নিউজ ডেস্ক ::
রাখাইনের পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক অভিযান চালাতে সামরিক বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছে মিয়ানমার সরকার। চলতি মাসে আরাকান আর্মির হামলায় ১৩ পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হওয়ার পর এ নির্দেশ এসেছে।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, গত মাসে রাজ্যটিতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির লড়াইয়ে পাঁচ হাজারের মতো লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
মূলত আরাকান আর্মির অধিকাংশ সদস্য এসেছেন নৃতাত্ত্বিক বৌদ্ধ গোষ্ঠীগুলো থেকে। সাম্প্রতিক এসব সহিংসতায় রাখাইনে মারাত্মক নৃতাত্ত্বিক বিভাজন আরও স্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছে, যা রাজ্যটিতে দীর্ঘদিন ধরে বড় ধরনের ক্ষতের জন্ম দিয়েছে।
২০১৭ সালের আগস্টের শেষ দিকে মুসলিম সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর অভিযানে সাড়ে সাত লাখেরও বেশি মানুষ পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন।
সাহায্য সংস্থাগুলোর কর্মীরা বলছেন, জানুয়ারির শুরুর দিকে রাখাইনে সামরিক বিমান ও ট্রাক আসতে দেখা গেছে। রাজ্যটিতে সহিংসতা চরম রূপ নিতে পারে বলে এতে আশঙ্কার জন্ম নিয়েছে।
মিয়ানমারে শান্তি নিশ্চিত করতে নোবেলজয়ী সু চির আশায় গুড়েবালি ঢেলে দিচ্ছেন এসব বিদ্রোহী গোষ্ঠী।
রাখাইনে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে এক দশক আগে আরাকান আর্মি গঠিত হয়েছে। বিচ্ছিন্ন কেন্দ্রীয় সরকারের মাধ্যমে তারা শোষিত হচ্ছেন বলে দাবি করছে সংগঠনটি।
শুরুর দিকে তাদের অনেক সদস্য রাখাইন বৌদ্ধদের মধ্য থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। এসব বৌদ্ধ জেড পাথরের খনিতে কাজ করে ভাগ্য নির্ধারণে উত্তর মিয়ানমারে গিয়েছিলেন।
চীনের সঙ্গে মিয়ানমার সীমান্তে তাদের জড়ো করে প্রশিক্ষণ দিয়েছে কাচিন মুক্তি বাহিনী (কেআইএ)। এ সংগঠনটিই অত্র অঞ্চলে প্রাধান্য বিস্তার করছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়া সবচেয়ে বড় নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী হচ্ছে কাচিনরা।
২০১৬ সালের শেষ দিক থেকে শান রাজ্যে উত্তরাঞ্চলীয় জোটের অংশ হিসেবে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কাচিনদের পাশাপাশি লড়াইয়ে নেমেছিল আরাকান আর্মির যোদ্ধারা।
ভারত ও বাংলাদেশ সীমান্তের পশ্চিমাঞ্চলীয় পাহাড়ি অঞ্চলেও চলাচল রয়েছে আরাকান আর্মির। সেখানে তাদের তিন হাজার সদস্য রয়েছে বলে মনে করা হয়।
রাখাইনে ২০২০ সাল নাগাদ একটি বিদ্রোহ উসকে দিতে লড়াইয়ের পাশাপাশি প্রচারও চালাচ্ছে আরাকান আর্মি।
অনলাইনে ভিডিওতে দেখা গেছে, বিদ্রোহী তরুণ ও তরুণীরা কুচকাওয়াজ ও মুষ্টিযুদ্ধ চর্চা করছেন। তারা আধুনিক অ্যাসল্ট ও স্নাইপার রাইফেল দিয়ে গুলি ছুড়ছেন। আরাকান আর্মির আধ্যাত্মিক নেতা টিওয়ান এমরাট নেয়াংকেও মাঝে মাঝে দেখানো হয়েছে ভিডিওতে।
নিজেদের প্রচারে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাখাইনকে বিভক্ত করে দেয়া বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গা মুসলমানদের সহিংসতাকে এড়িয়ে গেছে আরাকান আর্মি।
তবে প্রচারে অর্থনৈতিক শোষণ ও ঐতিহাসিক অবিচারের বিবরণ দিতে গিয়ে সেখানকার উর্বর ভূমির কথা সামনে নিয়ে এসেছেন তারা। সে ক্ষেত্রে আরাকান আর্মির অভিযোগের তীর মিয়ানমার রাষ্ট্র ও বার্মার নৃতাত্ত্বিক সংখ্যাগরিষ্ঠদের দিকে।
২০১৭ সালের বিশ্বব্যাংকের জরিপ বলছে- তেল, প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর ও চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড উদ্যোগের একটি কেন্দ্রবিন্দু হলে মিয়ানমারের সবচেয়ে দরিদ্র রাজ্যগুলোর একটি হচ্ছে রাখাইন।
সেখানে কেবল ১৭ শতাংশ বাড়িতে নিরাপদ সুপেয় পানি প্রবেশের সুযোগ রয়েছে, যা দেশটির অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় একেবারে নিম্ন পর্যায়ের। এ ছাড়া রাখাইনে তিন লাখ বাড়িতে স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই।
১৮ শতকে বার্মিজদের হামলার আগে ঐতিহাসিকভাবে আরাকান একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল।
গত বছরের জানুয়ারিতে আরাকান রাজ্যের পতনের বার্ষিকীতে একটি বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ প্রকাশ্যে গুলি চালালে রক্তপাতের মধ্য দিয়ে তা শেষ হয়।
এর মধ্যে রাখাইনের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল আরাকান ন্যাশনাল পার্টির (এএনপি) প্রধানকে আরেক কর্মীর সঙ্গে গ্রেফতার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়েছে। এখনও তাদের বিচারকাজ চলছে।
২০১৫ সালের নির্বাচনে এএনপি অধিকাংশ আসনে জয়ী হলেও পরের বছর ক্ষমতাগ্রহণের পর স্টেট কাউন্সিলর সু চির ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি রাজ্যটিতে নিজের একজন মুখ্যমন্ত্রীকে বসায়, যা রাখাইনের নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অসন্তোষ জন্ম দেয়ার আরেক কারণ।
গত কয়েক বছরে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ হয়েছে আরাকান আর্মির। কিন্তু গত কয়েক মাসে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে কয়েক ডজন সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি।
তাদের দাবি, রাখাইনে বেসামরিক লোকজনকে লক্ষ্যবস্তু করে সামরিক আগ্রাসনের জবাব দিচ্ছেন তারা।
আরাকান আর্মির প্রধান টিওয়ান এমরাট নেয়াং স্থানীয় গণমাধ্যম ইরাবতীকে বলেন, রাখাইন রাজ্যের অবশ্যই নিজস্ব সেনাবাহিনী থাকতে হবে। একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী থাকার অর্থ হচ্ছে- রাখাইনের নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোর অস্তিত্ব টিকে থাকবে।
আরাকান আর্মিকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করছে মিয়ানমার সরকার। তাদের দাবি, সংগঠনটি আগামী দিনগুলোতে রাজ্যটিকে অস্থিতিশীল করে তুলতে চাচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কাচিন বিদ্রোহীদের কাছে প্রশিক্ষণ নেয়া আরাকান আর্মি মিয়ানমারের জন্য সম্ভাব্য বড় ধরনের সামরিক হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। যেটি আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির চেয়ে অনেক শক্তিশালী হবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক অ্যান্তনি ডেভিস বলেন, আরাকান আর্মির যোদ্ধারা সুসজ্জিত ও পশিক্ষণপ্রাপ্ত। আগামীতে বড় ধরনের লড়াইয়ের পূর্বাভাস দিচ্ছে সাম্প্রতিক এসব সহিংসতা।
তিনি বলেন, রাখাইনে ২০১৫ সালে শুরু হওয়া রাজনৈতিক ও সামরিক অনুপ্রবেশের প্রস্তুতিমূলক পর্যায়কে একটি পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে রাখাইন আর্মি।
‘তাদের শক্তি তারা আরও বড় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। রাজ্যটির উত্তরাঞ্চলের সব শহরতলিতে প্রায় কোম্পানি ও প্লাটুন আকারে তারা পরিচালিত হচ্ছে,’ বললেন ডেভিস।
পাঠকের মতামত: