ঘোষণা আসার একদিন আগেই ‘রোহিঙ্গারা ফিরতে চায় না’ শিরোনামে জ্যাসন বিউবিয়ের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় মার্কিন রেডিও নেটওয়ার্ক-এনপিআর-এর ওয়েব মিডিয়ায়। জ্যাসন বিউবিয়ে তখন বাংলাদেশে অবস্থান করছিলেন। ১ হাজারেরও বেশি পাবলিক রেডিও স্টেশনের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা অমুনাফাভোগী সংবাদ-নেটওয়ার্ক এনপিআর। জ্যাসন বিউবিয়ে এর বিশ্বস্বাস্থ্য-বিষয়ক প্রতিবেদক। একান্ত ব্যক্তিগত বাস্তবতাকে ‘মানবিক আবেদন-সমৃদ্ধ প্রতিবেদন’ আকারে হাজির করেন তিনি। শিবির পরিদর্শনের কাছাকাছি সময় থেকে জ্যাসন বিউবিয়ে তার ব্যক্তিগত টুইটার অ্যাকাউন্টেও সরব হয়ে ওঠেন রোহিঙ্গা প্রশ্নে।

রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন নিয়ে নিজ পত্রিকা এনপিআরকে দেওয়া জ্যাসনের সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয় ১৮ ফেব্রুয়ারি। সাক্ষাৎকারে জ্যাসন জানান, শরণার্থীদের আবেগ সত্যিকার অর্থেই হাসি-কান্না মিশ্রিত। ‘কয়েকজন লোককে দেখলাম তারা খুব ক্ষুব্ধ। একজনের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি আমাকে জানালেন, কীভাবে মিয়ানমারের সেনারা তাকে পিটিয়েছে এবং ভেবেছে তিনি মারা গেছেন। সেনারা মৃত ভেবে তাকে নর্দমায় ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু তিনি মৃত ছিলেন না। ওই ব্যক্তি আমাকে দেখালেন মিয়ানমারের সেনারা কীভাবে তার সামনের দাঁত তুলে নিয়েছে। ‘

জ্যাসনকে ফেলে আসা খামার আর গবাদিপশুর গল্প শুনিয়েছেন এক নারী। ‘তার যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে আকৃষ্ট করেছে তা হলো তার প্রধান চাওয়া। সাধারণ জীবনযাপন করতে চেয়েছিলেন তিনি। শস্য ফলাতে চেয়েছিলেন, গবাদিপশুর দেখাশোনা করতে চেয়েছেন। এ শিবিরে তিনি তা করতে পারছেন না এবং সম্ভবত আগামী কয়েক বছরে ফিরে যেতেও পারবেন না। অন্যদেরকে অবশ্য নিরাপদ থাকতে পেরেই খুশিই মনে হলো। প্রতিবেদন নিয়ে নিজ প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার সাক্ষাৎকারেও একই অভিমত দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ‘অন্তত এ মুহূর্তে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনকে একটি ভালো চিন্তা বলে মনে করছেন এমন কাউকে পাইনি। আমার সঙ্গে এমন একজন শরণার্থীরও কথা হয়নি যারা কিনা স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে চেয়েছেন। আপনাদেরকে মনে রাখতে হবে যে মাত্র কয়েক মাস আগেই তারা মিয়ানমার থেকে পালিয়েছে এবং প্রতিদিনই বাংলাদেশে নতুন করে রোহিঙ্গা প্রবেশ করছে।

হাকিমপাড়া ক্যাম্পে অস্থায়ী মসজিদে নামাজ আদায় করেন রোহিঙ্গারা
তবে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরকে একটা যথাযথ ও স্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে চিন্তা করতে পারছেন না জ্যাসন। বাংলাদেশে সেই ১৯৯০-এর দশক থেকেই রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিচ্ছে। আগের শরণার্থীরাও সহিংসতা থেকে বাঁচতে পালিয়ে এসেছিলেন। তবে এবারের রোহিঙ্গা জনস্রোতকে ‘নজিরবিহীন’ আখ্যা দিয়েছে জাতিসংঘ। জ্যাসন বলছেন, ‘যে সংখ্যায় শরণার্থীরা এসেছে এবং যত দ্রুত বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে সেদিক বিবেচনায় এ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। আশ্রয় শিবিরগুলোতে গেলে এর প্রভাব চোখে পড়ে। সারিবদ্ধভাবে আশ্রয়ের ঘরগুলো তৈরি করা হয়নি। পুরো জায়গাজুড়েই তা ছড়িয়ে আছে। সেখানে কোনও রাস্তা নেই, কেবল ফুটপাত আছে। সেখান দিয়েই ক্যাম্পের ঘনবসতিপূর্ণ অংশের দিকে যেতে হয়। কোনও ধরনের পরিকল্পনা ছাড়াই অবিশ্বাস্য রকমের খাড়া পাহাড়ের ওপর ঘর তৈরি করেছে লোকজন।‘

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন নিয়ে একের পর এক টুইট করেছেন জ্যাসন। ৮ ফেব্রুয়ারি করা এক টুইটে তিনি লিখেছেন: ‘ভাবুনতো, আপনার কোনও দেশ নেই, পাসপোর্ট নেই, যেখানে জন্মগ্রহণ করেছেন সেখানে থাকার অধিকার নেই। এখন আপনি একটি শরণার্থী শিবিরে আটকা পড়ে গেছেন। আপনাকে সেখান থেকে কোথাও যেতে দেওয়া হচ্ছে না। ভারী বর্ষণের ঝুঁকিতে থাকতে হয়। এই ভ্রমণের পর আমি নিজেকে নিয়ে সান্ত্বনা পেয়েছি যে আমাকে রাষ্ট্রহীন আর নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের মতো জন্মাতে হয়নি।’

Jason Beaubien

@jasonbnpr
Imagine you have no country, no passport, no right to BE in the place you were born. Now you’re trapped in a refugee camp. You’re not allowed to leave. The rains loom. This trip made me damn glad I wasn’t born a #Rohingya– stateless, persecuted. #lotteryofbirth. @MSF_USA https://twitter.com/NPRGoatsandSoda/status/961362776286486528 …

8:44 PM – Feb 8, 2018
25
24 people are talking about this
Twitter Ads info and privacy
রোহিঙ্গাদের জন্য নির্মিত শরণার্থী শিবিরে মৌসুমী বৃষ্টি, অচেনা রোগ কিংবা বিভীষিকাময় রাখাইনে ফিরিয়ে দেওয়ার শঙ্কার কথা এসেছে জ্যাসন বিউবিয়ের প্রতিবেদনে। ২১ জানুয়ারিতে এনআরপি-তে প্রকাশিত আরেক প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর রাখাইনে ফেরার ব্যাপারে অনীহার কথা উঠে আসে। ২৭ জানুয়ারির প্রতিবেদনে উঠে আসে রোহিঙ্গা শিবিরে ডিপথেরিয়া ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কার কথা। ফেব্রুয়ারির ৮ তারিখের প্রতিবেদনে চিত্রিত হয় ‘মৌসুমী বন্যার আশঙ্কায় থাকা এক রোহিঙ্গা শিবিরে’।

পরদিন ৯ ফেব্রুয়ারি এনআরপি’কে দেওয়া জেসনের সাক্ষাৎকারে উঠে আসে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের বাস্তবতা। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বাংলাদেশ মানবিক বাস্তবতায় রোহিঙ্গা প্রবেশে বাধা দিতে পারছে না, তবে বাংলাদেশ আর্থ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কারণেই চায় না রোহিঙ্গারা আসুক। জানান, ‘আমি যখন সেখানে ছিলাম তখন স্থানীয় বাংলাদেশি লোকজন বিক্ষোভ করেছে। শরণার্থীরা প্রতি মাসে রেশন এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা পাওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন স্থানীয়রা। স্থানীয়দের অভিযোগ, বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর কারণে স্থানীয় বাজারে দ্রব্যমূল্য বেড়ে গেছে। তাছাড়া বেসরকারি খাতে স্থানীয়দের কর্মসংস্থান কমার জন্যও দায়ী করা হয়েছে রোহিঙ্গাদের। তাদের আসার পর রাজধানী ঢাকার কিংবা কোনও পশ্চিমা দেশের নাগরিকরাই এসব সুযোগ গ্রহণ করছেন বলে দাবি তাদের। বেশ কয়েকজন স্থানীয় বাংলাদেশি আমাকে বললেন শরণার্থীদেরকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত।’

বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার আগমন নিয়ে স্থানীয়দের বিক্ষোভ
জ্যাসন মনে করেন, রাজনৈতিকভাবে দশ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার বিষয়টি সরকারের মাথা ব্যথা। যতদিন পর্যন্ত এ সংকট চলবে ততদিনে তা আরও বেশি সমস্যা আকারে হাজির হবে। রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিন থেকে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে কিনা এমন প্রশ্ন করা হলে জ্যাসন বলেন, ‘হ্যাঁ। শরণার্থী এবং ত্রাণ সংগঠন দুপক্ষই দীর্ঘদিনের জন্যই প্রস্তুতি নিচ্ছেন। প্রথমে লোকজন মাটিতে গর্ত করে এবং চারপাশে প্লাস্টিক দিয়ে ঢেকে টয়লেট তৈরি করলো। এখন তারা ইটের ঘর তৈরি করছে। স্কুল স্থাপন করা হচ্ছে। গভীর নলকূপ বসানো হচ্ছে। শিগগিরই এসব লোক কোথাও যাচ্ছেন না।’

রাখাইনের দুঃসহ স্মৃতিতে ফিরতে চান না রোহিঙ্গারা। জ্যাসন বাংলাদেশ সফররত অবস্থায় ৮ ফেব্রুয়ারি ব্যক্তিগত টুইটার পোস্টে লিখেছেন, বাংলাদেশে এক সপ্তাহ কাটল রোহিঙ্গা শিবিরের মানুষজনদের সঙ্গে। একজনও মিয়ানমারে ফেরার আগ্রহ প্রকাশ করেনি তার কাছে। বাংলাদেশও তাদের চায় না। তাঁবুতে তাঁবুতে এই অনিশ্চয়তা নিয়েও, একগাদা হতাশার ভেতরেও জীবনের আর্তি থামেনি রোহিঙ্গাদের। শিবিরে সাপুড়ের সাপ খেলা, তার কাছে থাকা ভেষজ বিক্রির ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন জ্যাসন।

হাকিমপাড়া ক্যাম্পে ফুটবল খেলছে রোহিঙ্গারা১৩ তারিখের এনআরপি-তে রোহিঙ্গা শিবিরের শরণার্থী শিশু ফায়েজ কামালকে নিয়ে এক হৃদয়গ্রাহী প্রতিবেদন করেন জ্যাসন। প্লাস্টিক আর বাঁশ দিয়ে ঘুড়ি তৈরি করে শিশু ফায়েজ শিবিরে থাকা অন্যান্য শিশুকে সেই ঘুড়ি উপহার দেয়। জ্যাসন তার টুইটার পোস্টে লিখেছেন, এই ঘুড়িগুলোই রোহিঙ্গা শিশুদের একমাত্র আনন্দ। আর কোনও খেলনা নেই তাদের। হতাশার ভবিতব্যকে ছাপিয়ে তাঁবু সংলগ্ন আকাশে এসব ঘুড়ি উড়িয়ে দিচ্ছে রোহিঙ্গা শিশুরা। এত কঠোর জীবন-বাস্তবতাকে ভেদ করে হেসে উঠছে আনন্দে। এখানে মানুষের জীবনবোধের দেখা পান জ্যাসন। নিজ পত্রিকায় ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, মাত্র কয়েক মাসেই তাঁবুতে গড়ে তোলা হয়েছে মসজিদ, শিশুদের কেউ কেউ ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। ফুটবল খেলার জায়গা আছে। ভলিবলের মতো জনপ্রিয় একটি খেলা আছে। তবে এ খেলায় হাত ব্যবহার করা যায় না, কেবল লাথি দিয়ে বল নেটে ঢোকাতে হয়। শরণার্থী জীবনের দিশাহীন ভবিষ্যৎ আর অন্তহীন যন্ত্রণা নিয়েও সাপ-বেজির লড়াইয়ের খেলা দেখতেই জড়ো হয় মানুষ।

পাঠকের মতামত: