অনলাইন ডেস্ক ::
সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় ফাঁসির আদেশ পেলেও টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশের বিরুদ্ধে কথিত বন্দুকযুদ্ধ ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে আছে আরও ১৮টি মামলা। এর মধ্যে কক্সবাজারে রয়েছে ১৪টি অভিযোগ, অপর চারটি চট্টগ্রামে। আদালতের নির্দেশে এসব অভিযোগের তদন্ত করছে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট। এর মধ্যে দুর্নীতির মামলায় প্রদীপ ও তার স্ত্রী চুমকির বিরুদ্ধে বিচারকাজ সম্প্রতি চট্টগ্রাম আদালতে শুরু হয়েছে।
অন্যদিকে কথিত বন্দুকযুদ্ধ ও টাকার জন্য নির্যাতনের তিনটি অভিযোগ থেকে প্রদীপ রেহাই পেয়েছেন। এর বাইরে বাকি ১৮টি মামলা চলছে। এর মধ্যে অনেকগুলো মামলা তদন্ত শেষে বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন। অন্যদিকে কিছু অভিযোগের তদন্ত চলছে এখনও। তবে অনেকগুলো মামলার তদন্তে নেমে এসেছে অস্বাভাবিক ধীরগতি। আবার নানান জটিলতায় বিরক্ত বাদিরা মামলা চালাতেও আগ্রহ পাচ্ছে না। আদালতের নির্দেশে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) কথিত বন্দুকযুদ্ধের চারটি অভিযোগের তদন্ত করছে। এই চারটি মামলায় প্রধান অভিযুক্ত বরখাস্ত ওসি প্রদীপ।
সিনহা হত্যার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির জিজ্ঞাসাবাদে বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ জানান, তার সময়কালে যেসব বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটেছে, তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি নিজের অস্ত্র ব্যবহার করেছেন। ওই কমিটির সদস্যরা জানতে চেয়েছিলেন, আপনার সময়কালে ১০৬টি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় ১৭৪ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। এগুলোতে কি আপনি সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন? প্রদীপ বলেছেন, বেশির ভাগই তার নেতৃত্বে হয়েছে। কমিটি জানতে চেয়েছিল, আপনি কতবার নিজে গুলি করেছেন, কী অস্ত্র দিয়ে গুলি করেছেন? জবাবে প্রদীপ বলেছেন, তিনি ২০-৩০ বার গুলি করেছেন, ব্যক্তিগত অস্ত্র দিয়ে।
প্রদীপ তদন্ত কমিটিকে বলেন, ‘আমার সাড়ে সাত লাখ টাকা দামের একটি ওয়াল্টার পিস্তল আছে। আমার কাছে যেটা আরামদায়ক মনে হয়, আমি সেটা ব্যবহার করি। তা ছাড়া সরকারি কাজে ব্যক্তিগত অস্ত্র ব্যবহার করা যায়।’ ব্যক্তিগত অস্ত্রের গুলির হিসাব কীভাবে রাখতেন? কমিটির এ প্রশ্নের জবাবে প্রদীপ বলেন, জিডি করে নিজের পিস্তলের গুলির হিসাব রাখতেন। প্রদীপের কাছে কমিটি জানতে চায়, আপনি কি সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন, নাকি অধীনস্থদের পেছনে থাকেন? জবাবে প্রদীপ বলেন, ‘আমি সামনে থেকেই পরিচালনা করি।’
২০২০ সালের ১৩ জুলাই চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার বাহরাইনপ্রবাসী আজাদ নিখোঁজ হন। এর দুদিন পর ১৫ জুলাই আজাদের বড় ভাই ফারুককে বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজের সামনের ভাড়া বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় চন্দনাইশ থানা পুলিশ। ওই দিন সন্ধ্যায় ফারুককে টেকনাফ থানায় হস্তান্তর করা হয়। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ফারুক ও আজাদের মায়ের মোবাইল ফোনে একটি নম্বর থেকে ফোন আসে। অজ্ঞাত একজন বলেন, ‘তোর দুই ছেলে আমাদের কাছে আছে। দুই ছেলেকে জীবিত ফেরত চাইলে রাতের মধ্যে আমাদের আট লাখ টাকা দিতে হবে। না হলে সকালে ছেলের লাশ পাবি। এরপরই লাইন কেটে দেওয়া হয়।’ ২০২০ সালের ১৬ জুলাই ফারুক ও আজাদকে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে হত্যা করেন টেকনাফ থানার বহিষ্কৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। চন্দনাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কেশব চক্রবর্তীর যোগসাজশে এই হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ করা হয়। এ ঘটনায় ২০২০ সালের ২ সেপ্টেম্ব নিহতদের ছোট বোন রিনা সুলতানা শাহীন তার দুই ভাইকে অপহরণ, মুক্তিপণ দাবি ও হত্যার অভিযোগে চট্টগ্রামের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কামরুন নাহার রুমীর আদালতে মামলা দায়ের করেন।
৭০ লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে দুই ব্যক্তিকে কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যার অভিযোগে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশের বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়। এর একটিতে প্রদীপসহ ১৬ জনকে এবং অন্যটিতে ১৫ জনকে আসামি করা হয়। একটি মামলার বাদি হয়েছেন টেকনাফ সদর ইউনিয়নের নাজিরপাড়ার বাসিন্দা লায়লা বেগম। সেই মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের ১৯ মার্চ বীজ ও সার আনতে উপজেলা সদরের কৃষি অফিসে যান তার স্বামী নুর মোহাম্মদ। এ সময় তাকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে পরিবারের কাছে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন ওসি প্রদীপসহ অন্যরা। তারা পাঁচ লাখ টাকা জোগাড় করে দেন। কিন্তু ২১ মার্চ রাতে নুর মোহাম্মদকে সৈকতের ঝাউবাগানে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
প্রদীপকে অভিযুক্ত করে দায়ের করা আরেক মামলার বাদি টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ডেইলপাড়ার বাসিন্দা হালিমা বেগম এজাহারে অভিযোগ করেন, ২০১৯ সালের ১৮ অক্টোবর টেকনাফ থানার একদল পুলিশ তার ছেলে মো. আজিজ এবং স্থানীয় নুর হাসান ও আবুল খায়েরকে তুলে নিয়ে যায়। পরে আজিজের পরিবারের কাছে ২০ লাখ টাকা দাবি করেন ওসি প্রদীপসহ অন্যরা। না দিলে বন্দুকযুদ্ধে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। বিভিন্নভাবে ৫০ হাজার টাকা সংগ্রহ করে পুলিশকে দেয় আজিজের পরিবার। কিন্তু ১৯ অক্টোবর রাতে টেকনাফের মহেশখালীয়াপাড়া নদীঘাট এলাকায় আজিজকে হত্যা করা হয়।
কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা মৌলভীবাজার এলাকার মিয়া হোসেনের পুত্র মাহামুদুল হক সৌদি আরবের প্রবাসজীবন থেকে দেশে আসার পর ওসি প্রদীপ কুমার দাশ বাড়িতে পুলিশ পাঠিয়ে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন তার কাছ থেকে। টাকা না দেওয়ায় ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ তাকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। ছেড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে পাঁচ লাখ টাকা দিলেও ৩১ মার্চ মাহামুদুল হককে কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে ২০২০ সালের ২৬ আগস্ট মামলা করেন নিহতের ভাই নুরুল হোছাইন। এতে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। আদালত টেকনাফ থানাকে তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের আদেশ দেন। তবে এই মামলার কোনো অগ্রগতি আর দেখা যায়নি।
টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের অটোরিকশা চালক আবদুল জলিলকেও কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যা করা হয়। পাঁচ লাখ টাকা দেওয়ার পরও জলিলকে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ করেন তার পরিবার। এই ঘটনায় ২০২০ সালের ২৭ আগস্ট আদালতে মামলা করেন জলিলের স্ত্রী ছেনোয়ারা বেগম। এতে হোয়াইক্যং পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মসিউর রহমানকে প্রধান আসামি করা হয়। আসামি হিসেবে ওসি প্রদীপ কুমারের নাম রয়েছে দুই নম্বরে। এই মামলারও কোনো অগ্রগতি হয়নি পরে।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে বাহারছড়ার সুপারি ব্যবসায়ী আবদুল আমিনের কাছে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে টেকনাফ থানার পুলিশ। কিন্তু টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আমিনকে গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর সকালে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে আসে একদল পুলিশ। থানায় নিয়ে গিয়েও পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন ওসি প্রদীপ। শেষে বাধ্য হয়ে ৫০ হাজার টাকা দেয় পরিবার। বাকি টাকার জন্য ৩০ সেপ্টেম্বর আমিনের স্ত্রীকে ডেকে নিয়ে যায় পুলিশ। কিন্তু স্ত্রী টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে ওই দিন রাতে ওসি প্রদীপের নেতৃত্বে একদল পুলিশ আবদুল আমিনকে ক্রসফায়ারের নামে গুলি করে হত্যা করে বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়।
মুফিজ আলম নামের আরেক ব্যক্তির কাছে ১৫ লাখ চাঁদা দাবি করে টেকনাফ থানা পুলিশ। কিন্তু টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। একপর্যায়ে টাকা না দিলে ক্রসফায়ারে হত্যার হুমকি দেয়। তাই বাধ্য ২০১৯ সালের ১২ জুলাই পুলিশকে ছয় লাখ টাকা দেন মুফিজ। টাকা নেওয়ার পরদিনই মুফিজ আলমকে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়।
২০২০ সালের ১৮ আগস্ট চাহিদামতো ঘুষ দেওয়ার পরও এক ব্যক্তিকে কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যার অভিযোগ এনে প্রদীপ কুমার দাসসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা করা হয়। এই মামলাটি করেন টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের মৌলভীবাজার এলাকার গুল চেহের। তিনি অভিযোগ করেছেন, পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ দেওয়ার পরও তার ছেলে সাদ্দাম হোসেনকে কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যা করা হয়। এই মামলায় প্রদীপ কুমার দাশ দুই নম্বর আসামি। মামলার ২৮ আসামির ২৭ জনই পুলিশের সদস্য।
২০২০ সালের ৩১ আগস্ট কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. হেলাল উদ্দীনের আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন টেকনাফ উপজেলার রঙ্গিখালী এলাকার বাসিন্দা সুলতানা রাবিয়া মুন্নী। মামলায় ৪১ আসামির মধ্যে ৩৫ জনই পুলিশ সদস্য। ওসি প্রদীপকে মামলায় এক নম্বর আসামি করা হয়েছে। এই মামলার এজাহারে বাদি অভিযোগ করেছেন, ২০২০ সালের ৬ মে দিবাগত রাত ২টার দিকে তার স্বামী সৈয়দ আলম, সৈয়দের ভাই নুরুল আলম এবং তাদের ভাগ্নে আনসার সদস্য সৈয়দ হোছন ওরফে আবদুল মোনাফকে ওসি প্রদীপ ও এসআই মশিউর রহমানের নেতৃত্বে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে এই তিনজনকে ‘ক্রসফায়ার’ থেকে বাঁচাতে তাদের পরিবারের কাছে ওসি প্রদীপ ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। টাকা না পেয়ে ওই রাতেই তিনজনকে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হত্যা করা হয়। সৈয়দ হোছন ওরফে আবদুল মোনাফ নিজেকে আনসার সদস্য পরিচয় দেওয়ার পরও তাকে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করা হয়।
টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের খারাইঙ্গ্যা ঘোনা এলাকার বাসিন্দা কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত মুছা আকবরের (৩৫) স্ত্রী শাহেনা আকতার বাদি হয়ে গত ২ সেপ্টেম্বর একটি মামলা করেন। এজাহারে বাদি উল্লেখ করেন, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি পুলিশ হোয়াইক্যং ইউনিয়নের খারাইঙ্গ্যা ঘোনার বাসিন্দা মুছা আকবরের বড় ভাই আলী আকবরের বাড়ি পুড়িয়ে দেয় টেকনাফ থানার একদল পুলিশ। পরে এ ঘটনায় কক্সবাজার প্রেসক্লাবে একটি সংবাদ সম্মেলন করে ওই পরিবারের সদস্যরা। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে গত ২৮ মার্চ রাতে মুছা আকবরকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে ক্রসফায়ার না দেওয়ার কথা বলে মুছার পরিবারের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা দাবি করা হয়। কিন্তু পরিবার তখন তিন লাখ টাকা দিলেও ওই দিন ভোরে মুছা আকবরকে ক্রসফায়ারের নামে গুলি করে হত্যা করা হয়।
২০১৯ সালের ১৭ এপ্রিল টেকনাফ থানার এসআই দীপক বিশ্বাসের নেতৃত্বে একদল পুলিশ টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের কাঞ্জরপাড়া এলাকার সাহাব উদ্দীনকে (৩০) তার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। পরে ক্রসফায়ার না দেওয়ার কথা বলে তার পরিবারের কাছে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করা হয়। কিন্তু পরিবার ৫০ হাজার টাকা এনে দিলেও আরও চার লাখ ৫০ হাজার টাকা না দেওয়ায় ২০ এপ্রিল রাতে কাঞ্জরপাড়া ধানক্ষেতে ক্রসফায়ারের নামে সাহাব উদ্দীনকে গুলি হত্যা করা হয়। সাহাব উদ্দিনের বড় ভাই হাফেজ আহমদ এ ঘটনায় ২০২০ সালের ২ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (টেকনাফ-৩) হেলাল উদ্দীনের আদালতে মামলা করেন। সৌজন্যে সিটিজি প্রতিদিন
পাঠকের মতামত: