ঢাকা,রোববার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ট্রেন বন্ধে লাভ কার

নিজস্ব প্রতিবেদক ::

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ট্রেন বন্ধে লাভ কার। গত রোজার ঈদে চালুর পর নিয়মিত চলছিল চট্টগ্রাম-কক্সবাজার আন্তঃনগর ট্রেন।
সড়ক পথে বাড়তি ভাড়া আর সময়ের ঝক্কি এড়াতে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজায় যাত্রায় যাত্রীদের প্রিয় হয়ে উঠেছিল ট্রেন। ট্রেনটি বেশ লাভও করেছিল। কিন্তু দুই মাস না যেতেই আন্তঃনগর ট্রেনটি বন্ধ করে দিল রেল কর্তৃপক্ষ।

ইঞ্জিন ও লোকো মাস্টার সংকটকে এই ট্রেন বন্ধের কারণ হিসাবে দেখানো হলেও অভিযোগ উঠেছে, বাস মালিকদের চাপেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

কারণ ট্রেনটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় বাস কোম্পানিগুলো যাত্রী হারাচ্ছিল। তাতে বাস মালিকদের ভাড়া কমাতেও হয়েছিল।

রেলের এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার যাতায়াতকারীরা।

ঢাকা থেকে কক্সবাজার রুটে ট্রেন চালুর পর গত রোজার ঈদে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে বিশেষ একটি ট্রেন চালায় রেল বিভাগ। গত ৮ এপ্রিল থেকে চালু হওয়া এই ট্রেন গত বৃহস্পতিবার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

কেন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে

চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যাতায়াতে সড়কই ছিল একমাত্র পথ। বিমান এবং নৌ যোগাযোগ নেই পাশাপাশি দুই জেলার মধ্যে। সময় সাশ্রয়, অর্থ সাশ্রয়, নিরাপদ এবং আরামদায়ক এই সবদিক থেকে এই রুটে ট্রেন চালু হলে তা লুফে নেয় যাত্রীরা।

চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যেতে সড়কপথে ১৪৫ কিলোমিটার দুরত্ব বাসে পাড়ি দিতে সময় লাগে ৫ ঘণ্টা। যানজটে সেই সময়ও বাড়ে। খরচ হয় নন এসি বাসে ৪২০ টাকা, এসি বাসে প্রায় ১ হাজার টাকা।

বিপরীতে ট্রেনে নন এসি শোভন চেয়ারের ভাড়া ২৫০ টাকা, এসি স্নিগ্ধা চেয়ারের ভাড়া ৪৭০ টাকা। ট্রেনে যেতে সময় লাগে ৩ ঘণ্টা ২০ মিনিট।

এই পথে নিয়মিত যাতায়াতকারী চট্টগ্রামের কর কর্মকর্তা আমান উল্লাহ বলেন, “কক্সবাজার যাওয়ার আগে থেকেই আমি রেলসেবা অ্যাপে ট্রেনের টিকেট কিনে রাখতাম। ফলে অনটাইমে পৌঁছে জরুরি সব কাজ সেরে শনিবার আবার চট্টগ্রাম চলে আসতাম। যেটা আগে আমরা চিন্তাই করতে পারিনি। এতে সময় বাঁচত, টাকা বাঁচত, আর আমি টেনশনমুক্ত জার্নি করতাম।”

এই ট্রেন কেন বন্ধ করা হলো, সেই প্রশ্ন রাখেন তিনি।

আমানের মতো প্রশ্ন অধ্যাপক মোস্তফা জামানেরও। তিনি বলেন, “বিকল্প নেই বলে আমাকে চট্টগ্রাম যেতে হচ্ছে সড়কপথে। দেড় থেকে দুই লেনের এই সড়কে যখন দিনের বেলা রওনা দিই, নির্দিষ্ট করে বলতে পারি না কখন চট্টগ্রাম পৌঁছব।

“ট্রেন থাকলে আমার মতো প্রায় সবাই ট্রেনে চড়ত, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কারণ ভাড়া, সময়, নিরাপদ, আরামদায়ক, সবদিক থেকেই এগিয়ে রেল। তাহলে কার স্বার্থে ট্রেন বন্ধ করা হলো?”

কক্সবাজার রেল স্টেশন। ছিল সবচেয়ে লাভজনক ট্রেন

ঢাকা থেকে পর্যটন নগরী কক্সবাজার রুটে যাতায়াতের জন্য দুটি আন্তঃনগর ট্রেন চালু আছে। একটি কক্সবাজার এক্সপ্রেস, আরেকটি পর্যটক এক্সপ্রেস। সেই দুটি ট্রেনে ঢাকা থেকে সাড়ে ১৫শ যাত্রী চড়ে কক্সবাজার যাওয়ার সুযোগ থাকলেও চট্টগ্রামের জন্য বরাদ্দ মাত্র ২৩০টি সিট।

অর্থাৎ প্রতিদিন চট্টগ্রামের ২৩০ যাত্রী এই দুটি ট্রেনে চড়ার সুযোগ পাচ্ছেন। শতাংশের হিসাবে যা মাত্র ১৫ ভাগ। সেই দুটি ট্রেনে এত কম যাত্রী বরাদ্দ থাকায় চট্টগ্রামবাসীকে সেটি টানেনি। ফলে সেই ট্রেন চট্টগ্রামের যাত্রী পায়নি।

গত ঈদুল ফিতর উপলক্ষে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যাতায়াতের জন্য কক্সবাজার স্পেশাল ট্রেন চালু করা হয়। পরে যাত্রী চাহিদা দেখে সেই ট্রেনের সময় বাড়িয়ে ১০ জুন পর্যন্ত করা হয়।

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটের এই ট্রেনটি আটটি স্টেশন- চট্টগ্রামের ষোলশহর, জানালী হাট, পটিয়া, দোহাজারী, সাতকানিয়া, চকরিয়া, ডুলাহাজারা ও রামুতে যাত্রা বিরতি দিচ্ছিল।

৮ এপ্রিল চালু হওয়া এই ট্রেন থেকে ৫ মে পর্যন্ত মোট ২৫ দিনে ৫১ লাখ ২৫ হাজার ৩৬২ টাকার রাজস্ব আয় হয় বলে হিসাব পাওয়া গেছে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল থেকে। অর্থাৎ দিনে গড়ে আয় ২ লাখ টাকার বেশি।

অথচ চট্টগ্রাম-ঢাকা রুটে মহানগর এক্সপ্রেস আন্তঃনগর ট্রেনটি এপ্রিল মাসের ৩০ দিনে আয় করেছে ৫০ লাখ টাকা। রাজস্ব আয় কম হলেও মহানগর এক্সপ্রেস ট্রেন চালু রাখা হয়েছে, আর বন্ধ করা হয়েছে কক্সবাজারের বিশেষ ট্রেনটি।

ট্রেনের যাত্রী চাহিদা সামাল দিয়ে রাজস্ব আয় আরও বাড়াতে ২১ মে থেকে ট্রেনটির কোচের সংখ্যা ৫টি বাড়িয়ে ১৫টি করা হয়। এতে ট্রেনটির যাত্রী পরিবহন ক্ষমতা ৪৩৮ জন থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৭০৫ জনে। ফলে রাজস্ব আয় আরও বেড়ে যায়।

এই অবস্থায় ট্রেনটিকে স্থায়ী রূপ দিতে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছিল রেল কর্তৃপক্ষ। সেই প্রস্তাবে এই ট্রেনকে দুই ট্রিপ অর্থাৎ দিনে দুবার যাতায়াতের সুপারিশ ছিল। আর ১০ বগির পরিবর্তে ১৮টি বগি দিয়ে চালানোর প্রস্তাব ছিল; যাতে একসঙ্গে ৮৫০ যাত্রী চলাচল করতে পারত।

সেই প্রস্তাব আমলে না নিয়ে উল্টো সেই ট্রেনটিই বন্ধ করে দিল রেল ভবন।

বাস মালিকদের মুনাফায় টান

ঢাকা-কক্সবাজার রুটে দুটি ট্রেন চালুর পর এতটাই জনপ্রিয়তা পায় যে প্রতিদিন সকালে যে টিকেট ছাড়া হয়, দুই ঘণ্টার মধ্যেই অ্যাপের সব টিকেট বিক্রি শেষ হয়ে যায়। ভাড়া কম, সময় সাশ্রয়, নিরাপদ ও আরামদায়ক-এই তিন প্রধান কারণেই বাসের পরিবর্তে যাত্রীদের ট্রেনমুখী করে তোলে।

চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার স্পেশাল ট্রেনে ৭০৫ জন, পর্যটক এক্সপ্রেস ও কক্সবাজার এক্সপ্রেসে আরও ২৩০ যাত্রী কক্সবাজার যেতে পারে। ফলে প্রতিদিন ৯৩৫ যাত্রী ট্রেনে যেতে পারছিল।

এই সংখ্যক যাত্রী বাসের বদলে নিয়মিতই ট্রেনে ভ্রমণ শুরু করায় এই রুটে বাসযাত্রী যায় কমে। তার প্রতিক্রিয়ায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে বাসা ভাড়া কমাতে বাধ্য হয় পরিবহন মালিকরা।

গত ২৭ মে প্রথম বাসভাড়া কমায় সৌদিয়া পরিবহন। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার পর্যন্ত তাদের সরাসরি বাসভাড়া ছিল নন এসি ৪২০ টাকা; এখন তা ৩৩০ টাকা। চট্টগ্রাম-লোহাগাড়া ভাড়া ছিল ১৮০ টাকা, তা এখন ১৩০ টাকা। আর লোহাগাড়া-কক্সবাজার ভাড়া ছিল ২৪০ টাকা, এখন তা ২০০ টাকা।

সৌদিয়া কোচ সার্ভিসের দেখাদেখি ভাড়া কমিয়ে দেয় পুরবী পরিবহনও। তারা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ভাড়া ৩২০ টাকা বিক্রি করছে। ঈদগাহ-চট্টগ্রাম ২৯০ টাকা, চকরিয়া-চট্টগ্রাম ২৩০ টাকা এবং কেরানিহাট-চট্টগ্রাম ১২০ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করে তারা।

পূরবী পরিবহন বান্দরবানভিত্তিক একটি পরিবহন কোম্পানি হলেও চট্টগ্রাম-বান্দরবান কিংবা বান্দরবান-কক্সবাজার রুটে কিন্তু ভাড়া কমায়নি। সৌদিয়া পরিবহন চট্টগ্রাম-ঢাকা রুটে কিংবা চট্টগ্রাম-বান্দরবান, চট্টগ্রাম-আলীকদম রুটে কিন্তু ভাড়া কমায়নি।

কক্সবাজার রুটের ভাড়া কমানোর বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি কফিল উদ্দিনকে ফোন করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সংগঠনটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং সৌদিয়া পরিবহনের মহাব্যবস্থাপক খোরশেদ উদ্দিনকে ফোন করেও সাড়া মেলেনি।

কক্সবাজারের ‘চকরিয়া সচেতন নাগরিক কমিটি’র সহ-সভাপতি জিয়া উদ্দিন বলেন, “ট্রেন চালুর পর থেকেই বাস যাত্রী যে কমেছে সেটা প্রমাণিত। এখন একাধিক ট্রেন চালু হলে বাস সার্ভিসের কী হবে, আঁচ করাই যাচ্ছে। ফলে ব্যবসা হারানোর ভয়ে বাস মালিকরা আগেভাগেই ভাড়া কমিয়েছে।”

ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে এখন চলে দুটি আন্তঃনগর ট্রেন।
বাস মালিকদের চাপে?

বাস মালিকদের ‘প্রেসক্রিপশনে’ কক্সবাজার স্পেশাল ট্রেন বন্ধ করা হয়েছে অভিযোগ করে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়েছেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী।

তিনি বলেন, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-চট্টগ্রাম রুটে যাত্রীরা যখন এই ট্রেনে নিয়মিত যাতায়াত করছিলেন, তখন বাস মালিকেরা একে একে সব পরিবহনে যাত্রী সংকট দেখা দিলে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে যাত্রী প্রতি বাস ভাড়া ১০০ টাকা পর্যন্ত কমিয়ে আনতে বাধ্য হয়।

“তারপরেও বাসে যাত্রী না পাওয়ায় বাস মালিকেরা রেল প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে ফেলেছে বলে এই রুটের যাত্রীদের অনেকেই মনে করেন। তাই বাস মালিকদের প্রেসক্রিপশনে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটের জনপ্রিয় ট্রেন সার্ভিস কক্সবাজার স্পেশাল ট্রেন বন্ধ করা হচ্ছে।”

রেলওয়ের এক শ্রেণির কর্মকর্তা সরকারের আকাঙ্ক্ষার বাইরে গিয়ে বাস মালিকদের লাভবান করতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে অভিযোগ করে তিনি ট্রেনটি পুনরায় চালু করতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।

‘চকরিয়া সচেতন নাগরিক কমিটি’র সহ-সভাপতি জিয়া উদ্দিন ইঞ্জিন সংকটের যুক্তির বিরোধিতা করে বলেন, “প্রয়োজনে অন্য রুট থেকে বা পণ্যবাহী সার্ভিস বন্ধ করে হলেও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুট চালু করতে হবে।”

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটটির জনপ্রিয়তার কথা স্বীকার করলেও তা বন্ধের ক্ষেত্রে বাস মালিকদের চাপের কথা অস্বীকার করছেন পূর্ব রেলের কর্মকর্তারা।

রেলের পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) সাইফুল ইসলাম বলেন, “এই রুটটি বেশ জনপ্রিয়। চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের যাত্রীদের জন্য এই রুটে একটি ট্রেন পর্যাপ্ত না। একাধিক ট্রেন দরকার, আমরা বিষয়টি মানি। ইঞ্জিন সংকটের কারণে সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।”

আসন্ন কোরবানির ঈদ ঘিরে ট্রেনটি আবার চালু করার ঘোষণা রেল কর্তৃপক্ষ থেকে এসেছে। তবে তা মাত্র কয়েক দিনের জন্য।

নিয়মিতভাবে ট্রেনটি চালু হবে কি না, সে বিষয়ে সাইফুল বলেন, নিয়মিত ট্রেনটি আবার চালু হতেও পারে।

পাঠকের মতামত: