‘ভাতের মাড় দিয়ে কখনো দধি হয় না
এম.আর মাহমুদ :: আমার জন্ম চকরিয়ার কাকারা ইউনিয়নের একটি অজপাড়া গ্রামে। বলতে গেলে মাতামুহুরী নদীর পাড়েই আমার বসতবাড়ি। যেখানে আমার ১৪ গোষ্ঠী বসবাস করেছে। সে সুবাদে ছোট কাল থেকেই মাতামুহুরী নদীর সাথে পরিচয়। যে নদীতে সাঁতার শিখেছি, মাছ ধরেছি, বর্ষা মৌসুমে বন্যার পানির সাথে ভেসে আসা কাঠ, বাঁশ ও লাকড়ী ধরেছি।
মূলতঃ আলীকদমের শেষ সীমান্ত থেকে এ নদীর উৎপত্তি স্থল হলেও আলীকদম, লামা, চকরিয়া ও পেকুয়ার উপর দিয়ে সর্পিল গতিতে কুতুবদিয়া ও মহেশখালী চ্যানেলে মিলিত হয়েছে। এ নদী আমাদের ৪টি উপজেলার জন্য আশীর্বাদ। বর্ষাকালে প্রবল বর্ষণজনিত কারণে সৃষ্ট পাহাড়ী বন্যায় নদীর রূপ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলে নদীর দু’পাড় সহ ৪টি উপজেলারই কম বেশি ক্ষতি করে থাকে। তবে বন্যার পানির সাথে ভেসে আসা পলিতে এ ৪ উপজেলার কৃষি জমি উর্বর হয়ে উঠে। যখন দেখি নদী ভাঙ্গণের রাক্ষুসের রূপ ও বেড়িবাঁধ ভাঙ্গণের দৃশ্য তখন খুবই হতাশ হই। এ নদীতে বেশুমার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। বসতবাড়ি, ফসলি জমি, নদীগর্ভে তলিয়ে যেতে দেখেছি। যেমন চকরিয়ার পুরানো বিদ্যাপীঠ খ্যাত পুরাতন চকরিয়া হাইস্কুল স্টেডিয়ামসহ চকরিয়ার পুরাতন থানা সংলগ্ন বাজার, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের আলোচিত বাজার ফকিরাহাট, চকরিয়ার মানচিত্র থেকে অনেকটা বিলুপ্ত হয়ে নদীশিকিস্তি হয়ে পড়েছে। তবে ফকিরাহাট ও চকরিয়া হাইস্কুলের পুরাতন ভবনের ভূমি পুনরায় জেগে উঠেছে। কিন্তু নদী ভাঙ্গণ বন্ধ হয়নি। মাতামুহুরী নদী যতদিন বহমান থাকবে, ততদিনই কমবেশি ভাঙ্গণ থাকবে। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্বাচনী ওয়াদা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ঘুনিয়া বেড়িবাঁধ ও ১নং গাইড বাঁধসহ বেশ কিছু নদী ভাঙ্গণ রোধকল্পে কাজ করেছিল পানি উন্নয়ন বোর্ড। সে সময় পাথর ও বেড়িবাঁধ দিয়ে ভাঙ্গণ রোধ করেছিল। কিন্তু সেসব বেড়িবাঁধে লাখ লাখ সিএফটি পাথর যে বসানো হয়েছিল, সে পাথরগুলো বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে অবৈধভাবে রাতারাতি বিনাশ করেছে। যার পরিণাম আমরা এখন ভুগছি। সম্প্রতি বন্যার পর পানি উন্নয়ন বোর্ড চকরিয়ার পৌর এলাকার ১নং গাইডবাঁধ সংলগ্ন বেড়িবাঁধ রক্ষায় জিও ব্যাগ দিয়ে ভাঙ্গণ ঠেকানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী ও জেলা প্রশাসক মহোদয় ভাঙ্গণ কবলিত এলাকা পরিদর্শন করে জরুরীভাবে ভাঙ্গণ রোধ করার জন্য কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এক সময় পানি উন্নয়ন বোর্ড মাটির বেড়িবাঁধে পাথর ডাম্পিং ও প্লেসিন করে ভাঙ্গণ রোধ করত। যার উৎকৃষ্ট প্রমাণ মাতামুহুরী ব্রীজ সংলগ্ন বেড়িবাঁধ। এছাড়া কাকারা মানিকপুরসহ অনেক এলাকায় ব্লক বসিয়ে ভাঙ্গণ রোধ করেছে। বর্তমানে পানি উন্নয়ন বোর্ড জিও ব্যাগ ভর্তি বালুর বস্তা দিয়ে ভাঙ্গণ রোধের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এ পদ্ধতি একেবারে খারাপ নয়। যদি যথাসময়ে যথানিয়মে করা হয়, তবে বর্ষার আগে ভাঙ্গণ নিশ্চিত হওয়ার পর বালুর বস্তা দিয়ে সুফল পাওয়া অনেকটা বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এসব প্রকল্প এখনও চলমান। যেমন চকরিয়া উপজেলার কোনাখালী ইউনিয়নের কন্যারকুম, মরংঘোনা ও কাইদ্দ্যার দিয়া। এ তিনটি পয়েন্টের ভাঙ্গণ রোধকল্পে ১ কোটি ৪১ লাখ ৭৭ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রায় ৩২ হাজার জিও ব্যাগ ভর্তি বালুর বস্তা দিয়ে ভাঙ্গণ ঠেকানোর প্রকল্প গ্রহণ করেছিল পানি উন্নয়ন বোর্ড। প্রথম বন্যার তোড়ে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। অনেকে এসব জিও ব্যাগ ভর্তি বালুর বস্তা ডাম্পিং ও প্লেসিনকে ‘পানি উন্নয়ন বোর্ডের বস্তা প্রকল্প’ হিসেবে নামকরণ করেছে। এ বস্তা প্রকল্পে অনিয়ম করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কারণ কি পরিমাণ বস্তা ভাঙ্গণ রোধে ব্যবহার করা হয়েছে তা খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয় না। নদীর পাড়ের ত্রিকালজ্ঞঋষিদের অভিমত, চকরিয়া পৌর শহররক্ষা বাঁধের ১নং গাইডবাঁধ ভাঙ্গণ রোধকল্পে বর্তমানে চলমান জিও ব্যাগ ভর্তি বালুর বস্তা প্রকল্প কোনাখালী ইউনিয়নের মরংঘোনা ও কন্যারকুমের অবস্থাই হবে। সবকথার শেষ কথা ‘বালির বাঁধ কখনও স্থায়ী হয় না এছাড়া ভাতের মাড় দিয়ে কখনও দধি হয় না।’
পাঠকের মতামত: