নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া :: মাতামুহুরী নদীকে একসময় বলা হতো মানুষের জন্য আশীর্বাদ। কিন্তু পাহাড় সাবাড়, বারুদ বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পাথর উত্তোলন, বৃক্ষ নিধনসহ নানা কারণে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বর্ষা মৌসুমে এই নদী রুদ্রু মূর্তি ধারণ করায় সবকিছুই লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে।
প্রতি বছর একাধিক বন্যায় উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে চকরিয়া ও পেকুয়ার মানুষের সর্বনাশ হচ্ছে। একদিনের বৃষ্টিতে নদীর দুই তীর উপচে ভয়াবহ বন্যায় রূপ নিচ্ছে। নদীর তীর ভাঙনে ভিটেছাড়া হচ্ছে মানুষ। বিলীন হচ্ছে কোটি কোটি টাকার ক্ষেত-খামার। বছরজুড়ে চেষ্টায় মেরামত করা সড়ক মুহূর্তেই ভেঙে যাচ্ছে। তাই অভিশাপে পরিণত হওয়া মাতামুহুরী নদীকে আপন মহিমায় ফেরানোটা জরুরি বলছেন স্থানীয় মানুষ এবং বিশেষজ্ঞরা। দীর্ঘ সময় ধরে মাতামুহুরী নদীকে যথাযথভাবে শাসন ও সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আসছেন এখানকার মানুষ।
সর্বশেষ মাতামুহুরী নদীর চকরিয়ার লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের হাজীপাড়া থেকে চকরিয়া পৌরসভার আবদুল বারিপাড়া পর্যন্ত তিন কিলোমিটার এলাকায় ড্রেজিং করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২০১৮ সালের মার্চে শুরু হওয়া সেই অপরিকল্পিত ড্রেজিং শেষ হয় ২০২০ সালের জুনে। এতে প্রায় সাত কোটি টাকা ব্যয় হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি বলে অভিযোগ।
অবশ্য মাতামুহুরী নদী ও সাঙ্গু নদী নিয়ে আশার কথা জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী। তিনি চকরিয়া নিউজকে বলেন, মাতামুহুরী নদীর ভাঙন রোধ করতে দুই তীর টেকসইভাবে সংরক্ষণের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৬৫ নম্বর পোল্ডারের অধীনে নদীর দুই তীর সংরক্ষণে আলাদা প্রকল্প প্রস্তাবনা প্রেরণ করা হয়েছে। এজন্য প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৮০০ কোটি টাকার। আগামী অর্থবছরে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হতে পারে।
পরিকল্পিত ড্রেজিং (খনন) বিষয়ে তিনি বলেন, মাতামুহুরী নদী ও সাঙ্গু নদীর পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা পরিকল্পিতভাবে করা হবে। ইতোমধ্যে দেশীয় সংস্থা ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) এর মাধ্যমে দুই নদীর তলদেশ খননের সম্ভাব্যতা যাচাই তথা ফিজিবিলিটি স্টাডি সম্পন্ন করা হয়েছে।
সংস্থাটি আগামী ৩ জুন প্রকল্প প্রস্তাবনা তুলে ধরবে। এরপর ড্রেজিং প্রকল্প প্রস্তাবনা অনুমোদনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করা হবে। তিনি বলেন, পরিকল্পিতভাবে খনন করে দুই নদীর গভীরতা ফিরিয়ে এনে গতিপথ ঠিক রাখার জন্য এই মহাপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলেই মাতামুহুরী ও সাঙ্গু নদী আশীর্বাদে পরিণত হবে।
মাতামুহুরী নদীর উৎপত্তি ও প্রবাহ : মাতামুহুরী নদী বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলার বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার সীমান্তের পাহাড়ি এলাকা তথা লুসাই পাহাড় (মাইভার পর্বত) হতে উৎপত্তি হয়েছে। উৎপত্তি স্থান থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে আলীকদম ও লামা উপজেলার মধ্য দিয়ে সাপের মতো আঁকাবাঁকা অগ্রসর হয়ে পশ্চিম দিকে কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলা অভিমুখে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। নদীটির দৈর্ঘ্য ১৭০ কিলোমিটার। এর মধ্যে চকরিয়া উপজেলায় পড়েছে ৪০ কিলোমিটার।
নদী ভরাটের কারণ : বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তামাক চাষ, পাহাড় সাবাড়, বৃক্ষ নিধন, পাহাড়ে বারুদ বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বোল্ডার পাথর উত্তোলনসহ নানা কারণে প্রতি বছর বর্ষায় উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ভরাট হচ্ছে নদীর তলদেশ। এ কারণে নদীর দুই তীর উপচে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে পানি।
২০১৫ সালে বন্যায় ক্ষতি ২০০০ কোটি টাকা : ২০১৫ সালের বন্যায় শুধু চকরিয়ায় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নিরূপণ করেছিল উপজেলা প্রশাসন। ৪০ বছরের ইতিহাসে রেকর্ড পরিমাণ চার দফা বন্যায় উপজেলার পাঁচ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ক্ষতিগ্রস্ত সাড়ে ৫ লক্ষ মানুষকে মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে বিশেষ বরাদ্দ দাবি করে ১৩ দফা প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছিল। সেই প্রস্তাবনার অন্যতম ছিল মাতামুহুরী নদীর দুই তীর সংরক্ষণ এবং পরিকল্পিত ড্রেজিং। পাঁচ বছরে ১৩ দফা প্রস্তাবনার একটিও বাস্তবায়ন হয়নি।
নদীশাসন হয়নি একবারও : বান্দরবানের থানচি সীমান্ত থেকে মাতামুহুরী নদী আলীকদম, লামা, চকরিয়ার কাকারা-কৈয়ারবিল-বেতুয়াবাজার হয়ে পেকুয়ার উজানটিয়া দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। এই নদীর জন্ম থেকে কখনো নদীশাসন বা খনন হয়নি। ২০১৫ সালের বন্যায় চকরিয়া উপজেলা প্রশাসনের ১৩ দফা সুপারিশের মধ্যে প্রধান ছিল বান্দরবানের লামার ইয়াংছা থেকে চকরিয়া উপজেলার বাঘগুজারা রাবারড্যাম পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার এবং বেতুয়াবাজার থেকে পালাকাটা রাবারড্যাম পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটারসহ মোট ৪০ কিলোমিটার এলাকায় নদীর খনন এবং উভয় তীরে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণসহ নদীশাসনের। ৩৯ পয়েন্টে নদীভাঙন ও বেড়িবাঁধ পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে মেরামত করে দেওয়া ছিল অন্যতম সুপারিশ।
প্রস্থ বেড়েছে, কমেছে গভীরতা : ১৯৮০-৮৫ সালে মাতামুহুরী নদীর গভীরতা ছিল ৩০-৪০ ফুট। প্রস্থ ছিল ৫০০-৭০০ ফুট। কিন্তু নদীর সাথে সংযোগকারী ঝিরি ও খালগুলো থেকে নির্বিচারে পাথর আহরণের কারণে একদিকে যেমন পানির উৎস হারিয়ে গেছে, অপরদিকে ঝিরির পলিতে ভরাট হচ্ছে নদী। গত কয়েক বছরে ভরাট হয়ে নদীর গভীরতা ১৫-২০ ফুটে চলে এসেছে। দুই তীর ভেঙে গিয়ে নদীর প্রস্থ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০০০-১২০০ ফুটে। সামান্য বৃষ্টিতে পানি ফুলে-ফেঁপে ওঠে তলিয়ে যায় তীরবর্তী লামা পৌর শহর ও আলীকদম উপজেলা সদর। নদীতে বর্তমানে নৌ-যান চলাচল করছে মাত্র ৩-৪ ফুট পানির মধ্য দিয়ে। কোনো কোনো অংশে আরও কম।
নদীশাসন জরুরি : প্রতি বছর বন্যা থেকে রক্ষায় মাতামুহুরী নদীকে যথাযথভাবে শাসন করতে হবে বলে মনে করেন চকরিয়া-পেকুয়া আসনের সংসদ সদস্য ও চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাফর আলম। তিনি বলেন, দেশ স্বাধীনের পর মাতামুহুরী নদীর ভাঙন রোধে দুই তীর সংরক্ষণ ও নদীর তলদেশের গভীরতা ঠিক রাখাসহ যথাযথভাবে শাসন করার কোনো প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়নি। অতীতে অনেকে এমপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও তারা সুদূরপ্রসারী কোনো পরিকল্পনা বা প্রকল্প গ্রহণ করেননি। যার খেসারত দিতে হয়েছে মানুষকে।
তিনি বলেন, এই নদীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ড্রেজিং এবং চকরিয়া ও পেকুয়া অংশে সিসি ব্লক বসানোসহ দুই তীর টেকসইভাবে সংরক্ষণে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। আগামী অর্থবছরে পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রথমে নদীর দুই তীর সংরক্ষণের কাজ শুরু করবে। এরপর হাত দেওয়া হবে পরিকল্পিত ড্রেজিংয়ে। এতে প্রতি বছর বন্যার হাত থেকে রক্ষা পাবে এখানকার মানুষ।
পাঠকের মতামত: