নিজস্ব প্রতিবেদক :: ছটফট করতে করতে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের বেডে যখন শেষ নিঃশ্বাসটি ছাড়লেন কলেজের সেই শিক্ষকটি, মৃত্যুর আগে তিনি কি কল্পনাও করতে পেরেছিলেন বঙ্গোপসাগরের ওপারে যে গ্রামের আলো-হাওয়ায় বড় হয়েছেন তিনি, সেই গ্রামের মাটিতে ঠাঁই পেতে অনেক লড়াই করতে হবে তার নিথর দেহটাকে?
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে হেরে যান চট্টগ্রামের ফতেয়াবাদ সিটি কর্পোরেশন ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক আবদুল্লাহ আল মামুন। শুক্রবার (২৬ জুন) সকালে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাসটি ছেড়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। তিনি ছিলেন ওই কলেজের ফিন্যান্স, ব্যাংকিং ও বীমা বিষয়ের প্রভাষক।
এই কলেজশিক্ষকের মৃত্যুর পর লাশ নেওয়ার জন্য খবর পাঠানো হয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আল মানাহিল ফাউন্ডেশনের কাছে। দ্রুতই স্বেচ্ছাসেবীরা এসে গোসল ও কাফন পরানোর পর্ব শেষ করে নেন অভ্যস্ত হাতে।
কলেজশিক্ষক আবদুল্লাহ আল মামুনের বাড়ি কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার দক্ষিণ মলমচর গ্রামে। দাফন করা হবে সেখানেই। আল মানাহিলের দল তড়িঘড়ি তৈরি হয়ে লাশ নিয়ে ছুটে চললো পেকুয়ার উদ্দেশ্যে। মগনামা ফেরিঘাট হয়ে বঙ্গোপসাগর পার হয়ে তাদের গন্তব্য কুতুবদিয়া।
দুপুরেই তারা পেকুয়ার মগনামা ফেরিঘাটে পৌঁছে যায়। সেখানে নামতেই শুরু হল অন্যযুদ্ধ! সঙ্গে লাশ দেখে কোনো স্টিমার বা লঞ্চ তাদের নিতে রাজি নয়। দুর দুর করে তাড়িয়ে দিলেন লঞ্চচালকরা। বোঝানোর চেষ্টা করলেন সবাই মিলে। কিন্তু না, কোনোভাবেই কেউ রাজি নয়। সবারই এক কথা-করোনার লাশ! এলাকাবাসীর মানা আছে।
মগনামা ফেরিঘাটে অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকে আল মানাহিলের দল— যদি কোনোভাবে কোনো স্টিমার বা লঞ্চকে রাজি করানো যায়। ইতিমধ্যে মৃত ওই শিক্ষকের স্বজনদের মাধ্যমে খবর পাওয়া যায়, স্থানীয় কিছু লোক সংঘবদ্ধ হয়ে প্রশাসনের কাছে হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে, লাশ যাতে কুতুবদিয়ায় না আসে।
সেই চট্টগ্রাম থেকে এতো দূর এসে মৃতদেহটি নিয়ে কিভাবে আবার ফিরে যায় আল মানাহিলের দল! তারা চেষ্টা চালাতেই থাকে। শেষে অনেক চেষ্টা-তদবির ও বোঝানোর পর কুতুবদিয়ার ইউএনও জিয়াউল হক মীর কিছু শর্ত দিয়ে তাদের লঞ্চে কুতুবদিয়া যাওয়ার অনুমতি দেন। তবে আল মানাহিলের স্বেচ্ছাসেবীদের বিভিন্নভাবে আগেই সতর্ক করে দেওয়া হয়, ওই শিক্ষকের কোনো স্বজন লাশের সঙ্গে আসতে পারবে না।
কলেজ শিক্ষক আবদুল্লাহ আল মামুনের বাবা-মা আগে থেকেই ছিলেন কুতুবদিয়ার গ্রামের বাড়িতে। তবে আল মানাহিলের স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে চট্টগ্রাম থেকেই এসেছিলেন ওই শিক্ষকের দুই ভাই।
কোনো স্বজনকে যেন সঙ্গে নেওয়া না হয়— এমন সাবধানবাণীর কথা শুনতেই দুই ভাই হু হু করে কেঁদে ফেললেন। এমন মর্মস্পর্শী দৃশ্য দেখে আল মানাহিলের দলও আর ভাইদের ফেলে লঞ্চে উঠতে পারলেন না। তাৎক্ষণিক বুদ্ধি খাটিয়ে দুজনকেই পিপিই পরিয়ে পুরো মুখ ঢেকে দিয়ে লঞ্চে তুললেন। তবে সতর্কও করে দিলেন, কোনোভাবেই তারা যেন না কাঁদে। কারণ কাঁদলেই এলাকার মানুষ বুঝে ফেলবে এরা তাদের স্বজন।
আপন ভাইয়ের এমন মৃত্যুতে চোখের জল সংবরণ করা কঠিন— এটা জেনেও দুই ভাই প্রতিজ্ঞা করলেন, একটুও কাঁদবেন না তারা। সারা পথ সেভাবেই ছিলেন। প্রশাসনের সহায়তায় জানাজার নামাজ শেষে যখন মোনাজাতের সময় এলো, পিপিইতে মুখ লুকিয়ে থাকা এক ভাই আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে সহোদর ভাইয়ের জন্য আর্তনাদে ফেটে পড়লেন তিনি।
এমন কান্নায় হঠাৎ চমকে গেলেন আশেপাশে উঁকিঝুকি মারা অনেকেই। কারোরই বুঝতে অসুবিধা হল না, পিপিইর ভেতরে আসলে মৃত শিক্ষকেরই সহোদর। এমন দৃশ্যে হতবাক প্রতিবেশীদের অনেকেরই চোখ ভিজে উঠলো। মগনামা ঘাট থেকে লঞ্চে উঠার আগে যারা বারবার সাবধানবাণী পাঠাচ্ছিল— এমন কান্না তাদেরও ছুঁয়ে গেল।
কোনো বাধা না মেনে আশেপাশের অনেকে মুহূর্তেই ছুটে এলেন জানাজার মাঠে। অনেকে নিজেদের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইলেন। প্রতিবেশীদের কেউ কেউ গ্রামের ছেলেটার লাশ দাফনেও হাত লাগালো।
সন্ধ্যায় আল মানাহিলের দল যখন চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে কুতুবদিয়া ছেড়ে যাচ্ছিল, তখনও লোকগুলো ছিল তাদের পিছু পিছু। তাদের অশ্রুসজল চোখে এবার স্পষ্ট পড়া যাচ্ছিল কৃতজ্ঞতার না বলা ভাষা।
পাঠকের মতামত: