অনলাইন ডেস্ক ::
নিরাপত্তা পরিষদের ১৫টি সদস্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দীর্ঘমেয়াদে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হলেও বিপন্ন ওই জনগোষ্ঠীর মানুষদের রাখাইন রাজ্যে ফেরার অধিকার সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব নাকচ করে দেয় চীন। এশিয়াভিত্তিক সংবাদমাধ্যম চ্যানেল নিউজ এশিয়া জানিয়েছে, নিরাপত্তা পরিষদের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিসর ওই প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিল। বৈঠকে চীনসহ ১৫ রাষ্ট্র সর্বসম্মতিক্রমে নিরাপত্তা বাহিনীর মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগ তোলে। তবে ক্যালিফোর্নিয়া ও ওয়াশিংটনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ওয়ান আমেরিকা নিউজ নেটওয়ার্ক মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল নিউ লাইটকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, চলমান অভিযানকে জঙ্গিবিরোধী আখ্যা দিয়ে মিয়ানমারকে আবারও স্বাগত জানিয়েছে চীন।
মিয়ানমারে নিরাপত্তা বাহিনীর চলমান রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকেই মিলতে থাকে বেসামরিক নিধনযজ্ঞের আলামত। পাহাড় বেয়ে ভেসে আসতে শুরু করে বিস্ফোরণ আর গুলির শব্দ। পুড়িয়ে দেওয়া গ্রামগুলো থেকে আগুনের ধোঁয়া এসে মিশতে থাকে মৌসুমী বাতাসে। মায়ের কোল থেকে শিশুকে কেড়ে শূন্যে ছুড়তে থাকে সেনারা। কখনও কখনও কেটে ফেলা হয় তাদের গলা। জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় মানুষকে। আহত শরণার্থী হয়ে তারা ছুটতে থাকে বাংলাদেশ সীমান্তে। জাতিসংঘের হিসাবে, এবারের রোহিঙ্গাবিরোধী সহিংসতায় গত ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা। বুধবার নিরাপত্তা পরিষদের এক বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে প্রথমবারের মতো একমত
হয় এর ১৫টি সদস্য রাষ্ট্র। কূটনীতিকদের বরাত দিয়ে চ্যানেল নিউজ এশিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার অধিকার রক্ষায় মিসরের পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাব আনা হয়। তবে মিসরীয় প্রস্তাবটি চীন নাকচ করে দেয়। এরপর ১৫টি সদস্য রাষ্ট্রই সহিংসতা বন্ধে একমত পোষণ করে
মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠতা দীর্ঘদিনের। দুই দেশেই অধিকাংশ মানুষ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। মিয়ানমারের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার চীন। জাতিসংঘের কূটনীতিকদের অভিযোগ, এর আগেও রোহিঙ্গা–সংকটকে জাতিসংঘের শীর্ষ কাউন্সিলে উত্থাপনে বিরোধিতা করে বেইজিং। নিউজ এশিয়া জানিয়েছে, মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ মিত্র চীন রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরার অধিকার সংক্রান্ত এক মিসরীয় প্রস্তাবে আপত্তি জানালেও পরে নিরাপত্তা পরিষদের পক্ষ থেকে রাখাইনের সামরিক অভিযানে ‘মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ’র অভিযোগ তোলা হয়। সেখানকার চলমান সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে ত্রাণকর্মীদের অবাধ প্রবেশাধিকার নিশ্চিতের তাগিদ দেওয়া হয়। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, বিগত ৯ বছরে কোনও ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদের এমন ঐকমত্য এবারই প্রথম। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ একে ‘বিরল ঐকমত্য’ আখ্যা দিয়েছে।
রোহিঙ্গা
মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল নিউ লাইট গতকাল বৃহস্পতিবার দাবি করে, ‘রাখাইনের জঙ্গি হামলা নিয়ে চীনের অবস্থান খুব পরিস্কার। তারা এটাকে ¯্রফে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা আকারেই দেখছে।’ চীনের রাষ্ট্রদূত হং লিয়াংকে উদ্ধৃত করে এসব কথা জানায় গ্লোবাল নিউ লাই। হং লিয়াং তাদেরকে বলেছেন, ‘উগ্রপন্থী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাল্টা হামলা এবং দেশের জনগণের জন্য দেওয়া সরকারের সহায়তা কার্যক্রমকে স্বাগত জানায় চীন।’
রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকের আগে এক নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জেং শুয়াং বলেন, রাখাইন রাজ্যে সংঘটিত সহিংসতার নিন্দা জানাচ্ছে চীন। তবে সেখানে ‘শান্তি ও স্থিতিশীলতা’ বজায় রাখতে মিয়ানমার সরকার যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তার প্রতি আমাদের সমর্থন রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও একে সমর্থন জানানো উচিত। আশা করি, সেখানে যত দ্রুত সম্ভব স্বাভাবিক জীবনযাপন ফিরিয়ে আনা হবে।
রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইনে চীনের বিশাল বিনিয়োগ আছে। ২০০৪ সালে রাখাইনে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি সম্পদের সন্ধান পাওয়ার পর সেখানে চীনের দৃষ্টি পড়ে। ২০১৩ সাল নাগাদ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য পাইপলাইন নির্মাণের কাজ শেষ করে দেশটি। এ পাইপলাইন মিয়ানমারের বন্দর শহর কিয়াউকফিউকে চীনের ইউনান প্রদেশের শহর কুনমিংকে যুক্ত করেছে। তেলের এ পাইপলাইনটির মাধ্যমে বেইজিং মালাক্কা প্রণালি হয়ে মিডল ইস্টার্ন ও আফ্রিকান তেল সরবরাহের সুযোগ পায় বেইজিং। আর গ্যাস পাইপলাইনটি ব্যবহার করা হয়, মিয়ানমারের উপকূলীয় ক্ষেত্র থেকে চীনে হাইড্রোকার্বন সরবরাহের জন্য। স্পুটনিকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে রুশ বিশ্লেষকদের উদ্ধৃত করে বলা হয়, মিয়ানমারের অস্থিতিশীলতা চীনের জ্বালানি প্রকল্পগুলোতে প্রভাব ফেলতে পারে এবং বেইজিংয়ের দ্বারপ্রান্তেও অস্থিতিশীলতার বীজ বপন করতে পারে।
পাঠকের মতামত: