ঢাকা,রোববার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪

কবি আফজল আহমদ (বি.এ) জীবন্ত আদর্শ ও মহান শিক্ষাগুরু (আজ ৭ম মৃত্যু বার্ষিকী)

সেলিম উদ্দিন, ঈদগাঁও, কক্সবাজার ::

মাওলানা আফজল আহমদ ১৯৪০ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারী বৃহস্পতিবার চকরিয়া উপজেলার খুটাখালী ইউনিয়নের দক্ষিন পাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা আলহাজ্ব মাওলানা আবুল ফজল সাহেব ছিলেন ফুলছড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও খুটাখালী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব। তাঁর পূর্বপুরুষগণ সবাই আলেম এবং ধর্মপরায়ন লোক ছিল। তাঁর পূর্ব পুরুষগন চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়া উপজেলার বড়হাতিয়া ইউনিয়নের অধীবাসি ছিলেন। বড়হাতিয়া ইউনিয়নের মাওলানা আবদুর বারী রাহ: প্রকাশ বুড়া হুজুর তাঁর পূর্ব পুরুষ, বড় হাতিয়ায় বুড়া মওলানার মাজার শরীফ এখনো বিদ্যামান রয়েছে। ১৬৬০ খ্রী: তাহার পুর্বপুরুষ শাহ্ আবদুর রাজ্জাক মিয়াজীর পুত্র শাহ্ নুরুদ্দীন মিয়াজি ধর্মীয় কার্যাধী শিক্ষা দেয়ার জন্য খুটাখালী আগমন করেন। তাঁর ঔরশে মাওলানা অছিউদ্দিন ও বদিউদ্দিনের জন্ম। মাওলানা অছিউদ্দিনের ঔরশে জন্ম নেন মাওলানা আবুল ফজল ও মাষ্টার আব্দুস ছামাদ। বদিউদ্দিনের ঔরশে জন্ম নেন মাষ্টার আব্দুল আজিজ ও আব্দুল বারী। মাওলানা আবুল ফজল (১৮৯৩-১৯৭১) এর যোগ্য উত্তরসুরী মাওলানা আফজল আহমদ (বি.এ)। তাঁর মাতার নাম জরিনা খাতুন। তাঁর মাতুলালয় কক্সবাজার জেলার সদর উপজেলার ইসলামাবাদ ইউনিয়নের বোয়ালখালী গ্রামে।

শিক্ষা জীবন: মালানা আফজল আহমদ (বি.এ) ৭ বছর বয়সে ১৯৪৭ সালে ফুলছড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৫১ সালে তিনি বৃত্তিসহ পঞ্চম শ্রেণী পাশ করেন। ১৯৫২ সালে স্বগৃহে অবস্থান করে তিনি পিতার নিকট থেকে বাংলা-আরবী, ইংরেজী, উর্দু, ফারসী বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি ঈদগাঁও আলমাছিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় ৭ম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে উক্ত মাদ্রাসা হতে দাখিল পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে ১ম স্থান অধিকার করেন। ১৯৬০ সালে তিনি উক্ত মাদ্রাসা হতে কক্সবাজার হাশেমিয়া আলিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্র থেকে আলীম পরীক্ষায় অংশ গ্রহন করেন। সেই বছর ২৫০ জন আলিম ও ফাজিল পরীক্ষার্থীর মধ্যে তিনি ১ম বিভাগে পাশ করে সেন্টারের সুনাম করেন। তাঁর প্রখর মেধা শক্তি দেখে আলমাছিয়া মাদ্রাসার সম্মানিত শিক্ষক মহোদয়গণ আরো ভাল ফলাফলের জন্য চট্টগ্রামের প্রাচীনতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম আলীয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন। শিক্ষক মহোদয়গনের পরামর্শ মোতাবেক তিনি চট্টগ্রাম দারুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসায় ফাজিল শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে ১৯৬২ ইংরেজীতে ফাজিল পরীক্ষায় সারা পূর্ব পাকিস্তানে তিনি মেধা তালিকায় ১ম শ্রেণীতে ৬ষ্ট স্থান অধিকার করেন। ১৯৬৪ সালে একই মাদ্রাসা হতে তিনি হাদিস বিভাগ থেকে ১ম শ্রেণীতে ৮ম স্থান অধিকার করে কামিল পাশ করেন। অতপর ১৯৬৬ সালে তিনি চট্টগ্রাম সরকারী সিটি কলেজ থেকে আই.এ. পাস করেন এবং ১৯৬৮ সালে একই কলেজ থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে বি.এ. ডিগ্রী অর্জন করেন। ইহাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্ব প্রথম বি.এ. পরীক্ষার ফলাফল। তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গ্রেজুয়েট। তিনি খুটাখালীর ৪ নং গ্রেজুয়েট। উনার পূর্বে যথাক্রমে প্রফেসর রিদোয়ানুল হক, প্রফেসর মোহাম্মদ নাজের ও এডভোকেট মুহাম্মদ উলাহ গ্রেজুয়েশন লাভ করেন। ১৯৬০ সালে তিনি আলমাছিয়া ফাজিল মাদ্রাসার এ.জি.এস নির্বাচিত হন। ১৯৬৩ সালে তিনি চট্টগ্রাম দারুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসার হেল্পিং জি.এস. নির্বাচিত হন । ১৯৬৪ সালে তিনি উক্ত মাদ্রাসার জি.এস. নির্বাচিত হন।

কৃতিত্ব: ১৯৬৩ সালে চট্টগ্রাম ডেপুটি কমিশনার কর্তৃক প্রচারিত “মাদ্রাসা শিক্ষার ভবিষ্যৎ” রচনা প্রতিযোগীতায় তিনি ১ম স্থান অধিকার করে পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে কক্সবাজার সমিতি কর্তৃক প্রচারিত “জাতীয় অর্থনীতিতে কক্সবাজারের ভূমিকা” শীর্ষক রচনা প্রতিযোগীতায় অংশ গ্রহণ করে ১ম পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি সিটি কলেজ কর্তৃক “রাজনীতিবিধ হযরত মোহাম্মদ (স:)” শীর্ষক প্রবন্ধ প্রতিযোগীতায় অংশ গ্রহণ করেন এবং প্রথম স্থান অধিকার করেন। ফাজিল শ্রেণীর ইল্মে ফিক্হ বিষয়ক “হেদায়া” গ্রন্তের ইবারত উনার মুখস্থ ছিল।

সমাজ সেবা ও কর্ম জীবন: ২০/০৮/১৯৬৮ ইংরেজী তারিখে তারই প্রচেষ্টাতে খুটাখালী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে ঈমাম ও খতিবকে বেতন ভাতা দেয়া হয়। ২০/০৯/১৯৬৮ সালে তিনি মেদাকচ্ছপিয়া থেকে বিদ্যুৎ লাইন আনতে যে গাছ পড়েছে তাহা বন বিভাগ থেকে অক্শন নেন এবং রি-অক্শন দিয়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে ৫০০/-টাকা, খুটাখালী হাইস্কুলে ৪৭০/- টাকা এবং ফরেষ্ট অফিস মসজিদে ২০০ টাকা বন্টন করে দেন। ২২/১২/১৯৬৮ সালে তিনি খুটাখালী জনসাধারণকে একত্রে ঈদের নামাজ আদায়ের জন্য উদ্বোদ্ধ করেন। উনার আহ্বানে সাড়া দিয়ে তৎকালীন ডুলাহাজারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কবির আহমদ (ঠান্ডা মিয়া), হাজী বদিউজ্জমান সওদাগর ও আবদুস সালাম সিকদারসহ সর্বস্থরের জনসাধারণ একত্রে ঈদের নামাজ আদায় করেন। ২৫/১২/১৯৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্থানের কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রী কাজী আনোয়ারুল হক সাহেবকে খুটাখালী জুনিয়র হাই স্কুলে আনতে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৮ সালে রমজান মাসে প্রথম খতমে তারাবীহ উনার প্রচেষ্টায় শুরু হয়। ২৭/০৮/১৯৬৯ সালে মওলানা মুহাম্মদ ইসমাঈল আরকানী উনাকে “শাইখুল হাদীস” উপাধিতে ভুষিত করেন। ২৮/০২/১৯৬৯ সালে তিনি খুটাখালী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে মৌ: ইসমাইল আরকানীকে শিক্ষক নিয়োগ করে একখানা ফোরকানিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্টা করেন। ৩০/০৮/১৯৬৯ ইং সেটাকে প্রতি শুক্রবার খুটাখালী কেন্দ্রীয় জমে মসজিদে বিনা বেতনে ১ ঘন্টা তাফসিরে জালালাইন এবং বোখারী শরীফ পাঠদান করেন। তিনি ইলমে ফরায়েজ ও ফতোয়া সম্পর্কে তাঁর অগাধ জ্ঞান ছিল। তিনি ফরায়েজ এবং ফতোয়া দিয়ে হাজার হাজার মানুষের সমস্যার সামধান দিয়েছেন।

শিক্ষকতা জীবন: ১৬ জানুয়ারী ১৯৬৯ ইংরেজী সাল থেকে ৩১ মে ১৯৭১ ইংরেজী সাল পর্যন্ত খুটাখালী তামিজিয়া ইসলামিয়া জুনিয়র মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা সুপারিনটেনডেন্ট এর দায়িত্ব পালন করেন। ১ জুন ১৯৭১ থেকে ২৯ ফেব্রুয়ারী ১৯৮৮ ইংরেজী সাল পর্যন্ত খুটাখালী উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ৪ এপ্রিল ১৯৮০ থেকে ২৮ এপ্রিল ১৯৮৮ ইংরেজী তারিখ পর্যন্ত খুটাখালী কিশলয় আদর্শ শিক্ষা নিকেতনের অবৈতনিক প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক হিসাবে (সকাল ৮-১০ টা পর্যন্ত ) দায়িত্ব পালন করেন। ১ মার্চ ১৯৮৮ ইং তারিখ হইতে খুটাখালী কিশলয় আদর্শ শিক্ষা নিকেতনে সিনিয়র ইংরেজী শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। ৩১ ডিসেম্বর ২০০৬ সালে তিনি চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে সুপার নিউমারারী শিক্ষক হিসাবে পুনরায় তাঁকে নিয়োগ দেন। তিনি ছিলেন কিংবদন্তি শিক্ষক, শিক্ষক সমাজের জিবন্ত আদর্শ ও মহান শিক্ষাগুরু।

আধুনিক সুশিক্ষিত খুটাখালীর রূপকার: স্বাধীনতা পূর্বকালে খুটাখালী ইউনিয়ন ছিল শিক্ষাদীক্ষায় অনগ্রসর একটি গাঁ। স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসা ছিল নামে মাত্র। যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে এসব প্রতিষ্ঠানের অবস্থা ছিল অত্যন্ত করুণ। মাওলানা আফজল আহমদ বি.এ শিক্ষা জীবন শেষ করে শিক্ষাদীক্ষায় অনগ্রসর এই গাঁওকে আধূনিক সুশিক্ষিত খুটাখালীতে রূপান্তরের ব্রত নিয়ে একে একে সব প্রতিষ্ঠানের পূর্নগঠনের মনোনিবেশ করেন। ঐ সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে লোভনিয় বিভিন্ন প্রস্তাব তিনি সহজ মনে প্রত্যাক্ষান করেন। কারন তার মনোভাব ছিল খুটাখালীকে একটি আধুনিক সুশিক্ষিত মডেল হিসাবে গড়ে তোলা। তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় সু-প্রতিষ্ঠিত। তিনি তার মেধা, যোগ্যতা, ত্যাগ ও চৌকশ নেতৃত্বের মাধ্যমে আধুনিক সুশিক্ষিত খুটাখালীর গোড়াপত্তন করেন।

মসজিদের উন্নয়ন: খুটাখালী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদটি ছিল নামে মাত্র একটি মসজিদ। এটি ১৮০২ খ্রী: প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন এটি ছিল গাছের খুটি ও ছনের চাউনি দিয়ে নির্মিত দুই কাতারী মসজিদ। ১৯৫৭ খ্রী: তিনি গম্বুজ বিশিষ্ট চার কাতারী মসজিদের কাজ শুরু হয়। তাঁর পিতা মাওলানা মুফতি আবুল ফজল (র:) ও তাঁর বড় ভাই মাওলানা ফয়েজ আহমদ অবৈতনিক খতিব ছিলেন। ১৯৬৭ সালে মাওলানা আফজল আহমদ মসজিদ কমিটিতে অন্য কোন সদস্য না পেয়ে এক সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে প্রথমে মৌলাভী হাফেজ আহমদ পরবর্তীতে মৌলভী নূর আহমদ (নূরা মলই) কে ওয়াক্তিয়া ইমাম ও নূর আহমদ মিয়াজিকে (নুরা মিজ্জি) মুয়াজ্জিন নিয়োগ করেন। ১৯৬৮ সাল হতে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত প্রথম পর্যায়ে সেক্রেটারীর দায়িত্ব পালন করেন। তখন তিনি ইমাম, মুয়াজ্জিন নিয়োগ, রীতিমত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের ব্যবস্থা মাইক দ্বারা আযানের প্রচলন, পুকুরে নলকুপ বসানো, এস্তেঞ্জাখানা নির্মাণ, পুকুর পর্যন্ত মসজিদ সম্প্রসারণ ইত্যাদি উন্নয়ন মূলক কাজ করেন। তিনিই ইমাম ও মুয়াজ্জিনের জন্য সর্বপ্রথম যথাক্রমে ৩০/- টাকা ও ১৫/- টাকা বেতন ভাতা চালু করেন। তিনি এলাকার জনসাধারণ থেকে মসজিদের জন্য চাঁদা তোলে ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মসজিদের আনুসাঙ্গীক উন্নয়নমূলক খরচ মেঠাতেন। তিনি মসজিদের নামকরণ করে “খুটাখালী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ”। ১৯৬৭ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময় মসজিদের সেক্রেটারী ও আমৃত্যু সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করে মসজিদের পূনর্গঠন ও উন্নয়নে অগ্রনী ভূমিকা রেখে গেছেন।

তমিজিয়া ডিগ্রি মাদ্রাসার উন্নয়ন: ০৩/০৬/১৯৬৯ সালে খুটাখালীতে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার জন্য এলাকার গন্যামান্য ব্যক্তিবর্গ নিয়ে এক পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় তাঁকে সুপারিনটেনডেন্ট হওয়ার অনুরোধ করা হয়। ১৬/০৬/১৯৬৯ সালে খুটাখালী তমিজিয়া ইসলামিয়া জুনিয়ার মাদ্রাসা উদ্ভোধন করা হয়। অত্র প্রতিষ্ঠানে তিনি সুপারিনটেনডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হয়। মাদ্রাসাতে এই তারিখ হতে লেখাপড়া চালু হয়। ক্লাসের উদ্ভোধন করেন তারই পিতা মুফতি মাওলানা আবুল ফজল। ১৯৬৯ সনের আগে খুটাখালীতে সরকার অনুমোদিত কোন মাদ্রাসা ছিল না। পতিত খুটাখালী তমিজিয়া মাদ্রাসাটিকে ১৯৭০ সালে একটি অনুমোদিক জুনিয়র মাদ্রাসা হিসাবে প্রতিষ্টার কাজে তিনি নিরলসভাবে আত্মনিয়োগ করেন। মাওলানা আফজল আহমদের সুযোগ্য পরিচালনায় মাদ্রাসাটি দেড় বছরের মধ্যে সরকারি অনুমোদন প্রাপ্ত হয়। বর্তমানে ইহা খুটাখালী তমিজিয়া ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রী) মাদ্রাসা নামে পরিচিত। ১৯৭০ এর মাঝামাঝি সময়ে তিনি খুটাখালী জুনিয়র হাই স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। খুটাখালী উচ্চ বিদ্যালয় পূণ:গঠন : ১৯৭০ সালে খুটাখালীতে একটিও সরকার অনুমোদিত জুনিয়ার হাই স্কুল ছিল না। মাওলানা আফজল আহমদ এর প্রচেষ্টায় হাজী সোলতান আহমদ সিকদার, হাজী আহমদ খাইর মাষ্টার, হাজী বদিউজ্জামান সওদাগর, প্রফেসর মোহাম্মদ নাজের এম.এস.সি, হাজী সেকান্দর কোম্পানী স্কুলের জন্য জমি দান করেন। ১৯৭৪ খ্রী: হাইস্কুল হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। খুটাখালী উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনি প্রতিষ্ঠাতা প্রধান ও সহপ্রধান শিক্ষক হিসাবে দীর্ঘ ১৮ বৎসর দায়িত্ব পালন করেন।

কিশলয় আদর্শ শিক্ষা নিকেতন প্রতিষ্ঠা: ১৯৮০ ইংরেজীতে খুটাখালী ইউনিয়নের কিশলয় আদর্শ শিক্ষা নিকেতন প্রতিষ্ঠায় তাঁর অসামান্য অবদান রয়েছে। তিনি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে অবৈতনিক প্রিন্সিপাল হিসাবে দীর্ঘ আট বৎসর (১৯৮০-৮৮ খ্রী:) দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৮৮ খ্রী: অত্র প্রতিষ্ঠানে ইংরেজী শিক্ষক হিসাবে সরকারীভাবে যোগদান করেন। তিনি ১০ আগষ্ট ২০০২ খ্রী: থেকে ১৯ ডিসেম্বর ২০০২ খ্রী: পর্যন্ত প্রথম পর্যায়ে ২০ নভেম্বর ২০০৪ খ্রী: থেকে ০৪ মার্চ ২০০৫ খ্রী: পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্যায়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে সুচারুরূপে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৯৫-২০০১ পর্যন্ত কিশলয় আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়ে ইংরেজী বিষয়ের খন্ডকালিন শিক্ষক হিসাবে বেসরকারী ভাবে দায়িত্ব পালন করেন।

ওয়ায়েজি বক্তা: মাওলানা আফজল আহমদ একজন প্রসিদ্ধ ওয়ায়েজ বাগ্মী ও সুবক্তা। ছাত্র জীবন সমাপনান্তে এলাকাবাসীর মাঝে তাঁর ওয়াজ নসিহতের সূচনা। ইসলামের শিক্ষা প্রচার ও প্রসার কল্পে তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে ওয়াজ নসিহত করেছেন। তিনি বিভিন্ন সভা- সমাবেশে, সেমিনার- সেম্পুজিয়ামে অংশগ্রহন করে জাতি গঠনমূলক বক্তব্য প্রদান করেন। বাংলাদেশের রাজনীতি, ইসলামী আন্দোলন, ইসলামী জ্ঞান চর্চা, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা ইত্যাদি অনুষঙ্গ কুরআন ও হাদীসের আলোকে অত্যন্ত নিখুঁত ও সহজভাবে উপস্থাপন করেন। মানুষের সর্ববিষয়ে যুগ জিজ্ঞাসার সন্তোষজনক জবাব প্রদান করে মানুষের জীবন চলার পথকে সুগম করেন। তাঁর তথ্যপূর্ণ ও যুক্তিনির্ভর আলোচনায় মাহফিলে পিনপতন নিরবতা বিরজ করে। এমনিভাবে তিনি শিরক, বিদ্আত ও কুসংস্কার মুক্ত সমাজ গঠনে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। তিনি খুটাখালী কেন্দ্রীয় ঈদের জামাতে, শবে বরাত ও শবে কদরের রাত্রিতে আজীবন বক্তব্য রেখে মানুষকে ইসলামী জীবন গঠনে উদ্বোদ্ধ করেছেন।

মানব সেবা: তিনি সেবার ব্রত নিয়েই জীবন অতিবাহিত করেছেন। তিনি সারা জিন্দেগী পরোপকারে কাটিয়েছেন। যে কোন বিপদগ্রস্থ ও অসুস্থ লোকদের প্রতি সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেন। মসজিদে দাঁড়িয়ে টাকা পয়সা তুলে দিয়ে সহযোগীতা করতে তিনি বদ্ধপরিকর।

হোমিও চিকিৎসা: হোমিওপ্যাথ ডাক্তার হিসাবেও তিনি সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি ১৯৮৪ খ্রী: হতে হোমিওপ্যাথ চিকিৎসায় আত্ম নিয়োগ করেন। খুটাখালী বাজারে অবস্থিত ‘রওনক হোমিও হল’ তাঁর হোমিও চিকিৎসা এক অনন্য প্রতিষ্ঠান। কক্সবাজার জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে লোকজন এসে চিকিৎসা গ্রহন করতেন। তিনি খুব স্বল্প মূল্যে গরীব দু:খীদের সাহায্যার্থে হোমিও ঔষধ বিতরণ করে জনহিতকর কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর চিকিৎসায় অসংখ্য মানুষ আরোগ্য লাভ করেছে।

আচার ব্যবহার: তিনি সকলের সাথে ভাল ব্যবহার করতেন। কারো সাথে রাগ করে কথা বলতেন না। অর্থ সম্পদের প্রতি তাঁর লোভ লালসা শূন্যের কোটায়। নিজের জায়গা সম্পদ সম্পর্কেও তিনি উদাসীন। সবখানে তার উপস্থাপনা ছিল অত্যান্ত সুন্দর। তিনি নিরহংকারী, সত্যবাদী, সদালাপি, সুজন, রসিক, ভদ্র এবং যে কোন বিষয়ে সুপরামর্শ দাতা। শিক্ষকতা জীবনে তিনি কোন দিন অনিয়মের আশ্রয় গ্রহণ করেননি। ক্লাস শেষে তিনি অফিসে না গিয়ে সোজা অন্য ক্লাসে চলে যেতেন। তিনি জীবনে কোনদিন হাই তুলেননি এবং পায়ের উপর পা দিয়ে বসেননি। চাকুরী জীবনে কাজে কারবারে, লেনদেনে কোথাও এক পয়সার ত্রুটি বিচ্যুতি বা হেরফের নেই। সর্বক্ষেত্রে তিনি আমানতদারিতা ও স্বচ্ছাতার পরিচয় দিয়েছেন।

সাহিত্য চর্চা: তিনি কর্ম ব্যস্ততার মাঝেও ছড়া, কবিতা, সনেট, গীতি কবিতা, লিমেরিক ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন। ‘সাগরকন্যা’ তাঁর প্রকাশিত কাব্য গ্রন্থ। ১৯৭১ সালে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত শেখ ফজুর স্মরণে “শহীদ শেখ ফজু” নামক একটি পুস্তিকা রচনা করেন। ‘চাচার মেয়ে’ তাঁর অপ্রকাশিত উপন্যাস। সত্তর দশকের ‘সূচনা সাহিত্য সমিতির’ উদ্যোগে রচিত খুটাখালীর প্রথম ম্যাগাজিন ‘সূচনা’ তে খুটাখালীর অভাব কি? নামক দীর্ঘ কবিতা লিখে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ১৯৮৭ খ্রী: প্রকাশিত প্রবাল সাহিত্য সংকলনে তিনি খুটাখালী বহুবিধ ইতিহাস তুলে ধরেছেন। তিনি খুটাখালীর ইতিহাস প্রণেতা ও সুলেখক। তিনি কুয়েতের আন্তর্জাতিক রচনা প্রতিযোগীতায় “আল ইসলামু ওয়া মজায়া লিমারয়াতি ওয়াল মসায়েলুল মুখতালিফা বিহা” শিরোনামে আরবীতে তথ্য বহুল বায়ান্ন পৃষ্টা প্রবন্ধ রচনা করেন। প্রাক্তন ছাত্র সংসদ খুটাখালী উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃক ১৯৯৯ খ্রী: প্রকাশিত “আজি অনুভবি তারে” স্মরণীকায় “কৃতী পুরুষের স্ত্রী ভাগ্য” নামক দীর্ঘ গল্প লিখেছেন। এমনিভাবে স্থানীয়ভাবে প্রকাশিত স্কুল ম্যাগাজিন ও সাহিত্য সাময়িকী ও পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রবন্ধ ও গল্প প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া হোমিওপ্যাথিক ম্যাগাজিনে লিখিত “কোয়াক হোমিওপ্যাথ” “যার নাই কোন গতি সে করে হোমিওপ্যাথি ” প্রবন্ধ ও ‘উল্টো’ (রম্য রচনা) ইত্যাদি তাঁর হোমিও বিষয়ক সাহিত্য কর্ম।

অনন্য সংগঠক: তিনি ১৯৮৪ সালে হোমিওপ্যাথ চিকিৎসায় আত্মনিয়োগ করার পর ঢাকা চট্টগ্রাম কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন হোমিও সম্মেলন ও সেমিনারে যোগদান করেন। তিনি হোমিও সিকিৎসকদেরকে সংগঠিত করার প্রয়াস চালান। তিনি বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের চকরিয়া থানা শাখার সভাপতি এবং কক্সবাজার জেলা শাখার সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে সুচারুরূপে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৬৭ সালে ডুলাহাজারা ইউনিয়ন সমিতি গঠন করেন, একই সনে খুটাখালী বলিবল খেলা সংঘের সেক্রেটারী নির্বাচিত হন এবং খুটাখালী পলি হৈতৈষী সংঘের জেনারেল সেক্রেটারী পদে বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় নির্বাচিত হন।

ধর্ম চর্চা: জীবনে তিনি প্রচন্ড কর্ম ব্যস্থতার মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তিনি আধ্যাত্ত্বিক সাধনায় লিপ্ত থাকতেন। ১৯৬১ সালে তিনি পীরে কামেল হযরত মাওলনা ছৈয়দ তফজ্জল আহমদ মুনিরীর হাতে তরিকতের বায়াত গ্রহণ করেন এবং ইলমে তরিকত সাধনার মাধ্যমে অধ্যাত্ত্বিত উন্নতি লাভ করেন। তিনি ২০০৪ খ্রী: স্বস্ত্রীক বাইতুলাহ শরীফ হজ্ব ও মদিনা মনোয়ারায় রাসুলুলাহ (স:) এর রওজা জিয়ারত করেন। তাঁর জীবনে ছোট খাট কিছু করামত দেখা গেছে।

পারিবারিক জীবন: পরিবারিক জীবনে তিনি চার ছেলে ও দুই মেয়ে সন্তানের জনক। তাঁর প্রথম মেয়ে তৌহিদা আকতার রুমু শৈশব কালেই মৃত্যুবরণ করে। তাঁর জ্যেষ্ট পুত্র আলহাজ্ব কাজী মুজিবুর রহমান নাইক্ষ্যংছড়ি ডিগ্রী কলেজের অধ্যাপক। দ্বিতীয় ছেয়ে ডা: আলহাজ্ব মাওলানা কাজী মো: শওকতুর রহমান স্থানীয় একটি মাদ্রাসার শিক্ষক, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তৃতীয় ছেলে ডা: মাওলানা কাজী মো: আনিসুর রহমান মমতাজুল উলুম ফরিদিয়া দাখিল মাদ্রাসার সহকারী মাওলানা, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক ও সমাজ সেবক। চতুর্থ ছেলে কাজী মো: সাইফুর রহমান কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়র এবং ব্যবসায়ী। একমাত্র মেয়ে ডা: রওনক আরা খানম একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক। সাদা মনের মানুষ কবি মাওলানা আফজল আহমদ। তাঁর যাবতীয় কর্মকান্ড সমাজ উন্নয়নে ও মানব কল্যাণে সমর্পিত। আত্মসুখ অন্বেষণে নিজের জীবন ব্যয়িত করেননি। তাঁর যাবতীয় কর্মযজ্ঞ পরার্থে ও পরোপকারে নিবেদিত। জাতী তাঁর এই নিঃস্বার্থ ত্যাগ, নির্লোভ চরিত্র ও অবদানকে আজীবন আধুনিক সু-শিক্ষিত খুটাখালীর জন্মদাতা হিসেবে স্মরনীয় করবে। তিনি গত ২০ আগষ্ট ২০১১ সালের শনিবার ১৯ শে রমজান বিকাল ৪ ঘটিকায় নিজ বাস ভবনে ইন্তেকাল করেন। ইন্নালিল্লাহি…….. রাজেউন। তাঁকে খুটাখালী কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। আল্লাহ তাকে বেহেস্থ নসিব করুন আমিন।

পাঠকের মতামত: