অনলাইন ডেস্ক :: আগামী জুন মাসে কক্সবাজারে ট্রেন চলাচল শুরু হতে পারে। এরই মধ্যে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেলপথের ৬৫ কিলোমিটারে রেললাইন বসে গেছে। জুনের মধ্যে বাকি কাজ শেষ করতে চান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সব ঠিক থাকলে জুনের শেষ নাগাদ ঢাকা থেকে ট্রেনে কক্সবাজার যাওয়া যাবে।
বর্তমানে ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম পর্যন্ত রেলপথের দূরুত্ব ৩২০ কিলোমিটার। চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত রেলপথের দৈর্ঘ্য ৪০ কিলোমিটার। এর সঙ্গে কক্সবাজার যোগ হলে ঢাকা থেকে পুরো পথের মোট দূরত্ব দাঁড়াবে ৪৬০ কিলোমিটার।
দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়াল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পটি দুই অংশে বিভক্ত। এতে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০.৮৩ কিলোমিটার রেলপথ প্রথম ধাপে নির্মাণ করা হচ্ছে। পরের ধাপে কক্সবাজার থেকে মিয়ানমার সীমান্তের ঘুমধুম পর্যন্ত ২৮.৭৫ কিলোমিটার নির্মাণ করা হবে।
রেললাইনটি নির্মিত হলে ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হবে। পর্যটন শহর কক্সবাজার যুক্ত হবে দেশের রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে। পর্যটকদের জন্য নিরাপদ আরামদায়ক, সাশ্রয়ী পরিবেশবান্ধব যোগাযোগব্যবস্থার প্রবর্তন হবে। সহজে ও কম খরচে মাছ, লবণ, রাবারের কাঁচামাল এবং বনজ ও কৃষিজ দ্রব্যাদি পরিবহন করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে মহাপরিচালক মো. কামরুল আহসান বলেন, ‘জুনে ট্রেন চালানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তখন দু-একটি স্টেশনের নির্মাণকাজ পুরোপুরি শেষ হতে বাকি থাকতে পারে। তবু আমরা রেল চলাচল শুরু করে দেবে। মানুষের যাতায়াত এবং দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব রাখা—দুই দিক থেকেই রেলপথটি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের পরিকল্পনায় রয়েছে, এই পথের ট্রেনগুলো যেন রাতে চালানো যায়। তাহলে যাত্রীরা স্বল্প খরচে আরামে পর্যটন এলাকা ভ্রমণ করতে পারবেন।
প্রকল্পে যা থাকছে : জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) রেললাইনের নির্মাণ প্রকল্পের মূল অনুমোদন পায় ২০১০ সালের ৬ জুলাই। ২০১৭ সালে প্রকল্প নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করে। ফার্স্ট ট্র্যাক এই প্রকল্পের কাজ চলতি বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা। তবে প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত।
প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০.৮৩১ কিলোমিটার মেইন লাইন, লুপ ও সাইডিং ৩৯.২০৫ কিলোমিটার নতুন সিঙ্গেল লাইন ডুয়াল গেজ ট্র্যাক নির্মাণকাজ চলছে। এতে ৩৯টি মেজর ব্রিজ, ২২৩টি মাইনর ব্রিজের মধ্যে ৬৪টির কাজ চলমান আছে, আর ৮২টির কাজ শেষ হয়েছে। ৯৬টি লেভেলক্রসিং, হাতি চলাচলের জন্য আন্ডার ও ওভারপাস নির্মাণের কাজ চলছে।
তবে রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৮.৩১৮ কিলোমিটার রেললাইনের কাজ এখনো শুরু হয়নি। প্রকল্পের এই অংশেও রেললাইনের সঙ্গে নির্মাণ করতে হবে ১৩টি মেজর ব্রিজ, ৪৫টি মাইনর ব্রিজ ও ২২টি লেভেলক্রসিং। এ ছাড়া হাতি চলাচলের জন্য নির্মাণ করা হবে আন্ডার ও ওভারপাস, সঙ্গে থাকছে দুটি নতুন রেলস্টেশন।
৭৮ শতাংশ কাজ শেষ : প্রকল্পের অগ্রগতির প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৭৮ শতাংশ। প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এর মধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ঋণ দিচ্ছে ১৩ হাজার ১১৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা। বাকি চার হাজার ৯১৯ কোটি সাত লাখ টাকা দিচ্ছে সরকার। প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি প্রায় ৪০ শতাংশ।
চীনের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি) ও চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিসিইসিসি) প্রকল্পের কাজ করছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন কম্পানি ও ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড এ প্রকল্পের কাজের সঙ্গে যুক্ত।
প্রকল্পের আওতায় ৯টি নতুন রেলস্টেশন ও এর অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। দুটি স্টেশনের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। দোহাজারী, হারবাং, চকরিয়া, ডুলাহাজারা, ইসলামাবাদ ও কক্সবাজারে আইকনিক রেলস্টেশনের নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। কক্সবাজার বাস টার্মিনালের কাছে দৃষ্টিনন্দন ঝিনুক আকৃতির আইকনিক স্টেশনটিতে থাকছে আন্তর্জাতিক মানের সব সুযোগ-সুবিধা।
প্রকল্প পরিচালক মো. মফিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা কঠিন সময় মোকাবেলা করে এসেছি। করোনা ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব কাজে পড়েছে। এখন কাজের গতি ভালো। আশা করছি জুনের মধ্যে প্রকল্পের নির্মাণকাজ শেষ করতে পারব। ট্রেন কবে চালানো হবে, সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সরকার নেবে।
নির্মাণে আসতে দেরি হয় : প্রকল্প অনুমোদনের আট বছর পর ২০১৮ সালের মার্চে নির্মাণকাজ শুরু হয়। প্রকল্পের শুরু থেকেই ছিল ভূমি অধিগ্রহণের জটিলতা। কাজের ধীরগতির অন্যতম কারণ অধিগ্রহণ করা জমির জটিলতা নিরসন করতে না পারা। প্রকল্প এলাকায় সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার জমি হস্তান্তরে দেরি হওয়া। ব্যক্তি পর্যায়ে যেসব জমি অধিগ্রহণ করা হয়, তাদের অনেককেই পুনর্বাসন করতে না পারায় জমির দখল বুঝে পেতে দেরি হয় রেল কর্তৃপক্ষের।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, অধিগ্রহণ করা মোট জমির মধ্যে চট্টগ্রামের চন্দনাইশে ৮ শতাংশ, সাতকানিয়ায় ১৩ শতাংশ, লোহাগাড়ায় ১২ শতাংশ, কক্সবাজার সদরে ২২ শতাংশ, রামুতে ২৩ শতাংশ ও চকরিয়ায় ৩৩ শতাংশ অধিগ্রহণ করা জমির মীমাংসায় জটিলতা তৈরি হয়।
অর্থনীতির গতি বাড়বে : দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন চালু হলে গতি বাড়বে দেশের অর্থনীতির চাকার। সেই সঙ্গে তুলনামূলক চাপ কমবে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের ওপর। কক্সবাজারের পর্যটনশিল্পের আমূল পরিবর্তন ঘটবে। কারণ তখন সহজেই কক্সবাজারে পর্যটকের আগমন বাড়বে। নিয়মিত চাঙা থাকবে পর্যটন ব্যবসা। নতুন করে বাড়বে স্থানীয় কর্মসংস্থান।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামছুল হক বলেন, উন্নত যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সব সময় ব্যবসার প্রসারে ভূমিকা রাখে। ফলে এ জাতীয় বড় প্রকল্প অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখবে। বাণিজ্যে গতি বাড়াবে। পরিবহনের বিকল্প পথ তৈরি হবে।
রেলওয়ে মহাপরিচালক মো. কামরুল আহসান বলেন, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ হয়ে গেলে কক্সবাজার রেললাইনকে মাতারবাড়ীর সঙ্গে যুক্ত করা হবে। তখন বন্দরের মালপত্র এই পথে পরিবহন করা যাবে। খরচ বাঁচবে এবং পরিবহন নিরাপদ হবে।
পাঠকের মতামত: