জাইকার অর্থায়ন, পাল্টে যাবে চকরিয়া
ছোটন কান্তি নাথ, চকরিয়া ::
জাইকার অর্থায়নে কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ি থেকে চকরিয়ার ফাঁসিয়াখালী পর্যন্ত চারলেন বিশিষ্ট ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক নির্মাণের কাজ শীঘ্রই শুরু হচ্ছে। মহেশখালীতে নির্মিতব্য গভীর সমুদ্র বন্দর ও মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ স্থাপনের জন্য মাতারবাড়ি থেকে ফাঁসিয়াখালী পর্যন্ত চারলেনের এই সড়ক নির্মাণের জন্য রুট এলাইনমেন্ট চূড়ান্ত করার কাজ এখন শেষপর্যায়ে। চকরিয়ার বদরখালী বাজারের কাছে যে কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অংশ এই রুটে পড়েছে তার বিকল্প হিসেবে করণীয় নির্ধারণে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মতবিনিময় সভাও করা হয়েছে। মূলত এই সমস্যাটি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা গেলেই এই সড়কটির নির্মাণকাজ শুরু হতে খুব বেশি সময় লাগবে না বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
গতকাল বৃহস্পতিবার চকরিয়া উপজেলা পরিষদে অনুষ্ঠিত ‘মাতারবাড়ি প্রস্তাবিত বন্দর সংযোগ সড়ক প্রকল্প অংশীজনের সভায় উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার নেতৃবৃন্দ, সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধি এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এই সভায় উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকার (জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো–অপারেশন এজেন্সি) প্রতিনিধিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জুন নাকা মুরা ও লরিও কোনো। এছাড়াও প্রকল্প ব্যবস্থাপক এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সফকাত হাসান, কনসালটেন্সি ফার্মের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন নুরুল আলম ছিদ্দিক। সভায় সভাপতিত্ব করেন ইউএনও নূরুদ্দীন মুহাম্মদ শিবলী নোমান। প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জাফর আলম। বক্তব্য দেন চকরিয়া থানার ওসি মো. বখতিয়ার উদ্দিন চৌধুরী, চকরিয়া প্রেস ক্লাবের আহ্বায়ক এম আর মাহমুদ এবং বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষ। এছাড়া ফাঁসিয়াখালী ইউপির চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী, পশ্চিম বড় ভেওলা ইউপির চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাবলা, চিরিঙ্গা ইউপির চেয়ারম্যান জসীম উদ্দিন, সাহারবিলের মহসিন বাবুল ও বদরখালীর খাইরুল বশরসহ এসব ইউনিয়নের অন্যান্য জনপ্রতিনিধিরা বক্তব্য দেন।
সভায় বক্তারা বলেন, চারলেনের বিশেষ এই সড়কটি নির্মাণের কাজ বাস্তবায়ন হলে একেবারে পাল্টে যাবে দৃশ্যপট। একদিকে উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ যেমন হবে এই এলাকায়, তেমনিভাবে বাণিজ্যিক, সড়ক যোগাযোগ, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে এই সড়ক। স্থানীয় বেকার ও শ্রমজীবী মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি এ অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পাবে। তাছাড়া এই সড়কটি বাস্তবায়ন হলে চকরিয়ার পুরো চিংড়ি জোন আইন–শৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। মূলত সড়ক যোগাযোগ স্থাপন না হওয়ায় প্রতিনিয়ত এই চিংড়ি জোনের আইন–শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সব মহলকে পীড়া দিয়ে আসছিল। সেই সমস্যাও ভবিষ্যতে দূরীভূত হবে।
চকরিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাফর আলম সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন। তিনি চকরিয়া নিউজকে বলেন, চারলেনের বিশেষায়িত এই সড়কটি নির্মাণের জন্য প্রাথমিকভাবে সবকিছুই চূড়ান্ত করে ফেলা হয়েছিল অন্য উপজেলা হয়ে। বিষয়টি আমি জানার পর বিদায়ী জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেনের সঙ্গে একান্ত বৈঠকসহ মন্ত্রণালয় পর্যন্ত লবিং করেছি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মহেশখালীর মাতারবাড়ি থেকে চকরিয়ার ফাঁসিয়াখালী পর্যন্ত দীর্ঘ ২৫ কিলোমিটারের চারলেন বিশিষ্ট এই সড়কটি এখন বাস্তবায়নের কাজ শুরু হওয়ার পথে।
জাফর আলম বলেন, শুধু তাই নয়, চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়া পৌরশহর চিরিঙ্গায় যাতে যানজট না থাকে সেজন্য বিশেষায়িত চারলেন সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে তিন কিলোমিটারের ফ্লাইওভার। এই ফ্লাইওভার নির্মাণকাজও অচিরেই শুরু হবে চকরিয়া ফাঁসিয়াখালী ভেণ্ডিবাজার থেকে মাতামুহুরী সেতু পর্যন্ত।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএও) নূরুদ্দীন মুহাম্মদ শিবলী নোমান চকরিয়া নিউজকে বলেন, জাইকার অর্থায়নে চারলেনের এই সড়কটি নির্মাণ করতে গিয়ে ব্যক্তি মালিকানাধীন যেসব জমি অধিগ্রহণ করা হবে তার জন্য তিনগুণ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। তাছাড়া যেসব ব্যক্তি চিংড়ি জোনের জমি ইজারা নিয়ে চিংড়ি উৎপাদন করে আসছিলেন, তারাও ব্যবসায়িক ক্ষতিপূরণ পাবেন। আর যাদের বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাদেরকে উপযুক্ত তিপূরণসহ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা থাকবে এই প্রকল্পে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলেই সিঙ্গাপুরের আদলে দৃশ্যমান হয়ে উঠবে চকরিয়া।
মাতারবাড়ি–ফাঁসিয়াখালী চারলেন বিশেষায়িত সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের ব্যবস্থাপক এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সফকাত হাসান চকরিয়া নিউজকে বলেন, চারলেনের সড়ক এবং মাতারবাড়ি সমুদ্র বন্দর নির্মাণের পুরোটাই অর্থায়ন করবে জাইকা। আর বাংলাদেশ সরকার ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন এবং ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়টা দেখার দায়িত্ব সরকারের।
তিনি আরো বলেন, সরকারের নেওয়া এই মেগাপ্রকল্পটিও বাস্তবায়ন সম্পন্ন হলেই উন্নয়নের ব্যাপক কর্মযজ্ঞও দৃশ্যমান হবে এখানে। যা এখানকার মানুষ এখনো বুঝতে পারছেন না। একসময় সিঙ্গাপুরের মতোই দেখাবে মহেশখালী ও চকরিয়াকে।
প্রকল্প ব্যবস্থাপক চকরিয়া নিউজকে জানান, মূলত জাইকার প্রতিনিধিরা এই সড়কটির রুট এলাইনমেন্ট চূড়ান্তভাবে তৈরি করার জন্য অনেকবার সার্ভে করেছে। এখনও সার্ভে কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এরই অংশ হিসেবে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার প্রতিনিধি এবং প্রকল্প অংশীজনের সঙ্গে বার বার বৈঠক করছেন জাইকার প্রতিনিধিরা। এসব বৈঠকের সারসংক্ষেপ এবং চূড়ান্ত রুট এলাইনমেন্ট সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করার পর উন্নয়নের এই কর্মযজ্ঞ শুরু করা হবে। যা একেবারে সময়ের ব্যাপার।
মহেশখালীতে বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের সংক্ষিপ্ত বিবরণ ঃ জাপান এবং বাংলাদেশ সরকার ‘বে অব বেঙ্গল ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট (বিআইজিবি) এর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর অধীনে ২০১৫ সাল থেকে জাইকা ডেটা কালেকশন সার্ভে অন ইন্টিগ্রেটেড ডেভলপমেন্ট ফর সাউদার্ন চিটাগং রিজিয়ন বাস্তবায়ন করছে। যা এ অঞ্চলের অবকাঠামো, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, শিল্প ও শহুরে উন্নয়ন এর সম্ভাব্য উন্নয়নের সম্ভাব্যতা যাচাই করছে। বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে জাপানের সহায়তাপুষ্ট ‘বিগ–বি উদ্যোগটি’তে মহেশখালী এলাকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মহেশখালীতে পরিকল্পিত বন্দরটিই হবে উন্নয়নের মূল অবকাঠামো।
রূপরেখা ঃ বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের অতিক্রান্ত সক্ষমতা এবং বড় আকারের জাহাজের প্রবেশের বিষয়টি মাথায় রেখে ইতোমধ্যে এই বন্দর প্রকল্পে কার্গো হ্যান্ডলিং মতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চাহিদাকে লক্ষ্যে রেখে প্রস্তাবিত বন্দর প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হয়েছে। প্রতিবেশি দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য সহজতর করার লক্ষ্যে প্রস্তাবিত বন্দরের গভীরতা ১৬ মিটার এবং ৮০০০ টিইইউ এর মত বড় ধারণ ক্ষমতার কন্টেইটার প্রবেশের নিশ্চয়তা রাখা হয়েছে। বন্দর হতে বেরিয়ে যাওয়া মালবাহী পরিবহনের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বন্দর থেকে জাতীয় সড়ক ও জাতীয় সড়ক থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত মালবাহী পরিবহনের নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করা।
প্রকল্পে উদ্দেশ্য ঃ চট্টগ্রাম বিভাগের মহেশখালী এলাকায় একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের মাধ্যমে বাংলাদেশের বন্দরের সরবরাহের সক্ষমতাকে জোরদার ও আঞ্চলিক প্রধান সড়কে এর প্রবেশের পথ তৈরি। যার ফলশ্রুতিতে প্রতিবেশি দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক সরবরাহের গতি বাড়ানো।
দায়িত্বশীল সংস্থা ঃ বন্দর অংশের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) এবং সংযোগ সড়ক অংশের জন্য সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ)।
প্রকল্পের অঙ্গসমূহ ঃ বহুমুখী টার্মিনাল (১৭ হেক্টর, জেটির দৈর্ঘ্য ৩০০ মিটার) ও কন্টেইনার টার্মিনাল (১৮ হেক্টর, জেটির দৈর্ঘ্য ৪৮০ মিটার) নির্মাণ। কার্গো হ্যান্ডলিং যন্ত্রপাতি ক্রয় (৩টি জেটি ক্রেইন)। প্রাসঙ্গিক সুবিধার ব্যবস্থা এবং সরঞ্জামের কেনাকাটা (টাগবোট, পাইলটবোট, বাতিঘর ইত্যাদি)। সংযোগ সড়ক নির্মাণ (প্রথমত ২ লেন ও সর্বশেষ ৪ লেনের ২৫ কিলোমিটার সড়ক) এবং ফ্লাইওভার (৩ কিলোমিটার)। পরামর্শসেবা (এফ/এস পর্যালোচনা, ডিডি, টিএ, সিএস, পরিবেশ ও সামাজিক সুরক্ষা, প্রযুক্তিগত হস্তান্তর)।
প্রকল্প এলাকা ঃ ২৫ কিলোমিটারের সংযোগ সড়কটি মহেশখালী উপজেলা থেকে চকরিয়ার ফাঁসিয়াখালী পর্যন্ত। এছাড়াও চট্টগ্রামের সঙ্গে সংযোগ সহজতর করতে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়া পৌরশহরে অতিরিক্ত তিন কিলোমিটারে ফ্লাইওভার স্থাপনের পরিকল্পনা। সংযোগ সড়কটি কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার ধলঘাটা, কালারমারছড়া, শাপলাপুরের উত্তর প্রান্ত হয়ে চকরিয়া উপজেলার বদরখালী, পশ্চিম বড় ভেওলার দক্ষিণ প্রান্ত, সাহারবিল, চিরিঙ্গা ও ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ওপর দিয়ে অতিক্রম করবে।
পাঠকের মতামত: