নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া :: মো. জাহেদুল ইসলামের মাছের বিশাল খামার আছে। তাঁর নামে ৮০ শতক পুকুরে প্রদর্শনী হিসেবে পাবদা মাছ চাষের জন্য চুন, সার, খাদ্য, পোনা ও সাইনবোর্ড কিনতে ৫০ হাজার টাকা বরাদ্ধ দেওয়া হয়। তবে জাহেদের ভাষ্য, তিনি ৫০ হাজার টাকার বরাদ্ধ থেকে ৫০ পয়সাও পাননি। তবে তাকে রাজস্বখাতের (মুজিবর্ষের) আরেকটি ২৫ হাজার টাকার প্রকল্প থেকে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় মাত্র ১৫ হাজার টাকার পাবদা মাছের পোনা সরবরাহ করে।
শুধু জাহেদুলের বরাদ্ধ নয়, ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে ইউনিয়ন পর্যায়ে মৎস্য চাষ প্রযুক্তি সেবা প্রকল্পের (দ্বিতীয় পর্যায়) আওতায় আরডি (ফলাফল প্রদর্শক) প্রদর্শনীর অধীনে আরও আটজনের টাকা এভাবে নয়-ছয় করা হয়েছে। গত ১৪ জুন পেকুয়া উপজেলা পরিষদ চত্ত্বরে আরডিদের মাঝে মৎস্য উপকরণ বিতরণ করে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজাখালী ইউনিয়নের উলদিয়া পাড়ার আবুল বশর কারাগারে আছেন ২৮ মে থেকে। তাঁর ৮০শতকের একটি পুকুরকে প্রদর্শনী খামার দেখানো হয়। তাঁর অনুকূলে বরাদ্ধ দেওয়া হয় ৪০ হাজার টাকা। এ টাকার বিনিময়ে তাকে চুন, সার, খাদ্য, পোনা ও সাইনবোর্ড কিনে দেওয়ার কথা। আবুল বশরের স্ত্রী নাছিমা বেগম বলেন, ‘একটি মারামারির মামলায় গত ২৮ মে আদালতে আত্মসমর্পন করলে আমার স্বামীকে জেলে পাঠান বিচারক। আমার স্বামীর নামে মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে কোনো বরাদ্ধ আমি পাইনি। হয়তো তাঁর নামে বরাদ্ধ দেখিয়ে টাকা আত্মসাত করা হয়েছে।’ রাজাখালীর মৌলভীপাড়ার বদরুল আলমকে বরাদ্ধ দেওয়া হয় ৩৫ হাজার টাকা। তাকে সাড়ে ১১ হাজার টাকা মূল্যের ১০ বস্তা খাদ্য, পোনা কিনতে ১১হাজার টাকা ও ৫শ টাকা দামের একটি সাইনবোর্ড দেওয়া হয়। সবমিলিয়ে তাঁর জন্য ২৩ হাজার টাকা খরচ করা হয়। বদরুল বলেন, আমার কার্প মিশ্র চাষ প্রদর্শনী খামারের জন্য কত টাকা বরাদ্ধ হয়েছে জানি না।
তবে আমি ২৩ হাজার টাকা মূল্যের উপকরণ পেয়েছি। পেকুয়া সদরের সিরাদিয়া গ্রামের বাদশা মিয়ার ৮০ শতক জমিকে বাগদা চিংড়ির চাষের জন্য প্রদর্শনী খামার দেখানো হয়। তাঁর প্রদর্শনী খামারের উপকরণের জন্য ৪০ হাজার টাকা বরাদ্ধ দেওয়া হয়। বাদশা মিয়া বলেন, তাকে পাঁচ বস্তা খাদ্য (প্রতি বস্তা ৬০০ টাকা) ও একটি সাইনবোর্ড সরবরাহ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে তাকে সাড়ে তিন হাজার টাকার উপকরণ দেওয়া হয়। এভাবে পেকুয়া সদরের নন্দীরপাড়ার আবু ছালেককে ৫০ হাজার টাকা, বকসু চৌকিদারপাড়ার আরমানুল ওসমান চৌধুরীকে ৫০ হাজার টাকা, সুতাবেপারী পাড়ার তৌহিদুল ইসলামকে ৫০ হাজার টাকা ও বারবাকিয়া ইউনিয়নের নাজিরপাড়ার মোস্তফা কামালের নামে ৫০ হাজার টাকা উপকরণ কিনতে বরাদ্ধ দেওয়া হয়। এসব বরাদ্ধ থেকে তাঁদের প্রত্যেককে ১৫-২৫ হাজার টাকার উপকরণ দিয়ে অন্য টাকা আত্মসাত করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে পেকুয়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. আনোয়ারুল আমিন তাঁর বিরুদ্ধে উঠা আরডি প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের সবগুলো অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, জাহেদুলের জন্য পোনা আনা হচ্ছে। বশরের আরেকজন অংশীদার আছে তাকে উপকরণ দেওয়া হয়েছে। তবে সব প্রকল্প এখনও বাস্তবায়নাধীন। আমাকে সময় দিতে হবে। আমি বাস্তবায়ন করবো।
প্রশিক্ষণের নামে টাকা আত্মসাত
প্রতিজন আরডি’র বিপরীতে পাঁচজন করে এফএফ (ফলো ফার্মার) রয়েছে। তাঁদের কাজ আরডি প্রদর্শনীগুলো নিয়মিত তদারকি ও পরিদর্শন করে পরবর্তীতে মাছ চাষে তাঁরা উৎসাহিত হবেন। এ জন্য উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় দুই দফায় চার দিনের প্রশিক্ষণ দিবেন।
প্রথম দফায় ৯জন আরডি ও তাঁর ৪৫ জন এফএফ এর প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়। এই প্রশিক্ষণে দুইজন আরডি ও তাঁদের এফএফকে বাদ দেওয়া হয়। অন্য সাতজন আরডি ও তাঁদের এফএফসহ ৪২জন নিয়ে…প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিজনের দুই দিনের ভাতা ৬শ টাকা। কিন্তু প্রশিক্ষণ শেষে তাঁদের দেওয়া হয় ৫শ টাকা করে। প্রথম দফার এই প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষনার্থীদের কাছ থেকে চার হাজার ২শ টাকা ও প্রশিক্ষণে সংযুক্ত না করা আরডিসহ ১২জনের সাত হাজার ২শ টাকা আত্মসাত করা হয়েছে।
দ্বিতীয় দফায় আরেকটি দুই দিনের প্রশিক্ষণ হওয়ার কথা থাকলেও তা আয়োজন করা হয়নি। এ প্রশিক্ষণে ৫৪ জনের ৬শ টাকা করে মোট ৩২ হাজার ৪শ টাকা আত্মসাত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রশিক্ষণ আয়োজনের সমন্বয়ক উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের ক্ষেত্র সহকারী কাউছার আহমেদ বলেন, দ্বিতীয় দফার প্রশিক্ষণের জন্য মৎস্য কর্মকর্তাকে বারবার তাগাদা দেওয়া হলেও তিনি তা করেননি। তবে এই টাকা জুনের আগে উত্তোলন করা হয়েছে।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আনোয়ারুল আমিন বলেন, একটি প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে। আরেকটি প্রশিক্ষণ এখনও করা হয়নি। প্রথম দফার প্রশিক্ষণেও টাকা আত্মসাত করা হয়েছে-এমন প্রশ্ন তিনি কৌশলে এড়িয়ে যান।
আরও অভিযোগ
সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যা- মেরিন ফিশারীজ প্রজেক্টের আওতায় উপকূলীয় ও সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ক একটি প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়। গত ৫ ও ৬ মে দুই দিনব্যাপী প্রশিক্ষণটির আয়োজন করা হয় রাজাখালী ইউনিয়নের সুন্দরীপাড়া এলাকায় জামাল মেহের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এতে প্রশিক্ষণনার্থীর সংখ্যা ২৫জন। দুই দিনের প্রশিক্ষণে তাঁদের জন্য বরাদ্ধ ১৪শ টাকা করে। কিন্তু প্রত্যেক প্রশিক্ষনার্থীদের দেওয়া হয় ১২শ টাকা করে। এছাড়া প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য দুপুরের দুই বেলা খাবার ও দুই বেলা নাস্তার অন্তত ২০ হাজার টাকার পুরোটাই আত্মসাত করা হয়েছে। কোনো প্রশিক্ষণার্থীকে খাবার ও নাস্তা সরবরাহ করা হয়নি। প্রশিক্ষনার্থী মো. ফোরকান বলেন, দুই দিনের প্রশিক্ষণে আমাদের ১২শ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। তবে নাস্তা বা খাবার দেওয়া হয়নি।
জানতে চাইলে আনোয়ারুল আমিন বলেন, সবাইকে ভাতার টাকা দেওয়া হয়েছে। ওই সময় রমজান থাকায় খাবার বা নাস্তা দেওয়া হয়নি। খাবার বা নাস্তার টাকা কোথায় আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সব তো অফিস সহকারীদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অফিস সহকারীদের কাছ থেকে জিজ্ঞেস করতে হবে। বিষয়টি আমার জানা নেই। তিনি এরপরের আরও দুটি প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়েছে জানিয়ে বলেন, সেসব সম্পর্কে খোঁজ নেন। সেখানে সবাই সব টাকা পেয়েছে কিনা জানুন।
কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস এম খালেকুজ্জামান বলেন, প্রকল্পে কোনো অনিয়ম হলে ছাড় দেওয়া হবে না। উত্থাপিত অভিযোগগুলো সম্পর্কে খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে।
পাঠকের মতামত: