ঢাকা,বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪

নজরদারির অভাবে অনিয়মের আখড়া প্রাইভেট হাসপাতাল!

তৌফিক মারুফ : 
চট্টগ্রামের বেসরকারি ম্যাক্স হাসপাতালে শিশু রাইফার মৃত্যুর পর সরকারি একাধিক কমিটির তদন্তে কর্তব্যরত চিকিৎসকের অবহেলার পাশাপাশি বেরিয়ে এসেছে ওই হাসপাতালের নানা অনিয়মের তথ্য। সর্বশেষ র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত ম্যাক্স হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে নানা অনিয়ম পেয়ে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে। এর আগেও দেশের কয়েকটি হাসপাতালে চিকিৎসায় অবহেলাজনিত মৃত্যুর ঘটনায় তোলপাড় হলে কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের বিভিন্ন অনিয়ম খুঁজে পায় তদন্তে। কিন্তু কোনো অঘটন না ঘটলে বেসরকারি হাসপাতালের অনিয়ম নিয়ে কেউ কথাও বলে না। স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মতে, সরকারের নিয়মিত যথাযথ নজরদারি না থাকায় দেশের অনেক বেসরকারি হাসপাতাল অনিয়মের আখড়ায় পরিণত হয়েছে।

অন্যদিকে মাঝেমধ্যে কোথাও কোনো চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী রোগী বা স্বজনদের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হলে কিংবা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে গেলে ধর্মঘটসহ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা অচল করে দেওয়া হয়।

রাজধানীর ধানমণ্ডি এলাকার ব্যবসায়ী রায়হানুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, বছর দুই আগে লালমাটিয়ার একটি শিশু হাসপাতালে তাঁর এক ভাইয়ের নবজাতক শিশুর মৃত্যু ঘটে চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলায়। তখন তাঁরা বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানালেও কোনো সুরাহা হয়নি। এর কিছুদিন পরই একই হাসপাতালে এক রাতে তিন শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় তোলপাড় হওয়ার পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হাসপাতালটি বন্ধ করে দেয় এবং হাসপাতালে নানা ধরনের অনিয়ম ছিল বলে তদন্তে বেরিয়ে আসে। শেষ পর্যন্ত ওই হাসপাতাল বন্ধই হয়ে যায়। রায়হানুল ইসলাম আরো বলেন, ‘আমার প্রশ্ন হচ্ছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কেন ওই শিশুদের মৃত্যুর আগে হাসপাতালটির অনিয়ম ধরতে পারেনি কিংবা বছরের পর বছর কিভাবে সেটি চলে আসছিল?’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর হোসেনেরও প্রশ্ন, ‘চট্টগ্রামের ম্যাক্স হাসপাতালটি ২০১২ সালের পর থেকে আর কোনো নবায়ন না করেও কিভাবে চালু আছে?’ তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মাঠপর্যায়ে মনিটরিং ব্যবস্থা সঠিকভাবে কার্যকর না থাকায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানে এমন পরিস্থিতি টিকে থাকে। আবার নানা মহলের প্রভাবে অনেক সময় সঠিক ব্যবস্থাও নেওয়া যায় না। এর পরিণতি ভোগ করতে হয় সাধারণ মানুষকে।’

জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা একাধিক বিশেষজ্ঞ বলেন, মূলত চিকিৎসকদের সংগঠন ও স্থানীয় পর্যায়ের প্রভাবশালী নেতাদের দাপটে অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি কর্তৃপক্ষ কোনো হাসপাতালের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে না। কারণ বেশির ভাগ হাসপাতালের মালিকানাসহ নানা বিষয়ে কোনো না কোনো সংগঠনে যুক্ত চিকিৎসকরা জড়িত থাকেন। আবার সংগঠন ছাড়াও অনেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিকিৎসক নেতাদের সঙ্গে সখ্য বজায় রাখে নানা প্রক্রিয়ায়। এ ছাড়া মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকা স্বাস্থ্য বিভাগীয় পরিচালক, সিভিল সার্জন কিংবা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তারাও নানা অজুহাতে মনিটরিং করেন না। কিছু ক্ষেত্রে মনিটরিংয়ে অনিয়ম পেলেও তা কেন্দ্রে না জানিয়ে চেপে রাখা হয়।

বিএমএর সাবেক মহাপরিচালক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি অধ্যাপক ডা. সারফুদ্দিন আহম্মেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার থাকলে কোনো প্রতিষ্ঠানেই অনিয়ম চলতে পারে না। কিন্তু নিবন্ধন থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শৈথিল্য রয়েছে। এগুলো কাটাতে না পারলে এমন পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাওয়া মুশকিল। তিনি বলেন, চিকিৎসকদের মধ্যে কেউ দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে তারও শাস্তির ব্যবস্থা থাকা উচিত, কিন্তু আবার কথায় কথায় চিকিৎসকের ভুলে রোগীর মৃত্যু হওয়ার মতো অভিযোগ তুলে চিকিৎসকদের হয়রানি করাও ঠিক নয়। তাতে চিকিৎসকরা নিরাপত্তাহীন বোধ করেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) জাহাঙ্গির হোসেন বলেন, ‘আমি মাত্র এক বছর পাঁচ মাস ধরে এই পদে আছি। কিন্তু সারা দেশে শত শত পুরনো বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার নানা ধরনের অনিয়মের মাধ্যমে বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। আগে কেন এসব ধরা পড়েনি সেই প্রশ্ন আমার নিজেরও।’ তিনি অবশ্য দাবি করেন, এখন নিবন্ধন দেওয়া হয় খুব কঠিন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। মনিটরিংও বাড়ানো হয়েছে। তবে সমস্যা হচ্ছে নিচের দিকে। মনিটরিংয়ের দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরা অনেকেই ঠিকভাবে সেই কাজ করছেন না নানা অজুহাতে।

ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘দেশের সব বিভাগ, জেলা, উপজেলা পর্যায়ে কমিটি রয়েছে। ওই সব কমিটির প্রতি প্রত্যেকটি হাসপাতাল পরিদর্শন করে প্রতিবেদন পাঠানোর নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, হাতে গোনা দু-চারটি ছাড়া কোথাও থেকে প্রতিবেদন আমার হাতে আসছে না। স্থানীয় কর্মকর্তারা কেন নিজ নিজ এলাকার অনিয়ম ধরতে পারেন না তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না।’

গত ফেব্রুয়ারিতে গাজীপুরের শ্রীপুরে তানিয়া হাসপাতালে, গত বছরের নভেম্বরে লক্ষ্মীপুরের এসএমকে হাসপাতালে, রংপুরের একটি পলি ক্লিনিকসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় চিকিৎসকের বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অবহেলায় রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে স্বজনদের পক্ষ থেকে। কখনো কখনো মৃত্যু না হলেও রোগীর ক্ষতি হয়ে যাওয়ার পর কিংবা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের পর টনক নড়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। টাকা নিয়েও চিকিৎসা না দেওয়ার অভিযোগে গত ২৮ মার্চ রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ক্রিসেন্ট হাসপাতালে অভিযান চালায় র‌্যাব। র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সরোয়ার আলমের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত নানা অনিয়ম ও অপরাধের প্রমাণ পাওয়ায় হাসপাতালটির দুই ভুয়া ডাক্তার হাসান ও আনোয়ারকে দুই বছর করে কারাদণ্ড, ম্যানেজার সোহাগকে এক বছরের কারাদণ্ড, টেকনোলজিস্ট পঙ্কজ ও লিটন, দালাল ইউসুফ ও ইসমাইলকে ছয় মাস করে কারাদণ্ড দেন।

গত ২ জুলাই ধানমণ্ডি ২ নম্বর সড়কের পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে ২৫ লাখ টাকা জরিমানা করেন র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। আগের মেয়াদোত্তীর্ণ রি-এজেন্ট ব্যবহার এবং ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণা করায় ওই জরিমানা করা হয়।

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নির্দেশ : চট্টগ্রামের ম্যাক্স হাসপাতালে শিশু রাইফার মৃত্যুর ঘটনায় অভিযুক্ত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলকে (বিএমডিসি) নির্দেশ দিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। দুটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন নিয়ে মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় গতকাল রবিবার মন্ত্রী ওই নির্দেশ দেন। অভিযুক্ত চিকিৎসকরা হলেন ডা. বিধান রায় চৌধুরী, ডা. দেবাশীষ সেনগুপ্ত ও ডা. শুভ্র দেব।

সভায় মন্ত্রী বলেন, ভুল চিকিৎসা বা চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ নিয়ে যেকোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে অভিযোগের জন্য হটলাইন নম্বরসংবলিত সাইনবোর্ড সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে স্থাপন করতে হবে।

পাঠকের মতামত: