ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪

ভয়াবহ বন্যায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-চকরিয়া মহাসড়ক ও টেকনাফ সড়কে যান চলাচল বন্ধ

নিজস্ব প্রতিনিধি :: কক্সবাজারে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। টানা কয়েকদিনের ভারী বর্ষণে কক্সবাজারের ৯ উপজেলার মধ্যে ৬ উপজেলার ৩ শতাধিক গ্রামের ৩ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় গতকাল সকাল থেকে কক্সবাজার–চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার–টেকনাফ মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বন্যায় এ পর্যন্ত ৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। পাহাড় ধস ও বন্যা মোকাবেলায় কক্সবাজার ও বান্দরবানে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিভীষণ কান্তি দাশ জানান, বন্যায় কক্সবাজার জেলার ৬০ ইউনিয়নের তিন লক্ষাধিক মানুষ জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। এসব এলাকায় কয়েক কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ পর্যন্ত তিন উপজেলায় ৬ জনের প্রাণহানি হয়েছে। দুর্গত মানুষদের জন্য ২০৮টি আশ্রয় কেন্দ্র খুলে দেয়া হয়েছে। ওখানে ৪০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি জানান, বন্যায় চকরিয়া–পেকুয়ায় ৪৮ কিলোমিটার আঞ্চলিক সড়ক, উখিয়ায় ৩ কিমি কাঁচা সড়ক এবং টেকনাফ মহাসড়কে আড়াই কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অতি বর্ষণে দুর্গতদের ইতোমধ্যে ৫৮ মেট্রিক টন চাল এবং নগদ ৭ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এদিকে দুর্যোগ মোকাবেলায় সেনাবাহিনীর ১০ পদাতিক ডিভিশন কাজ শুরু করেছে। রামু সেনানিবাসে কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে।

কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষণ কর্মকর্তা দুলাল চন্দ্র দাশ জানিয়েছেন, কক্সবাজারে গতকাল ভোর ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১৬৭ মিলিমিটার এবং ভোর ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ১৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। আজ থেকে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

এদিকে ভারী বর্ষণের কারণে সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় গতকাল সকাল হতে কক্সবাজার–চট্টগ্রাম সড়কে দূরপাল্লার যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দোহাজারী হাইওয়ে থানার চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কের চন্দনাইশের হাশিমপুর কসাইপাড়া, পাঠানীপুল, দোহাজারী পৌরসভার কলঘর ব্রিজ এলাকায় রাস্তার উপর প্রায় আড়াই ফুট এবং সাতকানিয়ার কেউচিয়ার নয়াখাল, নতুন রেললাইন, কেরানীহাট বাজার এবং ছদাহার হাসমতের দোকান এলাকায় মহাসড়কের উপর দিয়ে এক ফুটের বেশি পানি প্রবাহিত হলে যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। একই কারণে কক্সবাজার–টেকনাফ সড়কেও যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এই সড়কের রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের কাড়ির মাথা, চেইন্দা ও পানেরছড়া এলাকায় এই সড়কের উপর দিয়ে ৩ ফুটের বেশি পানি প্রবাহিত হয়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এই দুই সড়কে বন্যার পানি নামতে শুরু করলেও যান চলাচল শুরু হয়নি।

রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহমিদা মুস্তফা জানান, উপজেলার ফতেখাঁরকুল, গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া, চাকমারকুল, রাজারকুল, জোয়ারিয়ানালা, দক্ষিণ মিঠাছড়িসহ বিভিন্ন এলাকার পানিবন্দি। বাঁকখালী নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। বন্যাদুর্গতের জেলা প্রশাসকের দেয়া ২ মেট্রিক টন চাল ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে। দেয়া হচ্ছে শুকনা খাবার।

চকরিয়ায় চার লাখ লোক পানিবন্দি : চকরিয়া প্রতিনিধি জানান, চার দিনের একটানা বর্ষণ ও মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে চকরিয়ায় ৪ লাখ লোক পানিবন্দি রয়েছে। ভারী বর্ষণের কারণে গত সোমবার দিবাগত রাত ২টা থেকে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়া পৌরশহর চিরিঙ্গার ওপর দিয়ে পাহাড়ি ঢলের পানি শহরের পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হতে শুরু করে। এতে গত ৩০ বছরের বন্যার রেকর্ড ভেঙেছে।

এদিকে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উভয় দিকে শত শত যানবাহন আটকা পড়ে। গতকাল বিকাল সাড়ে ৬ টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত পৌরশহরের ওই অংশ দিয়ে মহাসড়ক উপচে পানিপ্রবাহ ছিল। তবে ধীরে ধীরে পানির উচ্চতা কমতির দিকে থাকলেও অব্যাহত ছিল বর্ষণ।

এলজিইডির নিয়ন্ত্রণাধীন প্রায় শতাধিক সড়ক ৮ থেকে ১০ ফুট পানিতে তলিয়ে থাকায় উপজেলা সদরের সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এ কারণে জরুরি প্রয়োজনে গাছ, বাঁশ ও কলাগাছের ভেলা ও নৌকায় করে যাতায়াত করতে দেখা গেছে।

চকরিয়া ও পেকুয়া মিলে প্রায় ৭ লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় দুর্বিষহ জীবন–যাপন করছেন। বাড়ির চালা পর্যন্ত ডুবে যাওয়ায় এসব মানুষ খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে ভুগছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, বন্যার শিকার হাজার হাজার শিশু, নারী–পুরুষ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য শতাধিক সাইক্লোন শেল্টার, প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে। লালিত গবাদি পশুগুলোকে নেওয়া হয়েছে মুজিব কিল্লাতে। সদরের সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। তলিয়ে গেছে চকরিয়ার চিংড়ি জোনের প্রায় ৪০ হাজার একরের চিংড়িঘের এবং দুই উপজেলার পাঁচ শতাধিক পুকুরের মাছ।

কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, চকরিয়ার প্রায় ৫০ হাজার একর জমিতে রোপিত আমন ধান ও রকমারি সবজি ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বন্যায় চকরিয়া ও পেকুয়ায় বেড়িবাঁধগুলো লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে।

এলজিইডি চকরিয়া উপজেলা প্রকৌশলী সেফায়াত ফারুক চৌধুরী জানান, নিয়ন্ত্রণাধীন ৪০০ কিলোমিটার রোড নেটওয়ার্কের মধ্যে অন্তত ৮০ শতাংশ সড়ক ৮ থেকে ১০ ফুট পানিতে তলিয়ে থাকায় সদরের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সোমবার রাত থেকে বন্ধ রয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহ। ইন্টারনেট ও মোবাইল নেটওয়ার্ক বিপর্যয়ের কারণে মানুষের দুর্বিষহ অবস্থা দেখা দিয়েছে।

পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পূর্বিতা চাকমা বলেন, পেকুয়া সদর ইউনিয়নস্থ মাতামুহুরী নদীতীরের বিশাল অংশ বেড়িবাঁধ ভেঙে সদরসহ উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের অন্তত দুই লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। জরুরি ভিত্তিতে বন্যাকবলিত মানুষের মাঝে শুকনা খাবার ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে।

চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেপি দেওয়ান জানান, বন্যায় উপজেলার ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। এসব মানুষ যাতে থাকা–খাওয়ার কষ্টে না ভোগেন সেজন্য তিন শতাধিক সাইক্লোন শেল্টার ও দুই শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সেখানে রান্না করা এবং শুকনা খাবার দেওয়া হচ্ছে।

তিনি জানান, জেলা প্রশাসকের ত্রাণ ও পুনর্বাসন ভান্ডার থেকে ২০ টন জিআর চাল, প্রয়োজন অনুযায়ী শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানিসহ বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এসব বরাদ্দ বন্যাকবলিতদের মাঝে বিতরণ চলছে। তিনি জানান, গতকাল দুপুর থেকে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত সংসদ সদস্য জাফর আলম, কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান ও চকরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদী বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন। এ সময় তারা ত্রাণ তৎপরতাও চালান।

চকরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদী বলেন, ৩০ বছরের ইতিহাসে এই ধরনের বন্যা মানুষ দেখেনি। সোমবার থেকে বন্যার্তদের মাঝে তার পক্ষ থেকে রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে বলে জানান।

পাঠকের মতামত: