ঢাকা,রোববার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪

ছোট ছোট কালভার্ট নির্মাণের দাবি এলাকাবাসীর

চকরিয়ায় পানি নিষ্কাশনে বাধা রেল লাইনের উঁচু রাস্তা, স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা

নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া ::
কয়েকদিনের টানা ভারী বর্ষণ ও পার্বত্য অববাহিকার মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে ভয়াবহ বন্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার প্রায় সাত লাখ মানুষকে। গত দু’দিন বৃষ্টি কমে যাওয়ায় বন্যা উপদ্রুত এলাকা থেকে নেমে যাচ্ছে বানের পানি। তবে এবার পানি নামছে খুবই শ্লথগতিতে।

অতীতের একাধিকবার ভয়াবহ বন্যা দু-একদিন স্থায়ী হলেও এবারের অভিজ্ঞতা একেবারেই ভিন্ন। এই ভিন্নতার ব্যাখ্যা হিসেবে বন্যাকবলিত এলাকার ভুক্তভোগী সচেতন মানুষ, জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার দায়িত্বশীল লোকজন এবারের বন্যাকে ‘স্মরণকালের ভয়াবহ’ বন্যা বলে দাবি করছেন।

এক্ষেত্রে নির্মাণাধীন দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুমধুম রেললাইনের চকরিয়া অংশের উঁচু রাস্তাকে ভাটির দিকে পানি নেমে যেতে বিরাট প্রতিবন্ধকতা হিসাবেও দেখছেন তারা।

করোনাকালে এবারের একটানা বর্ষণ ও মাতামুহুরী নদীর ঢলের পানিতে সৃষ্ট ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এখানকার জনজীবন। এই অবস্থায় গলার কাঁটা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে বাস্তবায়িত রেল লাইনের উঁচু রাস্তাটি। কারণ এই রাস্তার পূর্বাংশজুড়ে আটকা পড়েছে কয়েকফুট উচ্চতায় বৃষ্টি ও বানের পানি। চকরিয়াবাসী বলছেন, পানি নেমে যাওয়ার জন্য এলাকাভিত্তিক ছোট ছোট কালভার্ট না থাকায় এই পানি ভাটির দিকে নামতে পারছে না। পানিতে তলিয়ে গেছে হাজার হাজার একর জমির ফসল।

সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, এবারের ভয়াবহ বন্যার আগে বিগত ২০১৭ সালের বর্ষায় পর পর দুইবার ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছিল চকরিয়ার মানুষ। তখন বন্যার পানি লোকালয়ে এক বা দুইদিন স্থায়ী হয়ে দ্রুতই ভাটির দিকে নেমে গিয়েছিল। এতে অনেকটাই রক্ষাও পেয়েছিল ক্ষেতের ফসল, চিংড়ি ঘের ও পুকুরের মৎস্যভাণ্ডার। কিন্তু এবারের মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি চকরিয়াবাসীকে।

এই পরিস্থিতিতে রেললাইন প্রকল্পে প্রয়োজন অনুপাতে এলাকাভিত্তিক ছোট ছোট কালভার্ট নির্মাণের জোরালো দাবি তুলেছেন ভুক্তভোগী চকরিয়াবাসী। তা না হলে প্রতিবছর বর্ষায় এবারের মতো পরিস্থিতির শিকার হতে হবে বলে তাদের অভিমত।

সরজমিন দেখা গেছে, লাগাতার বর্ষণে নির্মিতব্য প্রায় ১০ ফুট উচ্চতার রেল লাইনের রাস্তার পূর্বাংশজুড়ে বর্তমানে আটকা পড়েছে কয়েক ফুট উচ্চতায় জমে থাকা বৃষ্টি ও বানের পানি। এই অবস্থায় ভয়াবহ জলাবদ্ধতার শিকার হয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের হাজারো পরিবার। পানিতে তলিয়ে গেছে দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ, চিংড়িঘের ও মৎস্য প্রকল্পগুলো। এতে আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন এখানকার মানুষ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার হারবাং, বরইতলী, কোনাখালী, ঢেমুশিয়া, পূর্ব বড় ভেওলা, পশ্চিম বড় ভেওলা, বিএমচর, সাহারবিল, চিরিঙ্গা, ফাঁসিয়াখালী, ডুলাহাজারা, খুটাখালী ইউনিয়নের বেশি সমস্যা করছে রেল লাইনের উঁচু রাস্তাটি। এই রাস্তার কারণেই ইউনিয়নের পর ইউনিয়নে ব্যাপক জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। তার ওপর ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকায় তলিয়ে যাচ্ছে ক্ষেতের ফসলও।

কাকারা ইউনিয়নের মাতামুহুরী তীরের বাসিন্দা সাংবাদিক এম আর মাহমুদ চকরিয়া নিউজকে জানান, চারিদিকে বিভিন্ন ধরণের উঁচু রাস্তা ও নদীতে বাঁধ থাকায় অতি বৃষ্টির পানি ভাটির দিকে নামতে পারছে না। এতে অতি দ্রুতই ডুবে যাচ্ছে চকরিয়ার লোকালয়।

চিরিঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জামাল হোসেন চৌধুরী বলেন, আমার ইউনিয়নে ইতোপূর্বে এমন বন্যার সম্মুখীন হয়নি মানুষ। ইউনিয়নের তিনটি ওয়ার্ডের মানুষ ভয়াবহ জলাবদ্ধতার কবলে পড়েছে। নির্মাণাধীন রেলাইনের সাথে এলাকাভিত্তিক প্রয়োজনীয় ছোট ছোট কালভার্ট নির্মিত না হওয়ায় পানি যাওয়ার পথ নেই।

চকরিয়ার মাতামুহুরী সাংগঠনিক উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পশ্চিম বড় ভেওলা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাবলা চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘দোহাজারী – কক্সবাজার এবং ফাঁসিয়াখালী – মাতারবাড়ি কয়লাবিদ্যুৎ পর্যন্ত রেললাইন সড়কের বিশাল অংশ আমার ইউনিয়নে পড়েছে। এতে বৃষ্টি ও বানের পানি ভাটির দিকে নামতে গিয়ে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে রেল লাইনের উঁচু রাস্তা। তাই রেল লাইনটি পুরোপুরি বাস্তবায়নের আগে এলাকাভিত্তিক সমস্যা চিহ্নিত করে পানি যাতে ভাটির দিকে নামতে পারে সেজন্য ছোট ছোট কালভার্ট নির্মাণ করা খুবই জরুরি।’

এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘বড় ধরণের কোনো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে পানি নিষ্কাশনের বিষয়টি সুনিশ্চিত করা উচিত। তাছাড়া আইন অনুযায়ী যে কোনো ধরনের রাস্তা, সড়ক, বাঁধসহ অবকাঠামো নির্মাণ করার আগে পানি প্রবাহের ক্ষেত্রে কোনো ধরণের প্রতিবন্ধকতা করা যাবে না। এটি জেলা পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটির আইনেই স্পষ্ট করে বলা আছে।’

জানতে চাইলে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ শামসুল তাবরীজ চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘ভারি বর্ষণ এবং মাতামুহুরী নদীতে নেমে আসা উজানের পানি যাতে দ্রুত ভাটির দিকে নেমে যেতে পারে সেজন্য উপকূলীয় এলাকার সকল স্লুইচ গেট দ্রুতই খুলে দেওয়া হয়। গত দুইদিন তেমন ভারী বর্ষণ না হলেও বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের লোকালয়ে এখনো বানের পানি রয়ে গেছে। এতে ফসলের মাঠ, মৎস্য প্রকল্পের ব্যাপক ক্ষতিও হচ্ছে। এক্ষেত্রে নির্মাণাধীন রেল লাইনের উঁচু রাস্তাকে দায়ী করছেন এলাকার জনপ্রতিনিধি ও সচেতন লোকজন। যা আমার অভিজ্ঞতায়ও বাস্তব এবং যৌক্তিক দাবি। রেল লাইনের তলদেশে এলাকা ভিত্তিক প্রয়োজনীয় ছোট ছোট কালভার্ট নির্মাণ করা যায় কি না প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসে করণীয় নির্ধারণ করা হবে।’

এ ব্যাপারে কক্সবাজার-১ আসনের সংসদ সদস্য ও চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাফর আলম চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘যেহেতু রেললাইন নির্মাণের কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি, তাই কোথায় কী সমস্যা তা চিহ্নিত করার সুযোগ রয়েছে এখনো।’

পাঠকের মতামত: