অনলাইন ডেস্ক :::
একান্ত সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মোস্তফা সোহেল আহমদ
‘মানবাধিকার চর্চা অন্যের ক্ষতিসাধন ও প্রশান্তি বিনষ্টের কারণ হতে পারবে না’
মানবাধিকার সম্পর্কে একটু বিস্তারিত জানতে চাই :
মোস্তফা সোহেল: মানবাধিকার প্রতিটি মানুষের এক ধরনের অধিকার যা তার জন্মগত ও অবিচ্ছেদ্য। মানুষ এ অধিকার ভোগ করবে এবং চর্চা করবে- এটাই মৌলিক । তবে এ চর্চা অন্যের ক্ষতিসাধন ও প্রশান্তি বিনষ্টের কারণ হতে পারবে না। মানবাধিকার সব জায়গায় এবং সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। এ অধিকার একই সাথে সহজাত ও আইনগত অধিকার। স্থানীয়, জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক আইনের অন্যতম দায়িত্ব হল এসব অধিকার রক্ষণাবেক্ষণ করা।
মানবাধিকারের ইতিহাস নিয়ে যদি আরো বিস্তারিতভাবে বলতেন ?
মোস্তফা সোহেল :
মানবাধিকার মানবাধিকারের ধারণাটি আঠারো শতকে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের বিকাশকালের ফসল। তবে সমসাময়িক মানবাধিকারের ধারণার উদ্ভব ঘটেছে সাম্প্রতিক কালে। মৌলিক অধিকারের ধারণার বিকাশ ঘটে মূলত ‘সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র’ (ইউডিএইচআর)-এর মাধ্যমে, যা ১৯৪৮ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ধ্বংসযজ্ঞের অভিজ্ঞতা থেকে জাতিসংঘ কর্তৃক একটি সনদ হিসেবে গৃহীত হয়। তবে মানবাধিকারের আলোচনা বিশ্বব্যাপি প্রসার লাভ করে বিশ শতকের চল্লিশ থেকে নববইয়ের দশকের মধ্যবর্তী সময়ে। বর্তমানে যেকোন বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবাধিকারের ধারণা একটি প্রাথমিক কাঠামোগত ভিত্তি হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত।
বাংলাদেশে মানবাধিকার ধারণাটি ও এনজিওদের সম্পৃতক্তা নিয়ে আপনার কোনো মূল্যায়ন আছে কিনা ?
মোস্তফা সোহেল : বিশ শতকের আশির দশকে বাংলাদেশে আন্দোলিত নাগরিক সমাজ তাদের আন্দোলনের মুখে সামরিক শাসক কর্তৃক বারবার নিগৃহীত এবং স্বাধীন মতামত প্রকাশের উপর নিয়ন্ত্রন বা হস্তক্ষেপের শিকার হতো। গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে সারা বিশ্বে যখন একনায়কতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছিল, বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের আন্দোলন তখন মানবাধিকারের কাঠামোর আওতায় একটি শক্তিশালী ভিত্তি পেয়েছিল। নেতৃস্থানীয় মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ সময় প্রতিষ্ঠিত হয়. বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা ১৯৭৭ সাল থেকে অভিভাবকের মতো মানবাধিকার নিয়ে অন্য অন্য সংশ্লিষ্ট এনজিওদের নিয়ে কাজ করছে। এখন এনজিওগুলো এ বিষয়ে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা সম্পর্কে কিছু বলুন
মোস্তফা সোহেল: মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা বাংলাদেশের শীর্ষ মানবাধিকার সংগঠন। দেশের ভেতরে এই সংগঠন এর প্রায় ৩৫৮ টি শাখা রয়েছে। রয়েছে এত হাজারের অধিক মানবাধিকার কর্মী। এদের মধ্যে সাড়ে চার হাজার আছেন সরাসরি আইন পেশায় সংযুক্ত।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার কার্যক্রম সম্পর্কে সংক্ষেপে জানতে চাই
মোস্তফা সোহেল: আমাদের সংগঠনের প্রাথমিক কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে নারী ও শিশুর অধিকার সংরক্ষণে আইনগত সহায়তা, প্যারালাল ইনভেস্টিগেশন , লিগ্যাল এইড ক্যাম্প পরিচালনা, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রিট , নারীর ক্ষমতায়নে এবং বিচার ব্যবস্থায় তাদের জন্য একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্র নির্মাণের প্রচেষ্টা , থানা মনিটরিং , ক্যাপাসিটি বিল্ডিং , সার্ভে , পলিসি এডভোকেসি , রিসার্চ ইত্যাদি। পাচার নিরোধে আইনি সহায়তা নিয়েও আমরা কাজ করছি । সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন , ইউএনডিপি , আই ওএম, উইনরক সহ এৰকম বিভিন্ন আস্তজাতিক সংস্থার সাথে কাজ করছে।
গত ছয় মাসের দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আপনাদের কোনো মূল্যায়ন আছে কিনা ?
মোস্তফা সোহেল: হ্যা। আছে। গত ছয় মাসে মাসে (জানুয়ারী থেকে জুন) অন্তত দেশের সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থতির ইতিবাচক কোন পরিবর্তন হয়নি !তবে কিছু কিছু খেত্রে অপরাধ দমনের প্রক্রিয়ায় সরকারের প্রচেষ্টাও আন্তরিক ছিলো। সংস্থার মাসিক পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার মাধ্যমে গত ছয় মাসের এ চিত্র সামনে আসে। পারিবারিক ও সামাজিক নৃসংশতার বিষয়টি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে যা উদ্বেগজনক। শিশু হত্যা, শিশু ধর্ষণ, গণ ধর্ষণ,পারিবারিক ও সামাজিক কোন্দলে আাহত ও নিহত, নারী নির্যাতন, রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনাগুলি ছিল উল্লেখযোগ্য । গত ছয় মাসে মাসে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রস ফায়ারে নিহত হন ৭৯ জন। পুলিশের ক্রস ফায়ারে ৬৪ জন, র্যাবের ক্রস ফায়ারে ১৩ জন ও যৌথ বাহিনীর হাতে ২ জন নিহত হন। তাছাড়া বি এসএফ কর্তৃক নিহত হয় ১৩ জন ও ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ৯ জনকে!
গত ছয় মাসে মাসে ১৫৪ শিশুকে হত্যা করা হয় । এদের মধ্যে পিতা মাতা কর্তৃক খুন হয় ২৩ শিশু। আর বিভিন্ন ভাবে নির্যাতনের শিকার হয় ১৩০ শিশু । শিশু হত্যার ঘটনা সবচেয়ে বেশী ঢাকা বিভাগে আর কম বরিশাল বিভাগেগত ছয় মাসে মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৩০৩ জন নারী ও শিশু ।
দেশে এতো খুন , ধর্ষণ রোধে বা প্রতিকারমূলকভাবে কি ধরণের সুপারিশ রাখবেন ?
মোস্তফা সোহেল : আসলে আইনের সঠিক প্রয়োগ, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষন ও প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন, অপরাধিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, নৈতিক অবক্ষয় রোধে বিভিন্ন পর্যায়ে কাউন্সিলিং, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দক্ষতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ, ভালো কাজের জন্য পুরষ্কার, সামাজিক সংগঠন গুলোর বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম স্কুল কলেজগুলোতে সচেতনতামূলক কার্যক্রম, মিডিয়ায় এসব পরীক্ষামূলক সম্প্রচার ইত্যাদির মাধ্যমে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব বলে মনে করে আমরা।
পাঠকের মতামত: