মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন, পেকুয়া ::
কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলায় আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। পেকুয়া উপজেলার সাত ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় এখন চিহ্নিত দাগী অপরাধীরা বীপদর্পে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এছাড়াও আদালতের পরোয়ানাভূক্ত অসংখ্য আসামী
প্রকাশ্যে ঘুরলেও তাদের গ্রেফতারে পেকুয়া থানা পুলিশের কোন আগ্রহ নেই! উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে প্রতিনিয়তই কোন না কোন মারামারি-সংঘর্ষের সংগঠিত হচ্ছে। কিন্ত ভূক্তভোগীরা থানায় মামলা দায়েরের জন্য অভিযোগ দায়ের করলেও থানা পুলিশ ‘রহস্যজনক’ কারণে মামলা নেয়না। সংঘর্ষ, মারামারি, দখলবাজি, অস্ত্রবাজি ও হত্যাকান্ডের পর চিহ্নিত অপরাধীদের গ্রেফতারে পুলিশ তৎপরতা না থাকার সুযোগকে পুঁজি করে দিন দিন পেকুয়ায় ৭ ইউনিয়নে চিহ্নিত দাগী অপরাধীরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ফলে, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হচ্ছে। পেকুয়া থানার ৪ জন দারোগার সাথে বিভিন্ন এলাকার অপরাধীদের সাথে
রয়েছে বিশেষ সখ্যতা। থানার এ ৪ দারোগারা আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে রয়েছে বহু অপরাধী!
অনুসন্ধানে জানা যায়, পেকুয়ার সাত ইউনিয়নের একাধিক সন্ত্রাসী গ্রুপ রয়েছে। এসব সন্ত্রাসী গ্রুপকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় স্থানীয় এক শ্রেণীর প্রভাবশালী ও কতিপয় জনপ্রতিনিধিরা। এলাকায় আধিপাত্য বিস্তার, জমি দখল-বেদখল, চাঁদাবাজি-অস্ত্রবাজি, চুরি-ছিনতাইসহ নানান ধরনের সহিংস কর্মকান্ডে সক্রিয় রয়েছে এসব চিহ্নিত সন্ত্রাসী গ্রুপ। অন্যদিকে অতীতের তুলনায় পেকুয়ায় অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহারও আশংকাজনভাবে বেড়েছে। পেকুয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকার এসব সন্ত্রাসী গ্রুপের কাছে রয়েছে দেশী-বিদেশী নানান ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র! পেকুয়ায় আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কতটা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে তা গত এক মাসে সংগঠিত ঘটনাবলির চিত্র পর্যালোচনা করলে যে কেউ সহযেই আতকে উঠবে। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হওয়ায় উপজেলার সাত ইউনিনের জনগণ তাদের জানমাল নিয়ে নিরপত্তাহীনতায় ভূগছে। গত এক ২০ দিনের ব্যবধানে পেকুয়া উপজেলার ক্রাইমজোন হিসেবে পরিচিত মগনামা ও বারাবকিয়া ইউনিয়নে পৃথক পৃথক স্থানে ৩টি হত্যাকান্ডের ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। তবে হত্যাকান্ডের পর মামলা হলেও থানা পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় আসামীরা বহাল
তবিয়তে রয়ে যায়। মামলা হয় কিন্তু রহস্যজনক কারণে আসামী গ্রেফতার হয়না!
জানা যায়, গতকাল ২ মে (রোববার) রাত সাড়ে ৮টার দিকে পেকুয়া উপজেলার অন্যতম ক্রামইজোন হিসেবে পরিচিতি মগনামা ইউনিয়নের ফুলতলা স্টেশনে এলাকায় আধিপাত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে উপকূলীয় এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী, কয়েক ডজন মামলার আসামী আবু ছৈয়দের নেতৃত্বে তার বাহিনীর বেপরোয়া গুলিতে জয়নাল আবেদীন নামের এক ব্যবসায়ীকে নিহত হয়। নিহত ব্যবসায়ী মগনামা আফজলিয়া পাড়া গ্রামের নুরুন নবীর পুত্র। এ ঘটনায় আলী আকবর নামের আরো এক ব্যবসায়ী গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তবে এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে রাতে দুই জনকে আটক করে পুলিশে দিয়েছে স্থানীয়রা।
স্থানীয়রা জানান, মগনামায় ফুলতলা ও লঞ্চঘাট স্টেশনের আশেপাশে গ্রামহুলোতে দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাসী আবু ছৈয়দ একটি সন্ত্রাসী বাহিনী গঠন করে নানান অপরাধ কর্মকান্ড সংগঠিত করলেও পেকুয়া থানা পুলিশ কোন ধরনের আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। স্থানীয়রা আরো জানান, সন্ত্রাসী আবু ছৈয়দ বাহিনীর
সকল সদস্যদের কাছে রয়েছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। সন্ত্রাসী আবু ছৈয়দ বাহিনীকে দীর্ঘদিন ধরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা করে আসছিলেন মগনামা ইউনিয়নের বাবুল, এনাম ও রিপন নামের তিন প্রভাবশালী। এসব প্রভাবশালীর আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে থাকা অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী আবু ছৈয়দ ও তার বাহিনীর লোকজন
খুবই বেপরোয়া এবং দূর্ধর্ষ প্রকৃতির। তারা কথায় কথায় দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যে কারো উপর হামলা ও গুলি বর্ষণ করতেও পরোয়া করেনা।
জানা যায়, গত মাসের ২৯ এপ্রিল (বৃস্পতিবার) রাত ৮টার দিকে মগনামা ইউনিয়নের ফুলতলা ও লঞ্চঘাঘাট স্টেশন সন্ত্রাসী আবু ছৈয়দ বাহিনীর হামলায় নিহত জয়নাল আবেদীনের ছোট ভাই সাহাব উদ্দিন গুরুতর আহত হয়। এসময় আবু ছৈয়দ বাহিনী ফাঁকা গুলি বর্ষণ করে এলাকায় আতংক সৃষ্টি করে। ঘটনার পর পর সন্ত্রাসী আবু ছৈয়দসহ তার বাহিনীর কয়েক জনের বিরুদ্ধে পেকুয়া থানায় এজাহার দায়ের করা হয়। কিন্তু পেকুয়া থানা পুলিশ সেটি মামলা হিসেবে নেয়নি। মামলা না হওয়ায় সন্ত্রাসী আবু ছৈয়দ আরো বেপরোয়া হয়ে ৪ দিনের ব্যবধানে
মগনামা ফুলতলা ষ্টেশনে এসে আবু ছৈয়দ বাহিনী বেপরোয়া গুলি বর্ষণ করে জয়নাল আবেদীনকে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং আলী আকবরকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে।
এদিকে ২৩ এপ্রিল (শুক্রবার) দিবাগত রাত ১টার দিকে বারবাকিয়া ইউনিয়নের পূর্ব ভারুয়াখালী গ্রামে পেকুয়া উপজেলার শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তিন ডজনের বহু মামলার আসামী কথিত ‘বনের রাজা’ খ্যাত জাহাঙ্গীর আলম ওরফে বনদস্যু জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে স্থানীয় নেজাম উদ্দিন নামের এক নিরীহ কাঠ
ব্যবসায়ীকে বুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই ব্যবসায়ীকে বুকে গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করতে ধারালো কিরিচ দ্বারা ৬টি কোপ দেন জাহাঙ্গীর বাহিনী। নিহত নেজাম উদ্দিন বারবাকিয়া ইউনিয়নের পূর্ব ভারুয়াখালী গ্রামের মৃত ছবির আহমদেও পুত্র। নিহত কাঠ ব্যবসায়ীর স্ত্রী শামিনা আক্তার অভিযোগ করে বলেন, তার মামা রহিম দাদ এর বসতভিটা সন্ত্রাসী কায়দায় দখল করে নেন ডাকাত জাফর আলমের ছেলে কুখ্যাত বনদস্যু জাহাঙ্গীর ও তার অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী বাহিনী। এ ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে বেশ কয়েকবার আহত হয় তার মামা রহিমদাদের পরিবার। মামার অসময়ে ভাগনি জামাতা হিসাবে তার স্বামী বিভিন্ন সময় সাহায্য সহযোগিতা করতো। যার কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন বনদুস্য জাহাঙ্গীর ও তার বাহিনীর লোকজন। বিভিন্ন সময় বনদস্যু জাহাঙ্গীর বাহিনী তার স্বামীকে হত্যার হুমকি দিত।
সর্বশেষ গত ২৩ এপ্রিল (শুক্রবার) দিবাগত রাত ১টার দিকে তার স্বামীকে ঘর থেকে বের করেন জাহাঙ্গীর বাহিনীর সক্রিয় সদস্য জোবাইর নামে একজন। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই পূর্বথেকে উৎপেতে থাকা জাহাঙ্গীর আলম ও তার পিতা জাফর আলমসহ তার বাহিনীর সদস্য জসিম উদ্দিন, নেজাম উদ্দিন, শফিউল
আলম, গিয়াস উদ্দিন, সাহাব উদ্দিন, ওসমান, ছাবের, হেলাল, বেলাল উদ্দিন, সাহাব উদ্দিনসহ সংঘবদ্ধ আরো বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসী তাকে ঘিরে ধরে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে।
বারবাকিয়ার স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, বনের রাজা খ্যাত বনদস্যু জাহাঙ্গীর আলম ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে সদ্য সালমা হত্যা, ডাকাতি,চাঁদাবাজি, ধর্ষণসহ ৩ ডজনের অধিক অধিক মামলা রয়েছে। ওয়ার্ড আ’লীগের সভাপতির পদটি ভাগিয়ে নেয়ায় পেকুয়ার গুটি কয়েক প্রভাবশালী নেতার ছত্রছায়ায়
বারবার রক্ষা পেয়ে যান ডাকাত জাহাঙ্গীর আলম। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে পেকুয়া থানা পুলিশ জাহাঙ্গীর আলমকে গ্রেফতার করতে সাহস পায়না। কাঠ ব্যবসায়ী নেজাম উদ্দিন হত্যাকান্ডের পর তার স্ত্রী বাদী হয়ে বনদস্যু জাহাঙ্গীর আলমসহ ৮ জনকে আসামী করে পেকুয়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের
করেন। কিন্তু হত্যা মামলার দায়েরের ১০ দিন পার হয়ে গেলেও পেকুয়া থানা পুলিশ কোন আসামীকে অধ্যবধি পর্যন্ত গ্রেফতার করতে পারেনি।
এছাড়াও পেকুয়া উপজেলার বারাবকিয়া ইউনিয়নের বোধামাঝির ঘোনা গ্রামে গত মাসের ১২ এপ্রিল ভোরে সেলিনা আক্তার নামের এক গৃহবধূকে গুলি করে হত্যা করেছে এক দল চিহ্নিত সন্ত্রাসী। এ ঘটনার পর পেকুয়া থানায় ২২ জনের নাম উল্লেখ করে ১৫ জনকে অজ্ঞাত আসামী করে মোট ৩৭ জনের নামে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহতের স্বামী ফরিদুল আলম। ঘটনার পর স্থানীয়রা দুই জনকে ধৃত করে পুলিশে সোপর্দ্দ করে। কিন্তু মামলা হলেও আসামীদের গত ২১ দিনেও পেকুয়া থানা পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।
পেকয়ার আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির বিষয়ে পেকুয়া থানার ওসি (তদন্ত)কানন সরকার জানান, বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার কারনে আইন শৃঙ্খলার অবনতি বলা যাবেনা। বারবাকিয়ায় গৃহবধূ সেলিনা হত্যাকান্ডের ঘটনাটি জায়গা-জমির বিষয়ে সংগঠিত হয়েছে। আর ভারুয়াখালীর কাঠ ব্যবসায়ী নেজাম উদ্দিন হত্যা মামলাটি তিনি নিজেই তদন্ত করছেন।
কাঠ ব্যবসায়ী হত্যা মামলার কোন আসামীকে গ্রেফতার হয়েছে কিনা জানতে চাইলে কানন সরকার বলেন, পাহাড়ি এলাকা তো। তারপরেও আসামীদের গ্রেফতার করতে তিনি চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।
পাঠকের মতামত: