প্রেস বিজ্ঞপ্তি:
কক্সবাজার শহরের ঐতিহ্যবাহী বায়তুশ শরফ জব্বারিয়া একাডেমিতে গতকাল শুক্রবার অনুষ্ঠিত হলো প্রথম আলো-শিখো জিপিএ-৫ উৎসব। এই উৎসবে শিক্ষা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ার ক্ষেত্রে অবদান, সুবিধা বঞ্চিত মেয়েদের সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করায় এবং মাদক নির্মূলে জনমত গঠনে ভূমিকা রাখায় পাঁচ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা জানানো হয়।
সম্মাননাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা হলেন বায়তুশ শরফ জব্বারিয়া একাডেমির পরিচালনা কমিটির সভাপতি এম সিরাজুল ইসলাম, ঈদগাঁও আদর্শ শিক্ষা নিকেতনের জ্যেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক নুরুল ইসলাম, নোঙরের নির্বাহী পরিচালক দিদারুল আলম রাশেদ, অদম্য মেধাবী তানবীর হোসাইন ও জাতীয় তায়কোয়ান্দো প্রতিযোগিতায় স্বর্ণজয়ী পাঁচ কিশোরী রেখা মনি, রিয়া মনি, সাদিয়া আকতার, রাজিয়া আকতার ও তানিয়া আকতার।
উৎসবে শুরুতে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন প্রথম আলোর কক্সবাজারের নিজস্ব প্রতিবেদক আব্দুল কুদ্দুস। তিনি বলেন, প্রথম আলো সংবাদ পরিবেশনের পাশাপাশি সামাজিক নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। টানা কয়েক বছর বন্ধ থাকার পর আবারও জিপিএ ৫ উৎসব শুরু হয়েছে। তিনি মাদক, মুখস্থ এবং মিথ্যাকে না বলতে শিক্ষার্থীদের অঙ্গীকার করান। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো কক্সবাজার বন্ধুসভার সভাপতি উম্মে সাদিয়া হোসেন সিকদার।
উৎসবে শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্টজনেরা বলেন, জীবনে একবার হারবে, আরেকবার জিতবে। হার-জিতের মধ্যেও সফল হতে হবে। শিক্ষিত হলেই চলবে না, সুশিক্ষিত ও সুনাগরিক হতে হবে। জীবনের একটি ধাপে তোমরা সফল হয়েছো, এজন্য তোমাদের কৃতী সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। এখন তোমরা ঋণী হয়ে গেছো, জীবনের কাছে ঋণী। সুতরাং জীবনকে গড়তে ভালো মানুষ হতে হবে। ভবিষ্যত জীবনে সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। নিজের জয়ের মাধ্যমে দেশকে জয়ী করতে হবে। আমরা সর্বাগ্রে লাল-সবুজের জয় দেখতে চাই।
এবার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় জিপিএ-৫ প্রাপ্ত কৃতী শিক্ষার্থীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় এ উৎসব। প্রথম আলোর আয়োজনে এতে পৃষ্ঠপোষকতা করছে শিক্ষার ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম শিখো। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নানা আয়োজনে উচ্ছ্বাসে মেতেছিল অন্তত দেড় হাজার কৃতী শিক্ষার্থী। সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন আরও কয়েকশ অভিভাবক। অভিভাবকদের অনেকে এসেছেন শত কিলোমিটার দূরের সাগর দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়া, মহেশখথালী, পেকুয়া, চকরিয়া, টেকনাফ থেকে পাহাড়-নদী-সাগর পেরিয়ে।
শিক্ষার্থীদের নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছিল আগেই। সকাল আটটায় উৎসব প্রাঙ্গণে প্রবেশের নির্ধারিত সময় থাকলেও তার আগেই হাজির হয়ে যায় নিবন্ধিত শিক্ষার্থীরা। ১০ টায় জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় উৎসব।
উৎসবে অংশ নিয়ে উচ্ছ্বসিত কক্সবাজার জেলার উত্তরের উপজেলা পেকুয়ার শিলখালী উচ্চ বিদ্যালয়ের জিপিএ ৫ প্রাপ্ত কৃতী ছাত্র আশরাফুল ইসলাম সায়েদ বলে, উৎসবে এসে অনেকদিন পর দেখা হয়েছে বন্ধুদের সঙ্গে। সে কক্সবাজার শহরের একটি কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। অন্যদিকে তার অনেক বন্ধু ভর্তি হয়েছে চট্টগ্রাম ও ঢাকার বিভিন্ন কলেজে।
কক্সবাজার শহর থেকে যেমন শিক্ষার্থীরা এসেছে, তেমনি বিভিন্ন উপজেলা থেকে এ উৎসবে অংশ নেয় অনেক শিক্ষার্থী। দল বেঁধে ৭০ কিলোমিটার দূরের চকরিয়া কোরক বিদ্যাপীঠ থেকে এসেছে ফারিহা তানজিন, উম্মে হাফছা, সূচনা দাশ, হুরাইয়া মাহনূর, সুদীপ ধর। তারা অন্যান্য এলাকা থেকে আসা শিক্ষার্থীদের সাথে সেলফিতে মেতে উঠে।
জিপিএ-৫ পাওয়া নিজের মেয়ে সারিকা ছেহেরীনকে নিয়ে উৎসবে যোগ দিয়েছেন হারবাং ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সচিব সালাহউদ্দিন কাদের। মেয়েকে নিয়ে এতো মেধাবীমুখের সঙ্গে চমৎকার সময় কাটানোর কথা জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্টজনদের বক্তব্য থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছে তাঁর মেয়ে।’
পাহাড়ের ঝুপড়ি ঘরে থেকে দিনমজুরির কাজ করে নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি সংসারের খরচ যুগিয়ে যাচ্ছে বায়তুশ শরফ জব্বারিয়া একাডেমি থেকে জিপিএ ৫ প্রাপ্ত অদম্য মেধাবী তানবীর হোসাইন। ভবিষ্যতে সে প্রকৌশলী হতে চায়। অনুষ্ঠানে এই অদম্য মেধাবীকে প্রথম আলো বন্ধুসভার পক্ষ থেকে ক্রেস্ট দিয়ে সম্মাননা জানানো হয়। তাকে ক্রেস্ট তুলে দেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সৈয়দ করিম। তিনি বলেন, ‘প্রথম আলো সারাদেশের এই অদম্য মেধাবীদের খুঁজে খুঁজে বৃত্তি দিচ্ছে এবং উচ্চ শিক্ষার সুযোগ করে দিচ্ছে।’
দীর্ঘ ১৯ বছরের শিক্ষকতা জীবনে মাত্র তিনদিন ছুটি নিয়েছিলেন ঈদগাঁও আদর্শ শিক্ষা নিকেতনের জ্যেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক নুরুল ইসলাম। বিদ্যালয়ে যান সবার আগে, বাড়ি ফেরেন সবার শেষে। পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের পেছনে তিনি তাঁর জীবনের মূল্যবান সময় ব্যয় করেন। এজন্য এলাকার মানুষ তাকে আলোকিত শিক্ষক হিসেবে জানেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তাকেও বিপুল করতালির মাধ্যমে সম্মাননা জানানো হয়। তাকে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন লোহাগাড়ার আলহাজ¦ মোস্তাফিজুর রহমান কলেজের অধ্যক্ষ ফজলুল হক। তিনি বলেন, ‘আলোকিত শিক্ষকদের মানুষ মনে রাখে। শিক্ষার্থীরা উপকৃত হয়।’ শিক্ষক নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আজকাল শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে শিক্ষকেরা যোগ্য সম্মান পাচ্ছেন না। এজন্য অবশ্য আমরাই দায়ী। আমরা আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছি না।’
জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের পক্ষে টেকনাফ এজাহার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের মুনতাহা হাছিনা নৌমী বলে, ‘মাদক, বখাটেদের উৎপাত, যৌন হয়রানির কারণে অনেক মেধাবী ঝরে পড়ছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতির পাশাপাশি মাদক বিরোধী প্রচারণা দরকার। প্রথম আলো সেই জায়গায় বড় ভূমিকা রাখতে পারে।’
অনুষ্ঠানে কক্সবাজার জেলায় গত ১০ বছরে প্রায় ৯ হাজার মাদকাসক্তকে সেবা দিয়ে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিয়েছে বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী মাদক বিরোধী সংগঠন নোঙর। অনুষ্ঠানে নোঙরের নির্বাহী পরিচালক দিদারুল আলম রাশেদকে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন কক্সবাজার সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ সোলাইমান। তিনি বলেন, মাদক চোরাচালানের নিরাপদ রুট হিসেবে কক্সবাজারকে ব্যবহার করা হচ্ছে। বন্দুকযুদ্ধে অনেক মাদক কারবারির মৃত্যু হলেও চোরাচালান বন্ধ করা যাচ্ছে না। যুব সমাজ ঝুঁকিতে আছে।
গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় তায়কোয়ান্দো প্রতিযোগিতায় পাঁচটি স্বর্ণপদক এবং ১১টি তামা ও রৌপ্য পদক ছিনিয়ে এনেছিল কক্সবাজারের সুবিধা বঞ্চিত ১১জন কিশোরী। একসময় তারা সমুদ্র সৈকতে পর্যটকদের শামুক, ঝিনুকমালা, চা-কপি বিক্রি করে সংসার চালাত। এখন তাঁদের পড়াশোনার পাশাপাশি আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে তায়কোয়ান্দো প্রশিক্ষণ দিচ্ছে কক্সবাজার শহরের বাইপাস সড়কের পালস-বানি একাডেমি। গত দুই বছর ধরে তাঁরা ৩২জন সুবিধা বঞ্চিত কিশোর-কিশোরীকে এই প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। জিপিএ ৫ সংবর্ধনায় স্বর্ণজয়ী পাঁচজন কিশোরী ‘আত্মরক্ষার কৌশল’ প্রদর্শন করে উপস্থিত সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। এতোদূর আসার পেছনের নেপথ্য কারণ তুলে ধরে কক্সবাজার সিটি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী তায়কোয়ান্দোতে ব্ল্যাকবেল্ট প্রাপ্ত রেখা মনি বলেন, ‘ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। আমাদের সমাজে নারীরা নানা বঞ্চনার শিকার। পথে পথে বাধার সম্মুখিন। এসব প্রতিরোধে লেখাপড়ার পাশাপাশি সবমেয়েদের আত্মরক্ষার কৌশল শেখা জরুরি।’ স্বর্ণজয়ী পাঁচ কিশোরীকে প্রথম আলো বন্ধুসভার সম্মাননা স্মারক তুলে দেন কক্সবাজার সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ গিয়াস উদ্দিন। স্মারকটি গ্রহণ করেন পালস-বানি একাডেমির চেয়ারম্যান আবু মোরশেদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘পাহাড়-জঙ্গল, সমুদ্র উপকূলে পড়ে থাকা শিশু-কিশোরদের খুঁজে এনে পড়াশোনার পাশাপাশি আত্মরক্ষার কৌশল শেখানো হচ্ছে। ইতিমধ্যে এই ছেলে-মেয়েরা পাঁচটি স্বর্ণসহ ২০টি পদক পেয়েছে। আগামীতে তাঁরা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।’
অনুষ্ঠানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ার কারিগর হিসেবে সম্মাননা স্মারক তুলে দেয়া হয় শহরের প্রবীণ শিক্ষক এম সিরাজুল ইসলামকে। তিনি একাধারে ৪০ বছর শিক্ষকতা শেষে এখনও একটি কলেজ, দুটি উচ্চ বিদ্যালয়, একটি চক্ষু হাসপাতাল, চারটি এতিমখানাসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা ও নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁকে বন্ধুসভার সম্মাননা স্মারক তুলে দেন প্রথম আলোর স্পোর্টস এডিটর উৎপল শুভ্র। উৎপল শুভ্র বলেন, ‘জিপিএ ৫ উৎসবে সবচেয়ে ব্যতিক্রম সমাজের জন্য কাজ করে যাওয়া মানুষজনকে খুঁজে এনে স্বীকৃতি জানানোর বিষয়টি। এতে অন্যরাও এ কাজে উৎসাহিত হবে। প্রথম আলো সংবাদ পরিবেশনের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশে গণিত উৎসব, ভাষা প্রতিযোগ, বিতর্ক প্রতিযোগিতাসহ নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে আসছে।’ কৃতীদের উদ্দেেেশ্য তিনি বলেন, ‘শুধু জিপিএ-৫ নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে কঠোর সাধনার বিকল্প নেই।’ খেলাধুলার নানা প্রসঙ্গ তুলে ধরে উৎপল শুভ্র বলেন, ‘খেলা মানুষের সহজাত মানবীয় গুনাবলীর একটি। খেলা মানুষের জীবনকে শেখায়। খেলা ইউনিটি শেখায়। খেলা নেতৃত্ব শেখায়। খেলা সেক্রিফাইস শেখায়। খেলায় হার-জীত থাকবে, জীবনও তাই।’
শেষ বয়সে প্রথম আলো বন্ধুসভার স্বীকৃতি পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন শিক্ষাবিদ এম সিরাজুল ইসলাম। তিনি বায়তুশ শরফ জব্বারিয়া একাডেমির (উচ্চ বিদ্যালয়) পরিচালনা কমিটির সভাপতি। তিনি বলেন, ‘এই প্রতিষ্ঠানে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান সব সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরা সমান সুযোগ সুবিধা নিয়ে পড়ছে। কক্সবাজার জেলার দুই শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান বিভাগে যত শিক্ষার্থী আছে, তার অর্ধেক এই বায়তুশ শরফে পড়ছে। আমরা বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষাকে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করছি। এর একমাত্র কারণ বাংলাদেশের উন্নতি।’
শিক্ষার্থীদের করণীয় বিষয় নিয়ে বক্তব্য দেন চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সাবেক সচিব ও উত্তরণ মডেল কলেজের অধ্যক্ষ একেএম ফজলুল করিম চৌধুরী, কক্সবাজার জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নাছির উদ্দিন, কক্সবাজার মডেল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. রমজান আলী, অভিভাবক টেকনাফ উপজেলা পািরষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ইউনুছ বাঙালি।
অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে চলে শিক্ষার্থী ও বন্ধুসভার সদস্যদের গান, নৃত্য-আবৃত্তি ও কথামালা। সাংস্কৃতিক পর্ব পরিচালনা করেন বন্ধুসভার সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম। আমরা করবো জয় এই গানের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে সংবর্ধনা উৎসবের।
পাঠকের মতামত: