উখিয়া প্রতিনিধি ::
নির্যাতনের ক্ষত এখনো শুকোয়নি রোহিঙ্গাদের শরীর ও মন থেকে। এরই মধ্যে ভাল বেতন, নিরাপত্তা, আরাম আয়েশী জীবন যাপন, সর্বোপরি বাংলাদেশি ভাল পরিবারের ছেলের সাথে বিয়ের প্রলোভন দিয়ে অনৈতিক, অসামাজিক কাজে নামানো হচ্ছে শত শত রোহিঙ্গা মেয়েদের। এর পিছনে কাজ করছে স্থানীয় সংঘবদ্ধ দালালচক্র। এদের অর্থের বিনিময়ে সার্বিক সহায়তা করছে রোহিঙ্গা মাঝি নামক দালালরা। অন্যদিকে এক শ্রেণীর লোক ধর্মীয় বেশ ভুষা পরিধান করে ত্রাণ সহায়তার নামে ক্যাম্পে বেআইনিভাবে অবস্থান করে রোহিঙ্গা কিশোরী ও তরুণীদের বিয়ের ফাঁদে ফেলছে বলে অভিযোগ। এ ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থানীয় অভিভাবকগণও আতংকিত। কারণ আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মাঝে মরণ ব্যাধি এইডস রোগীর সংখ্যা বাড়ায় স্বাস্থ্য ঝুঁকির আশংকা করা হচ্ছে।
উখিয়ার একাধিক অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরে অনুসন্ধানকালে অনৈতিক কর্মকাণ্ড ও অবৈধ মেলামেশার ব্যাপারে স্পর্শকাতর নানা তথ্য পাওয়া গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উখিয়ার তাজনিমার খোলা খেলা মাঠ সংলগ্ন রোহিঙ্গা বস্তির এক মাঝ বয়সী মহিলা জানান, ‘তার স্বামী ৫/৬ বছর ধরে মালয়েশিয়া প্রবাসী। মংডুতে দোতলা কাঠের বাড়ি, জমি–জমা, সহায় সম্পদ সবই ছিল। মিয়ানমার সেনাবাহিনী সেগুলো পুড়ে দেওয়ায় ১৬ ও ১৭ বছরের ২ মেয়ে এবং ১১ বছরের এক ছেলেকে নিয়ে দুই মাস পূর্বে এখানে পালিয়ে এসেছি। নিজে হাঁপানিসহ নানা রোগে অসুস্থ। তাই ত্রানসামগ্রী সংগ্রহসহ বিভিন্ন কাজে জোয়ান মেয়েদের পাঠাতে হয়। পার্শ্ববর্তী শেডের ব্লক মাঝি এক দিন এসে মেয়ে দুটোকে চট্টগ্রামে বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। প্রবাসী স্বামীর সাথে যোগাযোগও নেই। এরই মধ্যে প্রতিবেশী জনৈক ব্যক্তির মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ হয় স্বামীর সাথে। স্বামীকে জানানোর পর মেয়েদের অচেনা লোকের সাথে বিয়ে দিতে নিষেধ করেন। কিন্তু মাঝি বা রোহিঙ্গা সর্দারসহ আরো কয়েকজন লোক যে অবস্থা শুরু করেছে তাতে কি করবো ভেবে পাচ্ছি না। তা ছাড়া রোহিঙ্গা জোয়ান ছেলেরা মেয়ে দুটোকে নানাভাবে বিরক্ত করে আসছে।
কুতুপালং আশ্রয় শিবিরের উখিয়া টিভি রিলে কেন্দ্রের আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা ছব্বির আহমদ (ছদ্ম নাম) জানান, এখানে মেয়েদের নিয়ে অনেক বিপদ। দেশে সেনাবাহিনী ও স্থানীয় মগদের অত্যচার থেকে বেঁচে আসলেও পূর্ব থেকে অবস্থান করা রোহিঙ্গাদের কবল থেকে মেয়েদের রক্ষা করা যাচ্ছে না। আশ্রয় শিবিরে রোহিঙ্গারা স্থানীয় উঠতি বয়সের ছেলেদের নিয়ে বস্তির অলিগলিতে এমনকি অনেক সময় বিভিন্ন ঘরে উঁকি মারে। বিশেষ করে যাদের ঘরে কিশোরী ও যুবতী মেয়ে রয়েছে। তিনি জানান, রোহিঙ্গা মাঝিরা প্রলোভন হুমকি ত্রান না দেয়াসহ নানা চাপে রেখে রোহিঙ্গা মেয়েদের দালালদের কাছে তুলে দিতে বাধ্য করছে। তিনি জানান, পার্শ্ববর্তী ব্লক থেকে ইতিমধ্যে ৬টি মেয়ে উধাও হয়ে গেছে। এসব মেয়েরা নাকি কক্সবাজার শহরে গিয়ে কোথাও থাকে, ভাল বেতনও পায়। বিপদে পড়ে আসা রোহিঙ্গাদের দেখতে, খোঁজ খবর নিতে অনেক ধরনের লোক আসছে। বাংলাদেশীদের পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত পুরনো রোহিঙ্গারাও নানা উছিলায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আসছে। সব চেয়ে বেশি ক্ষতিকর কাজ করছে রোহিঙ্গা মাঝিরা। যারা মিয়ানমারে সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর সাথে দালালি করে সাধারন রোহিঙ্গাদের নানা ভাবে হয়রানি করে আসছিল। এখানে এসেও তারা একই কাজে লিপ্ত হয়েছে।
রাখাইনে থাকতে রোহিঙ্গারা কখনো বাংলাদেশের এ আধুনিক পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে পরিচিত ছিল না। তাই লোভে পড়ে রোহিঙ্গারা এ সমস্ত অন্যায় কাজের পিছনে ঝুঁকে পড়ছে বলে অনেক রোহিঙ্গা অভিযোগ করেন। এরকম পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা অভিভাবকগণ এ ধরনের অনৈতিক, অসামাজিক কার্যকলাপে অনেকটা চিন্তিত। আরেক শ্রেণির রোহিঙ্গা দালালদের কথা বিশ্বাস করে তাদের কিশোরী ও যুবতী কন্যাদের চাকরি বা বিয়ের জন্য তুলে দিয়ে স্বস্তি বোধ করছে।
সরকারি বিধি নিষেধ উপেক্ষা করে আশ্রয় শিবিরগুলোতে রাত্রিযাপন ও রোহিঙ্গা কিশোরী নিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে যাওয়ার কালে ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি নাগরিক আইন–শৃংখলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আটক হয়েছে।
স্বাস্থ্য সচেতন স্থানীয় লোকজনের মতে পর্যটন শহর কক্সবাজার ও পার্শ্ববর্তী বাণিজ্যিক শহর চট্টগ্রাম। এখানে কোন না কোন কাজের সংস্থান হয়ে থাকে। কুতুপালং ও আশপাশের রোহিঙ্গা শিবিরগুলো থেকে রোহিঙ্গা কিশোরী, শিশু, যুবতী, বিবাহিত, স্বামী হারা অনেকে নানা ফাঁদে পড়ে পাচার হয়ে বাধ্য হচ্ছে যৌনাচারে লিপ্ত হতে। কক্সবাজার শহর, টেকনাফের শামলাপুর থেকে ইনানী হয়ে কক্সবাজার সমুদ্র বীচে খোলা বালিয়াড়ি সংলগ্ন ঝাউবনে সন্ধ্যার পর থেকে বিচ্ছিন্নভাবে রোহিঙ্গা মেয়েদের নিয়ে দালালদের অনৈতিক দেহ ব্যবসা চালানোর অভিযোগ সচেতন মহলের। উখিয়া পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, যত্রতত্র রোহিঙ্গারা আশ্রয় নেওয়ায় স্থানীয় কিশোর–যুবক ও বিবাহিত অনেকের রোহিঙ্গা শিবিরে অনৈতিক যাতায়াত বাড়ার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। স্থানীয় এসব ছেলেদের কেউ একা আবার অনেকে সংঘবদ্ধ ভাবে রোহিঙ্গা শিবির গুলোতে গমনাগমনে স্থানীয় অভিভাবকদের পাশাপাশি অনেক সংসারে নানা পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।
কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে সংঘবদ্ধ দালালচক্র ঢাকা সহ বড় বড় শহরে আবাসিক হোটেল, মোটেল, গেস্ট হাউজ, বাসা ভাড়া নিয়ে রোহিঙ্গা মেয়েদের দিয়ে পতিতাবৃত্তি করে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও রোহিঙ্গা শিবির থেকে অসংখ্য নারী বিভিন্ন কায়দায় পাচার হয়ে যাওয়ার খবরও পাওয়া গেছে। রোহিঙ্গা শিবিরে এইডস রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির খবরে চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকির আশংকা রয়েছে।
স্বাস্থ্য বিভাগের কক্সবাজার সিভিল সার্জন ডাক্তার আব্দুস সালাম বলেন, ইতোমধ্যে এইডস আক্রান্ত রোহিঙ্গা রোগীর সংখ্যা শতাধিক হয়েছে। এদের অধিকাংশ মিয়ানমারে থাকতে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। নতুন রোগীও পাওয়া যাচ্ছে। তা ছাড়া লোকলজ্জা ও পরিবেশ পরিস্থিতির কারনে অনেকে এইডস আক্রান্ত হওয়ার পরও নিজেদের আড়াল করে রাখছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। স্বাস্থ্য কর্মীদের রোহিঙ্গা শিবির গুলোতে এ ব্যাপারে সচেতনামুলক কর্মকান্ড বৃদ্ধি করে নতুন এইডস রোগী শনাক্তের জন্য বলা হয়েছে। তিনি জানান, এতদাঞ্চলে ব্যাপক হারে এইডস রোগ শনাক্ত হওয়ায় পর্যটন এলাকা সহ স্থানীয়ভাবে লোকজনের মাঝে চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকির আশংকা করা হচ্ছে।
পাঠকের মতামত: