মহেশখালী প্রতিনিধি : নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি মহেশখালী এখন ভয়ঙ্কর। দেশের একমাত্র এই পাহাড়ি দ্বীপের পাহাড়গুলো দুর্ধর্ষ অপরাধীদের দখলে। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে রয়েছে তাদের অস্ত্র তৈরির কারখানা। আছে দুর্ধর্ষ দস্যুদের আস্তানা, অস্ত্রাগার, মাদক ও চোরাই পণ্যের গুদাম।
এসব পাহাড়ে সাধারণ মানুষ ভুলেও উঁকি দেয় না। সন্ত্রাসীদের আস্তানার কাছে গিয়ে প্রাণ নিয়ে ফিরে এসেছেন, এমন সংখ্যা নগণ্য। অধিকাংশেরই লাশ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। দেড় ডজন দুর্ধর্ষ দস্যু রয়েছে সেখানে, যারা প্রত্যেকেই একেকটি বাহিনী চালায়। আর যাদের নামে বাহিনী, তারা একেকজন মূর্তিমান আতঙ্ক। তাদের নামে মহেশখালীর গ্রামে শিশুদের এখনো ঘুম পাড়ানো হয়। দিনে দিনে পুরো নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় চলে যাচ্ছে মহেশখালী দ্বীপ। দ্বীপটিতে থানা আছে। আছে ফাঁড়ি। কিন্তু সেই সব পাহাড় থেকে পুলিশ কিছুটা দূরেই থাকে। এর পরও মাঝেমধ্যে চলে অভিযান। সেই অভিযানে অস্ত্রসহ দস্যুও গ্রেফতার হওয়ার ঘটনা আছে।
সাগর, নদী আর পাহাড়ের নিসর্গ সুন্দরের উল্টোদিকে যে ভয়ঙ্কর অন্ধকার জগৎ থাকতে পারে, এর প্রমাণ মহেশখালী।
গত মাসের শেষে টানা দুই দিন মহেশখালীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ভয়ঙ্কর জগতের নজিরবিহীন নানা তথ্য পাওয়া গেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভৌগোলিক অবস্থানগত সুবিধাকেই এখানে কাজে লাগাচ্ছে দস্যুরা। দুর্গম দ্বীপ। তাই চাইলেই তারা নিজেদের লুকিয়ে ফেলতে পারছে। অপেক্ষাকৃত ঝুঁকিপূর্ণ বলে পুলিশ-র্যাবকেও এগোতে হয় অনেকটা কৌশলে।
পুলিশ, গোয়েন্দা ও স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, মহেশখালীর ছোট-বড় ১১টি পাহাড় অপরাধীদের নিরাপদ আস্তানা। দুর্গম পথের এই পাহাড়গুলোর গহিন জঙ্গলে রয়েছে অন্তত ২২টি অস্ত্র তৈরির কারখানা। ২২ জন অস্ত্রের কারিগর পুরোদমেই সক্রিয় এসব কারখানায়। এখান থেকেই সারা দেশে অস্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছে। সন্ত্রাসীরা কক্সবাজার, মহেশখালী, চকরিয়া ও আশপাশের এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে খুন, মুক্তিপণ, অপহরণ ও ডাকাতিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ করে যাচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে এসব এলাকা থেকে গ্রেফতার হওয়া সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে মহেশখালীর পাহাড়ে তৈরি অস্ত্র পাওয়া গেছে।
কক্সবাজার শহরের নতুন বাহারছড়া ৬ নম্বর ঘাট থেকে স্পিডবোটে মাত্র ১৫ মিনিটের যাত্রা। এরপর কাটাখালী নদীর নীল পানি পার হয়ে সবুজ প্যারাবনের এক উপকূলীয় জনপদ। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি মহেশখালী। গোরকঘাটা ঘাট পেরিয়ে কালামার ছড়া বাজার পর্যন্ত ৩০-৩৫ কিলোমিটার দুর্গম রাস্তা ধরে যেতে যেতেই চোখে পড়বে পাহাড়। একপাশে পাহাড়, অন্যপাশে হাজার হাজার একর লবণ খেত, চিংড়ি ঘের আর পানের বরজ।
স্থানীয় যুবক মিরাজ জানালেন, এসব দখল নিয়েও বাহিনীতে বাহিনীতে চলে তুমুল সংঘর্ষ। লাশ পড়ে। রক্ত ঝরে। প্রশাসনের দাবি, এখানে পুলিশ ও র্যাবের সাঁড়াশি অভিযান চলে। কিন্তু অজানা কারণে, অজানা হাতের প্রভাবে বন্ধ হয় না কক্সবাজারের পাহাড়ি দ্বীপ মহেশখালীর অস্ত্র তৈরির কারখানা ও ব্যবসা।
সূত্র জানায়, রাজনৈতিক কারণে এখানে অস্ত্র তৈরির কারখানা বন্ধ করা যাচ্ছে না। কক্সবাজারে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন এমন এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, মহেশখালীর পাহাড়গুলো খুব ভয়ঙ্কর। এককভাবে কোনো সংস্থা অভিযান চালিয়ে কিছু করতে পারবে না। এককভাবে গেলে নিজেদের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা বেশি থাকবে। কারণ দুর্গম পথ। গহিন জঙ্গলে দস্যুদের বসবাস। পুলিশ এককভাবে পারবে না। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে অভিযান চালানো সেখানে সম্ভব নয়। আর এ জন্য অন্য কোনো দস্যু বাহিনীর সহায়তা নেওয়া প্রয়োজন। সেটি সবকিছু ঠিকঠাক করে করা যায়। সেখানকার অস্ত্র কারখানাও উচ্ছেদ করা সম্ভব। এ জন্য সব বাহিনীর যৌথ অভিযান প্রয়োজন। তবে ফল যে একেবারেই নেই সে কথা বলা যাবে না। আগে এখানে অস্ত্র কারখানা ছিল অর্ধশতাধিক। গত কয়েক বছরে পুলিশ-র্যাব কয়েকটি কারখানা উচ্ছেদ করে। বর্তমানে এর সংখ্যা কমে এসেছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সেখানে এখন ২২টি কারখানা রয়েছে। সূত্র জানায়, দেশের উপকূলীয় এলাকায় বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপের অস্ত্রের প্রধান সরবরাহ যায় মহেশখালীর ১১টি দুর্গম পাহাড়ে গড়ে ওঠা অস্ত্র তৈরির ২২টি কারখানা থেকে।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, ছোট মহেশখালী ইউনিয়নের কড়ইবুনিয়ার মুদিরছড়া পাহাড়, পাশের দেবাঙ্গীর পাহাড়, আধারঘোনা পাহাড়, হোয়ানক ইউনিয়নের বালুঘোনা, কেরুনতলীর পাহাড়, কালার মার ছড়ার মোহাম্মদ শাহ ঘোনা, ফকিরজোম ও ভাঙ্গামুরা পাহাড়, ইউনুসখালীর ধুয়াছড়ি পাহাড়, বড় মহেশখালীর মুন্সির ডেইল, মাঝের ডেইল, কমলাঘোনা শুরঘোনা পাহাড়, দেবাইঙ্গাপাড়া, বড় ডেইল, শুকরিয়াপাড়া, ফুড়িরঝিড়ি পাহাড়, শিয়াপাড়া, ভারুইতলী পাহাড়, চোলাই পাহাড় ও পানিরছড়া পাহাড়ে অস্ত্র তৈরির কারখানা রয়েছে।
পাঠকের মতামত: