এম.মনছুর আলম, চকরিয়া ::
এক সপ্তাহ ধরে টানা ভারি বর্ষণ ও উজান থেনে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে কক্সবাজারের চকরিয়ায় বন্যা পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করেছে। বেশ কয়েকটি পয়েন্টে পাউবোর বেঁড়িবাঁধ ভেঙ্গে গিয়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এতে উপজেলার একটি পৌরসভা ও ১৮টি ইউনিয়নের প্রায় ৪ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। চকরিয়া পৌরশহরের চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের উপর দিয়ে মাতামুহুরী নদীর পানি প্রবাহিত হওয়ায় সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। এছাড়াও চকরিয়ার অভ্যন্তরীন সড়কের সকল ধরণের যানচলাচল বন্ধ থাকায় বানবাসি মানুষ নৌকা, বাঁশের ভেলা ও গাড়ির টায়ার দিয়ে পারাপার করছে।
আবহাওয়া অফিসের কক্সবাজার আঞ্চলিক কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষণ কর্মকর্তা দুলাল চন্দ্র দাশ জানান, সোমবার সকাল ৬টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ১৬৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ১৭ মিলিমিটার। আগামী তিন দিনেও বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা। এতে পাহাড় ধসের আশঙ্কাও রয়েছে বলে জানান তিনি। ভারিবর্ষণ অব্যাহত থাকায় চকরিয়া দেয়াল ধসে এক বৃদ্ধার মৃত্যু ও বন্যার পানির স্রোতে দুই শিশু ভেসে গিয়ে নিখোঁজ রয়েছে।
চকরিয়ার বন্যা পরিস্থিতির গতকাল থেকেচরম অবনতি হয়েছে। গেল ২৪ ঘণ্টায় মাতামুহুরী নদীর পানি বেড়ে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এরই মধ্যে নতুন করে বিভিন্ন লোকালয়ে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, চকরিয়া উপজেলার অভ্যন্তরীণ সড়কসমূহ পানিতে ডুবে গেছে। উপকূলের বিভিন্ন সড়ক পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকায় মানুষের দুর্ভোগ চরমে।
বানবাসি মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চকরিয়া উপজেলায় অধিকাংশ নিম্নাঞ্চলের বসতবাড়ি, বাজার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এসব এলাকার বিভিন্ন সড়কও পানির নিচে। তলিয়ে গেছে ফসলী জমি, বীজতলা ও মাছের খামার। এ ছাড়া বন্যার কারণে গো-খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ গবাদিপশুসহ মালামাল অন্যত্র সরিয়ে নিতে শুরু করেছেন।
উপকূলীয় এলাকা বদরখালী, ডেমুশিয়া, কোনাখালী, বিএমচর, পূর্ববড় ভেওলা, পশ্চিম বড় ভেওলা ইউনিয়নের বন্যার্তদের অনেকে গবাদিপশুসহ বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। সোমবার রাত ১টার পর থেকে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। মঙ্গলবার গভীর রাত ৩টা থেকে উপজেলার ১৮ ইউনিয়ন ও পৌরসভা এলাকায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। শত শত নলকূপ পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় বানবাসি এলাকায় সুপেয়ে পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে।
পাহাড়ি ঢলে মাতামুহুরী নদীর ভাঙনকৃত অংশ দিয়ে হু হু করে লোকালয়ে ঢলের পানি ঢুকে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এতে উপজেলার কাকারা, সুরাজপুর-মানিকপুর, বরইতলী, হারবাং, পুর্ববড় ভেওলা, বিএমচর, পশ্চিম বড় ভেওলা, চিরিঙ্গা, লক্ষ্যারচর, কৈয়ারবিল, ফাসিয়াখালী, কোনাখালী, চকরিয়া পৌরসভা ও ইউনিয়নের বেশিরভাগ গ্রামে বন্যার পানি ঢুকে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।
পাহাড়ি ঢলের প্রবেশমুখ সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়ন ও কাকারা ইউনিয়ন এখনো ৫-৬ ফুট পানির নিচে তলিয়ে আছে। কাকারা-মানিকপুর সড়কের কয়েকটি অংশের উপর দিয়ে মাতামুহুরী নদী থেকে উপচে আসা ঢলের পানি প্রবাহিত হওয়ায় বসতঘরগুলো পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে।
গতকাল রাত ১২টার দিকে মাতামুহুরী নদীর পানি পৌরশহরের রক্ষাবাঁধ উপচে পড়ে বিভিন্ন শপিং কমপ্লেক্সে বন্যার পানি ডুকে পড়ে। বন্যার পানির স্রোতে রাতে ভেসে গেছে ব্যবসায়ীদের মালামাল। এতে ব্যসায়ীরা
কয়েকশ কোটি টাকার ক্ষতির আশংকা করছে তারা। গত দুইদিন ধরে বিদ্যুৎ না থাকায় চরম দুর্বিসহ জীবন অতিবাহিত করছে বন্যা কবলিত বানবাসি মানুষরা।
এদিকে, গত পরশুদিন পৌরসভার কয়েকটি ওয়ার্ডে বন্যার পানি ডুকলেও সোমবার রাত থেকে ৯টি ওয়ার্ডে পুরোপুরি বন্যার পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ১নাম্বার বাঁধ ও কোচপাড়ার বাঁধ দুটি ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। স্থানীয় লোকজন সারারাত চেষ্টা করে বাঁধ দুটি ভাঙ্গন থেকে রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম ও কাকারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাহাব উদ্দিন জানান, তাদের ইউনিয়নগুলো মাতামুহুরী নদীর সাথে লাগোয়া। এজন্য পাহাড় থেকে নামা ঢলের পানি আগে আঘাত আনে ইউনিয়নগুলোতে। এই দুই ইউনিয়নে বর্তমানে অধিকাংশ ঘরই পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে। গত দুইদিন ধরে তাদের রান্নার কাজও বন্ধ। শুধু শুকনো খাবার খেয়ে রয়েছে ইউনিয়নের বানবাসি মানুষ। তবে সবচেয়ে বেশি দেখা দিয়েছে সুপেয় পানির অভাব।
চকরিয়া পৌরসভার মেয়র আলমগীর চৌধুরী বলেন, অতিবৃষ্টির কারণে পৌরসভার অধিকাংশ ওয়ার্ড পানির নিচে তলিয়ে গেছে। স্ব-স্ব ওয়ার্ডের কাউন্সিলররা পানি যাতে দ্রুত নিচের দিকে নেমে যায়, সেজন্য কাজ করছেন। এছাড়াও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ১নং বেঁড়িবাঁধটি রক্ষার জন্য বালির বস্তা ফেলা হচ্ছে।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেপি দেওয়ান বলেছেন, বন্যাকবলিত এলাকাগুলো পরিদর্শন করেছি। প্রশাসনের হিসেব অনুযায়ী প্রায় চার লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বন্যা কবলিত মানুষদের নিকটস্থ আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। যেসব মানুষ কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে তাদের বিশুদ্ধ পানি ও শুকনো খাবার দেওয়া হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এ ছাড়াও যারা ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে চাচ্ছে না সেসব পরিবারকে প্রাথমিকভাবে শুকনো খাবার দিতে চেয়ারম্যানদের নির্দেশনা দেযা হয়েছে।
বন্যার ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মহোদয়কে অবহিত করে নতুন করে ত্রাণ বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনের সংসদ সদস্য ও চকরিয়া উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি জাফর আলম জানান, গত রাত থেকে বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছি। বন্যা কবলিত অধিকাংশ লোকজনকে নিকটস্থ আশ্রয় কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। তাদের জন্য রান্না করা খিচুড়ি ও শুকনো খাবার দেয়া হচ্ছে। #
পাঠকের মতামত: